ইন্দ্রনীল শুক্লা: প্রত্যেক শহরই কিছু কথা বলে। ইট-কাঠ-পাথরের পাঁজরে বুকে জমা থাকে অনেক গল্প। কিছু দুঃখ, কিছু আনন্দ, কিছু অভিমান, কিছু অপমান। নাগরিক নিয়েই তো নগর। নাই বা হলেন কেউ মহানাগরিক। কিন্তু অনুভূতিগুলোর বুঝি মূল্য নেই! তাদের মনের অলিগলিতে ঘুরেই তৈরি ‘মাই মেলবোর্ন’। ছবির নামেই যথেষ্ট স্পষ্ট যে এ কাহিনি অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশেষ শহরের গপ্পো। কিন্তু যখন ‘মাই’ অর্থাৎ ‘আমার’ বলছি, তখনই তা অনেকখানি ব্যক্তিগত হয়ে যায়। চারটি এমন সাধারণ মানুষের সাধারণ গল্প নিয়েই মেলবোর্ন শহরকেন্দ্রিক এই ছবিটি বুনেছেন ইমতিয়াজ আলি, কবীর খান, রীমা দাস, ওনির।
এমন গল্প যে আমরা আগে দেখিনি বা পড়িনি এমনটা নয়। জেমস জয়েসের লেখা ডাবলিন শহরের গল্প, আলবার্তো মোরাভিয়ার রোম নগরের গল্প পড়েছি, আবার সত্যজিতের ‘মহানগর’ কিংবা অনেক পরে মুম্বই নিযে অনুরাগ বসুর ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ দেখেছি। এবার কিন্তু ঘটনাস্থল মেলবোর্ন শহর। এ ছবির নাম হতেই পারতো ‘লাইফ ইন মেলবোর্ন’। ছবিতে চারটি কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আমরা দেখছি চারটি গল্পে। ‘নন্দিনী’ গল্পে এক সমকামী ভারতীয় বাঙালি যুবক ইন্দ্র তার বাড়ির অমতে মেলবোর্ন শহরে এসে রয়েছে তার অস্ট্রেলিয়ার পার্টনারের সঙ্গে। ইন্দ্রর মা মারা গিয়েছেন। বাবা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন মায়ের অস্থিভষ্ম নিয়ে। শেষ কাজটা ছেলেকে নিয়ে করতে চান।
‘জুলস’ গল্পে যার নামে গল্প, সেই জুলস এক ভবঘুরে পাগল মহিলা। আর তার সঙ্গে বার বার রাস্তায় দেখা হয়ে যায় সাক্ষী নামের এক মেয়ের। সাক্ষী ভারত থেকে এ শহরে বরের সঙ্গে এসেছে, আর অতিরিক্ত কিছু রোজগারের জন্য এক রাস্তার ধারের রেস্তরাঁতে বাসন ধোয়ার, সবজি কাটার কাজ করে। কিন্তু দেশে তার মা জানে মেয়ে এক নামী হোটেলের শেফ।
‘এমা’ গল্পে আমরা দেখি আংশিক বধির এক মেয়েকে। তারই নাম এমা। প্যাশন ব্যালে নাচ। কিন্তু বধিরতাই তার বাধাও বটে। কল্পনায় সে উড়ে চলে নিজের ব্যালে নাচের ডানায় ভর করে।
শেষের ‘সিতারা’ নামের গল্পটিতে দেখা মেলে শীর্ণকায় এক কন্যার। নাম সিতারা। আফগানিস্থানে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে সে তার মা আর এক দিদির সঙ্গে চলে এসেছে মেলবোর্ন। এক সময়ে সে ক্রিকেট খেলে ক্লাব স্তরে মেডেল, কাপ পেয়েছে। কিন্তু সেসব নিজের দেশে বুকে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু মেলবোর্ন শহরে সে আবার সুয়োগ পেয়ে যায় ক্রিকেট খেলার।
এ ছবিতে চার গল্পের চরিত্রদের কখনও-সখনও প্যাসিভভাবে দেখা হয়ে যায় ট্রামে, বাসে, পথে। এভাবেই চারটি গল্পও হয়ে ওঠে সহনাগরিক। ইন্দ্রর এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তার বাবা মেনে নিলেন কি? বধির মেয়েটি কি খুজে পেল তার নাচের ঠিকানা? সাক্ষী কেমন ভাবে মুক্তি পেতে চাইল তার সমস্যাগুলো থেকে? উন্মাদ মহিলাই বুঝি তাকে পথ দেখাল! আর সিতারাই বা কেমন করে নিজের আফগানিস্তানের খেলার মাঠকে খুঁজে পেল মেলবোর্নে, পারিবারিক বাধা কাটিয়ে আবার বোলিং শুরু করে সাফল্য পেল কি? এই সব ব্যক্তিগত গল্পগুলোই গেঁথে উঠেছে মালার মতো।
বিরাট কায়দার এডিটিং নেই। জাম্প কাট নেই। ফ্ল্যাশবাক খুব কমই। ক্যামেরাতেও ইন্টেলেকচুয়াল হয়ে ওঠার তাগিদ নেই। বরং আছে সরল স্টোরি টেলিং। ঠিক যেমনভাবে একটা শহরে দুটো-তিনটে মানুষ দেখা হলে চা খেযে, বিয়ার পান করে বা সিগারেটে টান দিয়ে জীবনের সাধারণ চারটে কথা বলে, এ ছবিতেও তেমনই সম্পর্ক রয়েছে দর্শকের সঙ্গে পরিচালকের, এক গল্পের সঙ্গে অন্য গল্পের। আর এভাবেই মেলবোর্ন শহরের কয়েকটা মানুষের গল্প শুনতে বসে যেতে পারেন অন্য শহরের মানুষও। অথবা দর্শকও। নিজের নাগরিক ক্লান্তির সঙ্গে আইডেন্টিফাই করে দেখতে চাইতেই পারেন এমন কটা গল্প।
ছবি: মাই মেলবোর্ন
অভিনয়ে: আরিফ আলি, নাজিফা আমির, শিবাঙ্গী ভৌমিক, সমীরা কোক্স, উইলিয়াম ডুয়ান প্রমুখ
পরিচালনা: ইমতিয়াজ আলি, কবীর খান, রীমা দাস, ওনির