রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: টাইম প্রেজেন্ট অ্যান্ড টাইম পাস্ট আর বোথ পারহ্যাপস প্রেজেন্ট ইন টাইম ফিউচার/ অ্যান্ড টাইম ফিউচার কনটেনড ইন টাইম পাস্ট- টি এস এলিয়টের বার্ন্ট নর্টন কাব্যের সূচনার অব্যর্থ উচ্চারণ। এই বাণী সুমন ঘোষের প্রশ্নাতীত মাস্টারপিস মুভি 'পুরাতন'-এর হৃদয়দীপন! সমস্ত ছবিটির অন্তর স্রোতে বহমান সময়দর্শন আমাদের নিয়ে যায় এই অনুভবে যে, সবাই আমরা কোনও না কোনও ভাবে খুঁজে পাই একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর পিছনে ফেলে আসা অতীতে। অতীত থেকে পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই আমাদের। আমাদের সমস্ত আপাত অগ্রসর ডুব সাঁতার কাটে আমাদের মধুর মেদুরতায়। মুছে যায় শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসা ও পিছিয়ে যাওয়ার বিভেদরেখা, লুপ্ত হয় আরোহণ ও অবরহণের বৃন্দার বিভাস। সময়ের এই আনন্তিক খেলার মধ্যে চিরকালীন হয়ে থাকবে শ্রীকৃষ্ণ এবং টি এস এলিয়ট এর সময় দর্শন।

ইফ অল টাইম ইজ ইটারন্যালি প্রেজেন্ট, অল টাইম ইজ আনরিডিমেবল। আমি বলছিনা 'পুরাতন - এর লেখক এবং পরিচালকের উপর গীতার কৃষ্ণ থেকে বার্ন্ট নর্টনের এলিয়ট, কারও কোনও প্রভাব পড়েছে। কিন্তু একথা কী করে বলি, সুমনের মার্জিত মননে এঁদের সময় দর্শনের প্রতিধ্বনি নেই? এ কথাই বা কেমন করে বলি, যে নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর (ঋত্বিকা) মায়ের বাড়ি (শর্মিলা ঠাকুর) দেখতে দেখতে অনেক বছর আগে পড়া ওরহান পামুকের 'দা মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স' উপন্যাসের গর্ভে ঢুকে যাইনি? ঢুকে যাইনি পামুকের সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী 'মেমোরিস অফ ডিসটেন্ট মাউন্টেইন্ডস'- এ? সুমনের ব্যাপ্ত দীপনে এই সমস্ত কিছু এসেছে। আর সেই আসা থেকেই তৈরি হয়েছ এই ছবির বিরল বুনন। সুমন সারা ছবি জুড়ে খেলেছেন ধ্বনি প্রতিধ্বনির খেলা। শিকড়ে বাকরে জটিল জড়িয়ে থাকার খেলা। বোঝা যায় সময়ের দর্শন তাঁকে ভাবায়। এবং এই ছবিতে ঘটেছে সেই ভাবনার শিক্ষিত, মার্জিত, বহু পরতের প্রকাশ।
'পুরাতন' শহর থেকে দূরের ছবি হয়েও একান্তভাবে শহুরে শিক্ষিত বাঙালির ছবি। যে ছবির স্মৃতিকীর্ণ কেন্দ্রে অবিকল্প শর্মিলা ঠাকুর। আর কোনও বিকল্প আমি সত্যিই ভাবতে পারছি না। বিচ্ছুরনে, আভিজাত্যে, সৌন্দর্যে এবং অভিনয় সুষমায় অনন্য। অনেকে বলছেন, এটিই তাঁর শেষ বাংলা ছবি। হলেও হতে পারে। এই অভিনয়ের পরে, এমন এক চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলার পরে, তাঁকে ভাবতে হবে বইকী! এই ছবির দুই নায়িকা। একজন তিনি। অন্যজন ঋতুপর্ণা, তাঁর মেয়ে ঋত্বিকা । শর্মিলার অতীত বলে কিছু নেই। তাঁর অতীতই তাঁর বর্তমান। বলছি না তিনি অতীতে আটকে থাকা মানুষ। তিনি অতীতে মুক্তি পাওয়া মানুষ। অতীত তাঁর উড়ানের আকাশ। অতীত তাঁর আশ্রয়ের আবাস। তাঁর মেয়ের স্বামী রাজীব (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ), সেও মুক্তি পেয়েছে তার গুহামুখী রিসার্চের প্রসারে। সে মননে অতি আধুনিক। কিন্তু তার প্রেম প্রাচীন পৃথিবীর হারানো প্রাণ ও প্রণয়। সে পৌরাণিক অন্ধকারে জ্বালাতে চায় আলো। সে একটি নারীর হাত ধরে গুহার আঁধারে খোঁজে সম্পর্কের শরীর ও শিকড়। আর অন্ধকার ঘরে, স্ত্রীর চোখের আড়ালে কার ছবি দেখে? এই অপূর্ব রহস্যের আড়াল পেতে দেখতেই হবে 'পুরাতন'। আর ঋতুপর্ণা তো এই ছবির অপূর্বা! অভিনয়ে অসামান্য। এবং চাপা শরীরী অন্তরস্রোতে অনবদ্য। ঋতু ইংরেজি ও বাংলায় যেহেতু সমান সাবলীল, এই শহুরে ছবির সংলাপে সে হয়ে উঠতে পেরেছে প্রেমে পড়ার মতো ভালো। ৮৪ বছর বয়েসে সে আরও একবার আমার হদয় উপড়ে নিলো। তার প্রতিটি ছোটো ছোটো দৃশ্য এক একটি প্রেমপত্র। ঋতু ছড়িয়ে রেখে গেছে সারা ছবি জুড়ে। আমি রেখে গেলাম এই লেখায় তার প্রতিটি দৃশ্যের জন্য আলাদা আদর।