বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: এপিসোড ২, কথা হচ্ছে দু'জন পুলিশ অফিসারের মধ্যে। একটি স্কুলে তারা ছাত্রমৃত্যুর তদন্তে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছেন। একটি ১৩ বছরের ছেলে কেন তার সহপাঠীকে ছুরির সাত কোপে মেরে ফেলল- এ যেন এক জটিল অঙ্ক! 'মিশা' (মহিলা অফিসার) তার পুরুষ সহকর্মীকে, শিশুমন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলে, 'সব বাচ্চাই চায় তার অস্তিত্বের যে একটা মানে আছে এটা আশ্বস্ত করার জন্য যেন কেউ থাকে।'

১৩ মার্চ নেটফ্লিক্সে ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজ 'অ্যাডোলেসেন্স' মুক্তি পাওয়া মাত্রই হইচই ফেলে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রশংসার বন্যা বয়ে যাচ্ছে এই সিরিজের স্টোরিটেলিং,অভিনয় এবং ক্যামেরার কাজ নিয়ে। উপরের অংশটি এই সিরিজেরই। এবং গোটা সিরিজ জুড়ে এই কথাটাই নানা ভাবে, নানা চরিত্রের ব্যবহারে, সংলাপে ফিরে ফিরে আসে। একেকটি ৫০ মিনিটের, সব মিলিয়ে মোট চারটে এপিসোড। এবং চর্চা তুঙ্গে, কী অবিশ্বাস্যভাবে প্রতি এপিসোড একটা টেকে তোলা হয়েছে। ফর্ম নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাকে ব্যাপ্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই সিরিজের হৃদয়ে এত ক্ষত, অনিশ্চয়তা, দ্বন্দ্ব, হিংসা, না পাওয়া, অতৃপ্তি, চাপা কান্না জমে আছে যে দেখতে দেখতে ১৩ বছরের জেমি (ওয়েন কুপার) এবং তার আশপাশের জগতের মধ্যে ডুবে যেতে হয়। এবং এই জগৎ, এই সমাজ আমাদের বাইরের কিছু নয়, এটা আমাদের নিয়েই তৈরি। হ্যাঁ, একটা মার্ডার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটা ক্রাইম থ্রিলার নয়। 'কেটি'র মৃতদেহ একবারের জন্যও পর্দায় আসে না, এমনকী ইনভেস্টিগেশনও একটা পর্যায়ের পর আর দেখানো হয় না। তাহলে? 'অ্যাডোলেসেন্স'-এর অনুসন্ধান আসলে ১৩ বছরের এক টিনএজারের মন নিয়ে, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিয়ে, এই সমাজ নিয়ে, এই সময় নিয়ে। এই যে চতুর্দিকে ঘরে, বাইরে, অফিসে, পাড়ায়, স্কুলে, মিসোজিনির পতাকা উড়ছে, নারীর উপর পুরুষের রাগ, সেখান থেকে হিংসা-এই সব কিছুকে অনুসন্ধান করার সৎ প্রয়াস এই সিরিজ। সব উত্তর ঠিকমতো পাওয়াও যায় না, দেওয়ার চেষ্টাও করেননি মেকাররা। একটা ছোট ছেলে যে খুন করল, দায়ী কে? বাবা-মায়ের শিক্ষা? স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষকদের নিস্পৃহতা? সোশ্যাল মিডিয়াতে 'ইনসেল' কালচারের উপস্থিতি (যেখানে নারী-বিরোধী কথা প্রচার করা হয়)? পিয়ার প্রেসার? একাকিত্ব, অবসাদ? জেমির বাবা (স্টিফেন গ্রাহাম, তিনি শোয়ের সহ-নির্মাতা) বলে, আমরা ওকে তৈরি করেছি, আবার আমরাই আমাদের মেয়ে লিসাকেও তৈরি করেছি, তাহলে গন্ডগোলটা কোথায় হল? স্ত্রী বলে, তোমার ছেলে তোমার মতো মেজাজ পেয়েছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে কী চলছে, বন্ধ ঘরে কী করছে, কী করে বুঝব। দ্বিতীয় এপিসোডে ডিটেকটিভ মিশা বলেছিল, কোনওদিন পুরোপুরি জানা সম্ভব নয় ঠিক কেন খুন করল!
এই সিরিজের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিক হল যেভাবে খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একেকটা দিক ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এবং প্রায় রিয়াল টাইমে। প্রথম এপিসোডে অ্যারেস্ট এবং তার প্রসেস ডিটেল। এটা দেখলে মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাবে, অসহায় লাগবে, মনে হবে পায়ের তলায় মাটি নেই। এবং দর্শক এই এপিসোডে বাবা-মায়ের স্থানেই নিজেকে রাখবে নিজেরই অজান্তে।
দ্বিতীয় এপিসোডে স্কুলে ইনভেস্টিগেশন। আসল উদ্দেশ্য হল এই পৃথিবীতে যে সামাজিক সিস্টেমের মধ্যে আমরা বাস করছি তার একটা মিনি ইউনিভার্স তুলে ধরা। একটা খুনের পরও বেশির ভাগ ছাত্রের মধ্যে ক্যাজুয়াল ভাব, পুরুষ টিচারদের মধ্যে ('মালিক') গা-ছাড়া ভাব, এবং স্টুডেন্টদের নিয়ে নিস্পৃহতা, স্টুডেন্ট-টিচারদের মধ্যে যে সেতু তৈরি হয় না আজকাল সেটাও বোঝা যায়। এই প্রজন্ম কেন এইরকম? কী অনায়াসে শিক্ষককে বলতে পারে 'শাট আপ মিস'। সেই মিসের কথায় অবস্থাটা হল 'কমপ্লিট কেওস'।
তৃতীয় এপিসোড নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। প্রায় সাত মাস পর ট্রেনিং সেন্টারে সাইকোলজিস্টের সঙ্গে জেমির কথোপকথন। ম্যাসকুলিনিটি নিয়ে ছেলেটির দৃষ্টিভঙ্গি (আসলে এই সময়ে দাঁড়িয়ে গোটা পুরুষ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি) বোঝার চেষ্টা করেন সাইকোলজিস্ট 'ব্রিয়নি'। পুরুষ এবং নারীর ডায়নামিক্স কোথায় অবস্থান করছে, কীভাবে অবস্থান করছে- একটু একটু করে পিঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে এই সেশনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে। ছোটবেলার অভিজ্ঞতা, যে ছেলেকে নিজেকে লজ্জা পেতে শিখিয়েছে, এই টক্সিক সোশাল মিডিয়ার যুদ্ধে যে টিনএজার নিজেকে আগলি মনে করে, যে মনে করে নারীর সঙ্গে পাওয়ার প্লে-তে তার কুশ্রী চেহারা নিয়ে সে তখনই অগ্রসর হতে পারবে যখন মেয়েটি তার সবচেয়ে লো ফেজ-এ, সবচেয়ে ভালনারেবল। এই প্রিডেটর মানসিকতা বোধহয় আদিম যুগ থেকেই চলে আসছে। খাদ্য এবং খাদকের যে রসায়ন। দুঃখের বিষয়, এই ২০২৫-এও পুরুষ এবং নারীর মধ্যে সেই রসায়ন আবহমান। এবং এখন যেন আরও তীব্রভাবে। একজন মহিলা মনোবিদ তাকে সময় দিচ্ছে, তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে শুনছে- বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে জেমির জীবনে একজন নারীর এতটা কাছাকাছি আসার সুযোগ আর কখনও আসেনি। সে কী বলবে, কী করবে বুঝতে পারে না। জেমি কখনও ব্যঙ্গ করে, কখনও আপত্তিকর ভাষা এবং বডি ল্যাংগুয়েজ প্রয়োগ করে নিজেকে পাওয়ারফুল প্রমাণ করতে চায়। আমার চারপাশে (বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে) বহু পুরুষকে দেখেছি আমার মহিলা সহকর্মীকে 'বুলি' করে, ব্যঙ্গ করে একটা আপার হ্যান্ড নেওয়ার চেষ্টা করতে। এই প্রবণতা জেমি শিখল কোথায়? নিজে বুলি এবং হ্যারাসড হওয়ার পরেই হয়তো। এবং সেই যে ছোটবেলায় ফুটবল (যেটা প্রধানত পুরুষের খেলা) খেলতে না পারায়, বাবার চোখে লজ্জা দেখেছিল, সেই লজ্জা আর অপমানের দাগ এতটাই গাঢ় যে সে এখনও অপমানিত হলে নিজেকে ডিফেন্ড করতে শেখেনি, কেবল ভিতরে ভিতরে রাগ পুষে রাখতে শিখেছে। রেগে গেলে জেমি এবং তার প্রজন্ম জানে কেবল অ্যাটাক করতে। সেদিন যদি বাবা বলত, 'পারিসনি তো কী হয়েছে, ইটস ওকে' তাহলে বোধহয় জেমি এবং জেমির মতো সবাই সাহস পেত। পায়নি। বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে যে কোনও শিশুর এই সাহস, পিঠে জড়িয়ে থাকা ভরসার হাত বড় প্রয়োজন। এটাই আমরা খুঁজে চলি সারা জীবন ধরে। ছোট, বড় আমরা সবাই এটাই খুঁজি।
পুলিশ ইন্সপেক্টরও মনোবিদকে নানারকম সাহায্য করার ছলে, কখনও চমকে দেওয়ার ছলে নিজেকে এই নারীর চোখে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। জেমি আর ওই পুলিশের মধ্যে খুব তফাত নেই বোধহয়। সেই যে মিশা (মহিলা পুলিশ) বলেছিল সব শিশু চায় এই 'ওকে' বলার কেউ থাকুক, এটাই অন্তরবার্তা। যখন জেমি শোনে ব্রিয়নি (মনোবিদ) আর আসবে না সে ভেঙে পড়ে। এই একটা মোলাকাতের জন্যই তো ছিল তার আকুল পথ চেয়ে থাকা। সে চিৎকার করতে থাকে, ছটফট করতে থাকে, এবং বার বার জিজ্ঞেস করে 'ডু ইউ লাইক মি'? যেন এই উত্তরের উপর তার বেঁচে থাকা, তার অস্তিত্ব নির্ভর করছে। 'ডু ইউ লাইক মি' যেন একটা হাহাকার। সিরিজ শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরেও সেটা শোনা যায়। আসলে এই প্রশ্ন আমাদের আজন্ম, আমৃত্যু তাড়া করে ফেরে। এই প্রশ্নের প্রিফিক্সে আছে আরেকটা বাক্য যেটা আমরা কোনওদিন মুখে আনি না। আই ডু নট লাইক মাইসেলফ, ডু ইউ লাইক মি? কেন নিজেকে ভালোবাসি না, কেন ভালোবাসতে পারি না 'অ্যাডোলেসেন্স' তারই অনুসন্ধান করে।