সুমিত বিশ্বাস ও সুনীপা চক্রবর্তী, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রাম: পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে এ যেন অন্য বনমহল! কাঠফাটা রোদ্দুর, লু একেবারে উধাও। গাছ থেকে প্রায় সারাক্ষণ পড়তে থাকা মহুলের গন্ধ লাগছে নাকে। হাওয়ায় দুলছে লাল কৃষ্ণচূড়া। সর্বোচ্চ ঘুরপাক খাচ্ছে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ঘরে। আর অযোধ্যা পাহাড়ে এসি তো দূর অস্ত। পাখার সুইচেও হাত দেওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা হলেই গায়ে চাপাতে হচ্ছে হাফ হাতা জ্যাকেট বা চাদর। একে মনোরম আবহাওয়া, তার উপর বাংলার নববর্ষ। জমিয়ে খাওয়াদাওয়া তো মাস্ট! পাতে সব বাহারি পদও হাজির।

পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোট ইকো ট্যুরিজম প্রকল্প। ছবি: প্রতিবেদক।
রাজ্যের উষ্ণতম জেলা পুরুলিয়ায় পা রেখেও অযোধ্যা হিলটপে এমন শীত-শীত আমেজ। মনে হচ্ছে যেন সিকিমের পেলিং। আর তাই নববর্ষের প্রাক্কালে জমজমাট পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের পর্যটন। সেই সঙ্গে প্রায় একই আবহ খনি এলাকা নিতুড়িয়ার গড় পঞ্চকোটেও। আসলে বাংলা নববর্ষের আগে এই উইকেন্ডে কালবৈশাখীর দাপট থাকায় আরেক বনমহল ঝাড়গ্রামও ভীষণ মনোরম। ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। তাই অযোধ্যা পাহাড়ে বৈশাখী মহাভোজে মোচার চপ, ঢাকাই মুর্গ, এঁচোড়ের কালিয়া, সাদা ভাত, ঘি যেমন দারুণ লোভনীয়, তেমনই ঝাড়গ্রামে বৈশাখী বড়াখানায় মিলছে ঢেঁকিছাটা চালের পান্তা। সঙ্গে রসুন, পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে পাট শাক, পেঁয়াজ পোস্ত, রকমারি বড়া। সঙ্গে আবার ইলিশ মাছ ভাজা।
পয়লা বৈশাখে সাজানো পাত। ছবি: প্রতিবেদক।
জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার পর্যটন আর শুধু মরশুম কেন্দ্রিক নয়। গ্রীষ্মে দিনের বেলায় দফারফা হলেও অযোধ্যা পাহাড়, গড় পঞ্চকোট, বড়ন্তি এমনকি দলমা পাহাড় রেঞ্জ ছুঁয়ে থাকা দুয়ারসিনিতেও সন্ধ্যার পর ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল কুল! বনমহলের এই এলাকায় জঙ্গল বৃদ্ধিতে সন্ধ্যার সময় থেকে যে হাওয়া চলে, তাই-ই পরিবেশকে একেবারে মনোরম করে দেয়। সামাজিক মাধ্যমের উপর ভর করে গ্রীষ্মে পুরুলিয়ার পাহাড়ি এলাকার এমন আবহ পর্যটকদের আর অজানা নয়। তবে গত শুক্র ও শনি অযোধ্যা পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ায় সন্ধ্যার পর পর্যটকদের গরম পোশাক গায়ে দিতে হচ্ছে। আর এমন আবহাওয়া হোটেল, লজ, কটেজ, রিসর্ট, সরকারি অতিথি আবাস সব পর্যটকদের ভিড়ে হাউসফুল।
অযোধ্যা হিলটপের কচুরিরাখায় রাজ্যের পর্যটন প্রকল্পের লিজ পাওয়া রিসর্টের জেনারেল ম্যানেজার সুদীপ্ত কুমার বলেন, "গরমেও পুরুলিয়ার অন্য একটা রূপ আছে। সেটা আমরা বাংলার পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরেছি। তাপপ্রবাহেও সন্ধ্যার পর থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের আবহাওয়াটা একেবারে বদলে যায়। দিনের বেলায় ইনডোরে পর্যটকদেরকে নানা কিছুতে ব্যস্ত রেখে সন্ধ্যার দিকে মনোরম আবহাওয়ার মজা সেটা আমরা আমাদের পর্যটন প্রকল্পে তুলে ধরেছি। তাছাড়া অযোধ্যা পাহাড়ের গত দু'দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় এখানে একেবারে শীত-শীত ভাব। তাই আনন্দে মেতে উঠেছেন নববর্ষের উইকন্ডে বেড়াতে আসা বিপুল সংখ্যক পর্যটক।"
নববর্ষে বেড়ানোর সঙ্গে বাঙালির পেটপুজো ছাড়া তো চলবে না। তাই নতুন বাংলা বছরে অযোধ্যা পাহাড়েও একেবারে ষোলআনা বাঙালিয়ানা। ওই রিসর্টে পয়লা ও দোসরা বৈশাখ নববর্ষ স্পেশাল দুটি থালি থাকছে। একটি বৈশাখী মহাভোজ। আরেকটি বৈশাখী ভুরিভোজ। তাতে কী নেই? লাল শাক ভাজা, শুক্তো, আলু ঝিঙে পোস্ত, এঁচোড়ের কালিয়া, ছানার মালাইকারি, লুচি, সাদা ভাত, ঘি, বাসন্তী পোলাও, ভেটকি মাছের পাতুড়ি, ঢাকাই মুর্গ, মাটন কষা, কাঁচা আমের চাটনি, পাকা আম, কমলাভোগ, মিষ্টি দই, মিষ্টি পান। বৈশাখী ভূরিভোজের রেট ৭৯৯, মহাভোজের ৯৯৯ টাকা। গড় পঞ্চকোট ইকো ট্যুরিজম থেকে শহর পুরুলিয়ার বাঙালি রেস্তরাঁগুলিতেও এমন ভূরিভোজের আয়োজন রয়েছে। গড়পঞ্চকোট ইকো ট্যুরিজমের চিফ জেনারেল ম্যানেজার মৃন্ময় বসু বলেন, "নববর্ষের আগের উইকেন্ড। সেই সঙ্গে তারপরের উইকেন্ড। পরপর দুটো সপ্তাহের শেষ-ই একেবারে হাউসফুল। আবহাওয়ার এমন বদল হয়ে যাওয়াতেই পর্যটক যেন উপচে পড়ছে।" পুরুলিয়া হোটেল,লজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহিত লাটার কথায়, "এখন দার্জিলিংয়ের পরেই পুরুলিয়ার পর্যটনের সেরা ডেস্টিনেশন। সারা বছর পুরুলিয়ায় ভিড় হচ্ছে।"
খাবার টেবিল এমনিই সুসজ্জিত যে লোভ সামলানো দায়। ছবি: প্রতিবেদক।
এবারই প্রথম নববর্ষের প্রাক্কালে ঝাড়গ্রামে উপচে পড়া ভিড়। শুধু রাজবাড়ির রাজকীয় আপ্যায়ণে নয়। বেলপাহাড়ির জঙ্গল ঘেরা বাঁশপাহাড়ি, ঢাঙ্গিকুসুম, কাঁকড়াঝোর, ঘাঘরার হোম স্টে-তেও ভিড়। আসলে এখানকার পর্যটন যেন অন্যরকম। একেবারে মাটির গন্ধ। তার প্রভাব নববর্ষের ভূরিভোজেও। ঢেঁকি ছাটা চালের পান্তা, সঙ্গে নানান বড়া যেমন - আলু-পেঁয়াজ, ডাল, কুমড়ো ফুল। এছাড়া ইলিশ মাছ ভাজার সঙ্গে থাকছে পেঁয়াজ পোস্ত, আলু-পিঁয়াজ, বেগুন, কুদরি ভাজা, তেঁতুল চাটনি। ওই পান্তার ডিশে বাদ যায়নি 'মাছের রাজা' রুই ভাজাও। সঙ্গে ছাঁচি পেঁয়াজ চটকা, পাঁপড়ও। এই থালির দাম মাত্র ২৯৯ টাকা। মিলছে বেলপাহাড়ির ইন্দিরা চকের রেস্তোরাঁয়। বেলপাহাড়ি ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র তথা একটি হোম স্টে-র কর্ণধার বিধান দেবনাথ বলেন, "ঝাড়গ্রামে নববর্ষের পর্যটনে একেবারে মাটির গন্ধ। আর সেই কারণেই এমন ভিড়।"
পান্তা আর ১০ পদে মধ্যাহ্নভোজ। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়িতে। নিজস্ব ছবি।
বাঁকুড়ায় বিষ্ণুপুর, মুকুটমণিপুর, সুতানের জঙ্গল, শুশুনিয়া পাহাড়, বিহারিনাথ পাহাড় যেমন আছে। তেমনই হোম স্টেকে ভর করে গত কয়েক বছরে এই জেলার জঙ্গল ছুঁয়ে অখ্যাত গাঁ-গঞ্জেও গড়ে উঠেছে নানান পর্যটন প্রকল্প। নববর্ষের প্রাক্কালে সেখানেও রীতিমত ভিড়। রানিবাঁধ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে তালবেড়িয়া বাঁধ, ঝিলিমিলি রেঞ্জে থেকে ৭ কিমির মধ্যে সুতান হ্রদ। জঙ্গল ঘেরা ছবির মত ল্যান্ডস্কেপ যেন মন ভালো করার ঠিকানা হয়ে গিয়েছে। এরকমই একটি হোম স্টে বিষ্ণুপুরের শিরোমনিপুরে। যেখানে একেবারে রাজকীয় আপ্যায়ণ। এমনই দাবি ওই হোম স্টে কর্তৃপক্ষ পাপিয়া সাধুখাঁর।
পোস্তর বড়া। পুরুলিয়ার অযোধ্যা হিলটপের পর্যটন প্রকল্পে। ছবি: প্রতিবেদক।
তাঁর কথায়, "নববর্ষে আমাদের ভূরিভোজের আয়োজন রয়েছে। আমপোড়ার শরবত থেকে শুরু করে বাসন্তী পোলাও, মটন কষা, মাছের নানান পদ থাকছে।" সবমিলিয়ে নববর্ষে পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন একেবারে জমজমাট। অনেকটা পুজো এবং পলাশ পার্বণের মতোই।
(তথ্য সহায়তা: টিটুন মল্লিক)