মলয় কুণ্ডু: মাছ নিয়ে এখনকার প্রজন্মের বিস্তর অনুযোগ। কারও মনে হয়, মাছে প্রচণ্ড কাঁটা। কেউ আবার মাছের থেকে বেশি পছন্দ করে চিকেন-মটন। নদী, পুকুরের মাছের থেকে আবার কারও রসনা তৃপ্তি হয় সামুদ্রিক মাছে। কখনও আবার ডাক্তারের বারণ, বড় সাইজের মাছে ফর্মালিনের ঢল। তাই ভরসা শুধুমাত্র ছোট মাছ। কেউ আবার নয়া ট্রেন্ডে 'ভেগান' অর্থাৎ পুরোপুরি নিরামিষাশী। এমন হাজারও কারণে বাঙালি নাকি পিছিয়ে পড়ছে মাছ খাওয়ার দৌড়ে!

কিন্তু বাঙালি তো চিরকালীন থাকে মাছে-ভাতে। এবার তাই বাঙালির মেনুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মাছকে নতুনভাবে পাতে তুলে দিতে অভিনব পদক্ষেপ করল রাজ্য সরকার। মৎস্য দপ্তর সূত্রে খবর, জেন Z-কে মাছের স্বাদ বোঝাতে সমাজমাধ্যমকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেখানে একদিকে বাঙালির মাছ খাওয়ার ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি হরেকরকম মাছ রান্নার কথাও জানানো হচ্ছে। সঙ্গে থাকছে মাছ নিয়ে কবিতা, সাহিত্যের স্মরণীয় সব লাইনও। রাজ্য সরকারের ডিজিটাল মাধ্যম 'এগিয়ে বাংলা'-য় এমন প্রচারের একটা জম্পেশ নামও রয়েছে, 'বাঙালি পাতে মাছে আর ভাতে'।
বাঙালির প্রিয় মাছভাত।
বাঙালির পাতে মাছকে ফের জাতে তুলতে ভুলে যাওয়া ইতিহাস স্মরণে আনা হচ্ছে। পুরুষ ও মহিলা কণ্ঠের কথোপকথনের 'রিল'-এ উঠে এসেছে হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন মাছ খাওয়ার কথা। সতেরোশো বছর পুরনো সেই মৎস্য ইতিহাস বলছে, চন্দ্রকেতুগড়ে সেই সময়ের পাওয়া পুরনো ফলকে মিলেছে মাছের ছবি। ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাচীন কাব্যেও মাছের ছড়াছড়ি। মঙ্গলকাব্য, যেমন অন্নদামঙ্গল বা চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার রান্না। কিন্তু সেই রান্না এখন আর হয় না বুঝি? হয় তো বটেই। এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মাছ রান্নার নানা ধরন। ধরা যাক ইলিশ মাছ। এপার বাংলায় কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে পাতলা ঝোল খাওয়ার চল বেশি। কিন্তু ওপার বাংলায় ইলিশ রান্না হয় ঘি আর পিঁয়াজ দিয়ে! আবার সুন্দরবনের গ্রামের লোকজন মাছ ভাজেন না বলে জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, কাঁচা মাছটাই ঝোলে দিয়ে ফুটিয়ে খান। সেই ঝোলের নাকি স্বাদও অনন্য। দুই বাংলার ছাড়াও আরও এক মতে মাছ রান্না করা হয়। যাকে বলে বারেন্দ্র মত। এ মতের মাছের ঝোলে পাঁচফোড়ন পড়ে। স্বাদ ও গন্ধে তা নাকি একেবারেই আলাদা। বারেন্দ্রিদের মাছের শুক্তোও রান্নার কথাও উঠে এসেছে।
মৎস্যমন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী বলছেন, "মাছে আর ভাতে বাঙালি, এই কথাটার মধ্যেই বাঙালির চরিত্র লুকিয়ে রয়েছে। মাছের ঝোল আর ভাত হলে বাঙালি আর কিছু চায় না। এখন আধুনিককালের ছেলেমেয়েরাও কিছু কিছু নতুন জিনিস চাইছে বটে, কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা অনেক কম।" তা হলে বাঙালির মাছ-ভাত স্বমহিমায় রয়েছে? বিপ্লববাবুর স্পষ্ট ব্যাখ্যা, "শুধু কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই দেখলে হবে না। গোটা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলা দেখতে হবে। রাজ্যে যে সাড়ে ১০ কোটি, ১১ কোটি লোক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ লোকই হচ্ছে মাছে ভাতে বাঙালি। তাঁদের মাছের ঝোল ভাত হলে আর কিছু লাগে না। সেটাই বাঙালির কাছে আমরা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।" এখন রাজ্যে অনেক বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান মৎস্যমন্ত্রী।
গরম ভাতে ইলিশভাজার লোভনীয় পদ।
মাছ তো শুধু ভোজনরসিকদেরই একমাত্র নয়। 'পেটরোগা' বাঙালির যে মাছ একরকম পথ্যও। সেই কথাও জানাচ্ছে 'বাঙালি পাতে মাছে আর ভাতে' প্রচার। জিওল মাছ, শিঙি মাছ কিংবা মাগুর মাছের ঝোল আমবাঙালির কাছে তো শরীর খারাপের ঘরোয়া ওষুধ। সেই যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত চরিত্র পটলডাঙার টেনিদা। তাঁর শাগরেদ প্যালারাম, যে কেবলই ভোগে। সে তো সারা জীবন এই পথ্যের ঝোল খেয়েই বেঁচে থাকল। প্যালারামের পেটের ব্যারামে মাছ থেকে বাংলা সাহিত্যের মাছের উল্লেখও তুলে ধরা হয়েছে। ভোজনরসিক বাঙালির সাহিত্যে মাছের দেখা মিলেছে।
মাছের পাতলা ঝোল।
বিজয় গুপ্তর লেখায় তিনি রুই, চিতল ও কই মাছের উল্লেখ করেছেন। 'ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল/কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল'। তাঁর আরও একটি লেখায় চিংড়ির মাথার পদের কথা উল্লেখ করেছেন, 'ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জড়ায়ে সুতা/তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা'। বাঙালির মাছের প্রতি ভালোবাসায় বৃষ্টির নামকরণও বাদ নেই। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'ইলশেগুঁড়ি' কবিতায় রয়েছে, 'হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায় ইলশে গুঁড়ির নাচ/ইলশে গুঁড়ির নাচন দেখে নাচছে ইলিশ মাছ'।