বিশ্বকাপ নিয়ে রাশিয়া থেকে কলম ধরলেন সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস
দিদিয়ের দেশঁকে আপাত দৃষ্টিতে বেশ রাগী বলে মনে হয়। মুখচোখে ফরাসি লালিত্যের লেশমাত্র নেই। দৃঢ় চোয়াল, কঠিন চোখ, দৃপ্ত শরীরীভাষা-সব মিলিয়ে ঠিক অঙ্কের কড়া প্রফেসর যেন। ভুল করে কোচিং লাইনে চলে এসেছেন!
মঙ্গলবার রাতে সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে দিদিয়ের দেশঁ টু’কে দেখা গেল! ফ্রান্স তৃতীয় বার বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠামাত্র যিনি কোচের রাশভারী স্যুট সযত্নে নামিয়ে রেখে, সমর্থকের জার্সি পরে ফেললেন। ম্যাচ শেষে মাঠে দিদিয়ের দেশঁ নাচছেন, প্লেয়ারের কোলে উঠে পড়ছেন-এ তো ভাবাই যায় না! খেলা তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। রেফারির হুইসল বাজার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, মাঠের ভেতরে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে দৌড়তে শুরু করল ফ্রান্স রিজার্ভ বেঞ্চ। কিন্তু তিনি, দেশঁ হাঁটতে শুরু করলেন টিমের সাপোর্ট স্টাফদের জটলাটার দিকে। যাঁরা তখন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফ্রান্স কোচ সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র নাচ শুরু হয়ে গেল। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। শুরু হয়ে গেল গান। গ্যালারি নামক নীল সমুদ্রর সঙ্গে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে। ‘আলে ল্যে ব্লু, আলে ল্যে ব্লু!’
[রাশিয়া বিশ্বকাপে ঢুকে পড়ল ইস্টবেঙ্গল, লাল-হলুদে সই তারকা ডিফেন্ডারের]
ফ্রান্স কোচকে নিয়ে একটা কথা খুব বলা হয়। বলা হয়, দিদিয়ের দেশঁ অত্যন্ত গর্বিত এক ফরাসি। তাই গলা ছেড়ে গান, ফাইনালে ওঠার আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচ, তবু ঠিক আছে। কিন্তু তারপর যেটা ঘটল? বেলজিয়াম কোচ রবার্তো মার্টিনেজের সঙ্গে হাত মেলানো শেষে? সাইডলাইন থেকে মাঠ। এবং মাঠে ঢুকে সোজা স্যামুয়েল উমতিতির দিকে দৌড় এবং প্রায় কোলে! দেখলে সময় সময় বেশ অদ্ভুতই লাগে। অদ্ভুত লাগে ইতিহাসের ফিরে আসা দেখলে। কুড়ি বছর আগে অধিনায়ক দেশঁ যে বার বিশ্বকাপ জিতেছিলেন, গোটা ফ্রান্স তখন তাঁকে, তাঁর টিমের জন্য শ্রদ্ধা, ভালবাসার বরণডালা নিয়ে মোটেও দাঁড়িয়ে ছিল না। ফ্রান্সের তৎকালীন ডানপন্থী পার্টির নেতা জাঁ মারি লে পেন পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, এটা কোনও ভাবেই ফ্রান্সের বিশ্বজয় নয়। দেঁশর টিমে ক’জনের ধমনীতে ফরাসি রক্ত বইছে? ক’জন জন্মসূত্রে ফরাসি? পুরোটাই তো ‘রেনবো’ টিম। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, মিশ্রণে ভরা। তাহলে ফ্রান্সের জয় কোথায় হল?
বছর বদলায়। সময় এগোয়। কিন্তু ইতিহাস ঠিক ফিরে আসে। দেঁশ সেন্ট পিটার্সবার্গের মায়াবী রাতে যে উমতিতির দিকে জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছিলেন, তিনিও বা ফরাসি কোথায়? উমতিতি আসলে রজার মিল্লা, স্যামুয়েল এটোর দেশের। ক্যামেরুনের। উমতিতির বয়স যখন মাত্র দুই, তখন তাঁর পরিবার ক্যামেরুন ছেড়ে ফ্রান্সে চলে না এলে দেশঁর টিম রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠত কি? কে জানে!
ইতিহাসের এভাবে প্রত্যাবর্তন যেমন আশ্চর্যের, তেমনই অবাক করা কাপ সেমিফাইনালে সমর্থনের মন-মেজাজ। সেন্ট পিটার্সবার্গের ফ্রান্স বনাম বেলজিয়াম নামেই সেমিফাইনাল যুদ্ধ ছিল। ম্যাচের গুণাবলী বিচারে, ফুটবলারদের মান বিচারে, সংঘর্ষের উত্তাপ বিচারে, সেমিফাইনাল নয়, ফাইনালই ছিল। কিন্তু গ্যালারি দেখে সেটা কে বলবে? টিভিতে দেখে হয়তো বোঝা যায়নি। কিন্তু মাঠ মোটেও পুরো ভরতি এদিন ছিল না। বেশ কিছুটা অংশ ফাঁকা ছিল।
[দেশের জয়ে বন্য সেলিব্রেশন ফরাসি ফুটবলপ্রেমীদের, পদপিষ্ট হয়ে আহত ৩০]
আসলে গন্ডগোলটা নাকি হয়েছে ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়ে। ফ্রান্সের সঙ্গে বেলজিয়াম নয়, ব্রাজিলই বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলবে ধরে নিয়ে সাম্বা সমর্থকদের একটা বড় অংশ সেন্ট পিটার্সবার্গে নাকি টিকিট বুক করে রেখেছিল। কিন্তু নেইমাররা বিশ্বকাপ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালেই ছিটকে যান, সেন্ট পিটার্সবার্গ সেমিফাইনাল খেলতে আসার কোনও প্রশ্নও তাই আর পড়ে ছিল না। সমর্থকদের ওই বৃহৎ অংশটাও নাকি তারপর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
মজার হচ্ছে, ব্রাজিল সমর্থকরা যদি মাঠের একটা অংশ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ফাঁকা থাকার কারণ হন, তাহলে ব্রাজিল সমর্থকরাই মঙ্গলবার দেশঁর জয়ে নতুন রং যোগ করে দিয়ে গেলেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও স্টেডিয়ামের এক কোণায় দেখা গেল উৎসব চলছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওঁদের কারও গায়ে ফ্রান্সের নীল জার্সি নেই! কী আশ্চর্য, ওঁরা সবাই যে ব্রাজিলের জার্সি পরে! ব্রাজিলের হলুদ পতাকা জড়িয়ে! যাঁরা তীব্রভাবে পতাকা নাড়িয়ে, নেচেকুঁদে মাঝরাত পর্যন্ত ফ্রান্স জয়ের উৎসব করছেন। আর সেই উৎসব অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন কারা? না, ফরাসি সমর্থকরা! আর কেন ব্রাজিল সমর্থকদের ওই উৎসব, বেলজিয়াম কোয়ার্টার ফাইনালের পর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।কোচ দেশঁ বিশ্বকাপ জিতবেন কি না, সময় বলবে। জিতলেও গোটা দেশ, দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক পার্টি তাঁর ও তাঁর টিমের জন্য উষ্ণতা নিয়ে এয়ারপোর্ট আসবে কি না, সেটাও সময় বলবে। কিন্তু ফ্রান্সের জয়ে উৎসব করছে ব্রাজিল, এর চেয়ে বড় বরণডালা দেশঁ আর কোথায় পাবেন?
The post সেন্ট পিটার্সবার্গে ফরাসি বিপ্লবে মিশে গেল ব্রাজিলও appeared first on Sangbad Pratidin.