প্রকৃতির আকস্মিক খামখেয়াল ও ঝড়-জলের যুগলবন্দিতে দিল্লি এয়ারপোর্টের এক নম্বর টার্মিনালের ক্যানোপি-খিলানের একাংশ পড়ল ভেঙে। এদিকে ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পে হিমালয়ের বুক ফুঁড়ে তৈরি হচ্ছে ৬৬টি টানেল। প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যেই বলি ৬৯০ হেক্টর বনাঞ্চল, যা পরিবেশ থেকে ৮৪ হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পারত। সরকার যথারীতি নিশ্চুপ। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত শুক্রবার, ২৮ জুনের সকালে, ঠিক করলাম এই সপ্তাহে আর দলীয় রাজনীতির কচকচানি নয়। অনেক হয়েছে রাজনীতির নষ্টামি, ভণ্ডামি, ধার্ষ্টামি। এবার একটু অন্য কথা লিখি। যদিও আজকাল লিখেটিখে আদৌ কিছু হয় কি না সন্দেহ। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্য কারণ সেদিন শেষ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত অঝোর বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। ঝড়-জলের সেই যুগলবন্দিতে দিল্লি এয়ারপোর্টের এক নম্বর টার্মিনালে ঢোকার মুখের পেল্লাই বাহারি ‘ক্যানোপি’ বা ছাদ ও তার খিলানগুলির একাংশ মড়মড় করে ভেঙে পড়ে। তাতে চাপা পড়ে যাত্রী ছাড়তে আসা কয়েকটা গাড়ি। এক ট্যাক্সিচালক আসনে বসে থাকা অবস্থায় মারা যান। আহত হন ছ’-সাতজন। নিরাপত্তার দরুন সেই টার্মিনাল ও সেখানকার সব উড়ান বন্ধ করে দিতে হয়।
দিল্লির যেখানে আমি থাকি, এয়ারপোর্ট-নিকটবর্তী সেই তল্লাটের ঘুম ভাঙে ও ঘুম আসে বিমান ওঠা-নামার শব্দে। ২৮ জুন সকালে প্লেনের শব্দ ছিল না। বরং ছিল বৃষ্টির ঝমঝমানি ও প্রশান্তি। ক্রমেই জানা গেল গোটা দিল্লি প্রায় জলমগ্ন। জনপথ জলপথের রূপ নিয়েছে। অভিজাত এলাকাতেও বাড়ির একতলা জলে থইথই। জলে ডুবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অগুনতি আন্ডারপাস। হাজার হাজার গাড়ি জলমগ্ন। পরিচিতজনরা একে অন্যকে সজাগ করছে, প্রয়োজন না হলে বাড়ি থেকে বেরনোর দরকার নেই। বেরলেও গাড়ি নয়, মেট্রো।
[আরও পড়ুন: রেলগেট খোলা অথচ সিগন্যাল সবুজ, বরাতজোরে দুর্ঘটনা এড়াল কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস]
৪০ বছর দিল্লিতে আছি, প্রকৃতির এমন রোষ ও রাজধানীর এমন বিপর্যস্ত হাল কখনও দেখিনি। সেই সকালেই হাওয়া অফিস জানাল, সারা বছর দিল্লিতে বৃষ্টি হয় কম-বেশি ৮০০ মিলিমিটার। তার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ওদিন রাত ২.৩০টে থেকে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে ঝরেছে। ২২৮ মিলিমিটার! প্রথম তিন ঘণ্টায় ১৫০ মিমি! সরকার বোঝানোর চেষ্টা করল, এত অল্প সময়ে এত বৃষ্টি হলে জনজীবন অচল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাদের কোনও দোষ নেই।
এই অস্বাভাবিকতা, প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনাই ইদানীং কালের নিয়ম। শুধু দিল্লি নয়, ভারত নয়, সারা পৃথিবীতে। দিল্লিতে এবার টানা ৪০ দিন ধরে প্রবল দাবদাহ চলেছে। ৭৮ বছরে এমন অসহনীয় গরম পড়েনি। রাজধানীর তাপমাত্রা এই প্রথম ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরল। তাপমান যখন ৪৮ ও ৫০- এর মধ্যে পায়চারি করছে, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশের বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পটগুলিতেও তখন ৩২-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ছোবল! ইউরোপ-আমেরিকাতেও অস্বস্তি মাত্রাছাড়া। ১০-১৫ বছর আগেও সাগর হয়ে এত ঘূর্ণাবর্ত এভাবে আছড়াত না। প্রকৃতি কেন এত বিরূপ, সেই কারণ প্রত্যেকের জানা। জানা পরিত্রাণের উপায়ও। অথচ কারও কোনও হেলদোল নেই। রাম দুষছে শ্যামকে, শ্যাম যদুকে, যদু তাকায় মধুর দিকে, মধু উদাসীন ও নির্বিকার। এই চক্রবৎ কাহিনি ও নিষ্ক্রিয়তা প্রকৃতিকে বেপরোয়া করে তুলছে।
অথচ ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’, ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’ কিংবা ‘জলবায়ু সংকট’ শব্দগুলো শিশুমন থেকে বাড়ির হেঁশেলেও ছড়িয়ে গিয়েছে। সব দেশের সব সরকার ফি-বছর এ নিয়ে সম্মেলনে বসে। কিন্তু হাল শোধরায় না। এ যেন ঠিক সেই তালপুকুরে দুধ ফেলার গল্পের মতো। এভাবেও ফেলবে, ওভাবেও। অথচ কেউ-ই নাকি ফেলে না!
[আরও পড়ুন: মর্গে লাশের পাহাড়, হাথরাসে মৃত্যুমিছিল দেখে অসুস্থ পুলিশকর্মী, ২০ মিনিট পর মৃত্যু!]
দিল্লির বিপর্যয় যেদিন ঘটল, ঠিক তার আগের দিন, ২৭ জুন, মার্কিন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সংগঠন ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধু জুন মাসে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ৬১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ জ্বলেপুড়ে অস্থির হয়েছে। সারা পৃথিবীতে এমন বিপন্ন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০০ কোটি। রিপোর্ট অনুযায়ী, নিরবচ্ছিন্ন এই তাপপ্রবাহের ফলে ভারতেই মারা গিয়েছে ১০০ জনেরও বেশি। ৪০ হাজার জন আক্রান্ত হয়েছে হিটস্ট্রোকে।
এমন নয় যে, এই ধরনের রিপোর্ট এই প্রথম বেরল। এমন রিপোর্ট অহরহ জনতাকে সতর্ক ও সজাগ করে চলেছে। আমাদের দেশের পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরাও বিভিন্ন দরজায় মাথা কুটছে। সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। পরিবেশ রক্ষায় আইন হচ্ছে, অথচ সেই আইনকে কঁাচকলা দেখিয়ে নির্বিচারে চলছে পরিবেশ নিধনযজ্ঞ। ‘বজ্র অঁাটুনি ফসকা গেরো’-র এর চেয়ে উত্তম উদাহরণ নেই। লেটেস্ট নমুনা– পরিবেশ রক্ষায় লাদাখের জনতার অনশন আন্দোলন। কিন্তু সে নিয়ে একবারও সরকারি মতামত শোনা গেল না। রাজনীতিকরা স্বার্থের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রের টানাপোড়েন অব্যাহত। সর্পাঘাত হচ্ছে শিরে।
সেদিন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী, যঁার সঙ্গে ভগবানের ডিরেক্ট কনট্যাক্ট আছে, তিনি কেন ঈশ্বরের মন বুঝতে পারেন না? কিংবা ঈশ্বরই বা কেন তঁাকে বললেন না, ‘ওহে, ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমার দর্শনের জন্য চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পের দরকার নেই। হিতে বিপরীত হবে!’ এই প্রকল্পের মধ্যেই রয়েছে ১২৫ কিলোমিটার রেলপথ, যেখানে হিমালয়ের বুক ফুঁড়ে ৬৬টি টানেল তৈরি হবে। সর্বনাশের মাথায় বাড়ি মেরেছে এই একটা প্রকল্পই।
[আরও পড়ুন: খুনের মামলায় বিচারপতিদের ভিন্ন মত, জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চের মামলা গেল প্রধান বিচারপতির কাছে]
অথচ সেই তথ্য সরকারকে বিস্তারে জানিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির চেয়ারম্যান পরিবেশবিদ রবি চোপড়া। তঁার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্প শুরুর আগেই ধ্বংস করা হয়েছে ৬৯০ হেক্টর বনাঞ্চল যা পরিবেশ থেকে ৮৪ হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পারত। সরকার কানে তোলেনি। তারা তখন হিন্দুত্বে বাতাস দিয়ে ভোটবাক্স ভরানোর ছক কষছিল। ক্ষোভে দুঃখে রবি চোপড়া কমিটির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন।
প্রকৃতি কিছু ভোলে না, কাউকে ক্ষমাও করে না। বরং সুদে-আসলে শোধ তোলে। সেই সর্বনাশ
যে শুধু গাছপালা, বনবাদাড় ধ্বংস হলেই হয় তা নয়, কীটপতঙ্গ ও প্রাণী সম্পদ উজাড় করলেও সর্বনাশ ঘনায়। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হুজুগের কথা একটু বলি। কিছু দিন ধরে সে-দেশে চন্দ্রবোড়া সাপ বা ‘রাসেল্স ভাইপার’ মারার ধুম পড়েছে। দু’-একটা জেলায় এই সাপের কামড়ে কয়েক জনের মৃত্যু হওয়ার পর রটে যায়, এর কোনও চিকিৎসাই নাকি নেই। মৃত্যু অবধারিত। এর ফলে খ্যাপার পরশপাথর খোঁজার মতো সারা দেশে ছেলে-বুড়ো বেরিয়ে পড়েছে সাপ মারতে। চাষি খেতে যেতে ভয় পাচ্ছে। বাচ্চারা মাঠেঘাটে। ফরিদপুরে শাসক দলের এক নেতা প্রকাশ্যে
ঘোষণা করেছেন, একটি রাসেল্স ভাইপার মারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার। সরকার অভয় দিচ্ছে। প্রাণী বিশেষজ্ঞরাও বলছে পর্যাপ্ত প্রতিষেধক আছে। কিন্তু নির্বিচারে চলছে সাপ নিধন। অথচ, রাসেল্স ভাইপার সংরক্ষিত প্রাণী। সেটি ধরা, পোষা বা মারা দণ্ডনীয় অপরাধ।
একইরকম ভয়ংকর নদীগর্ভ থেকে অবাধে বালি, পাথর তোলা। বনবাদাড় উজাড় করা। অযথা পানীয় জলের অপচয়। প্লাস্টিকের ব্যবহার। যথেচ্ছাচারের দরুন ২১ শতকের শেষে দক্ষিণ এশিয়ার তাপমাত্রা প্রায় দুই ডিগ্রি বেড়ে যাবে। বদলে যাবে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার সময় ও সংজ্ঞা। চাষাবাদের নিয়ম-রীতি। যখন-তখন প্রলয় ঘটবে।
পশ্চিমবঙ্গে কত নদী হারিয়ে গিয়েছে কেউ জানে কি? বাংলাদেশের কিন্তু জানা। ছয়ের দশকে সেই দেশে কম-বেশি ৭০০ নদী প্রবাহিত ছিল। এখন সরকারি হিসাবে ৪০৫। মুক্তিযুদ্ধের সময় সচল নৌপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। এখন ছয় হাজার কিলোমিটার। নদী হারালে জীবনে অসহায়তা ছাড়া আর কী-ই বা অবশিষ্ট থাকে?
[আরও পড়ুন: গরহাজির ২ অভিযুক্ত, আজও চার্জ গঠন হল না কয়লা পাচার মামলার]
আপনি-আমি সত্যি অসহায়। কিন্তু আমরাও কাঠবিড়ালীর ভূমিকায় নামতে পারি। গাছ কাটা
বন্ধ করে, গাছ লাগিয়ে, জলের অপচয় রুখে, প্লাস্টিক ব্যবহার না করে, সচেতন জনপ্রতিনিধিকে বাছার মধ্য দিয়ে। প্রকৃতি কখনও বলে-কয়ে
শোধ নেয় না।