এবারের লোকসভা ভোটে অর্থনীতির গুরুত্ব কিছুটা বেশি। ২০২৪-এর অর্থনীতি কেমন যেতে পারে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। ভোটের আগে সরকারের তরফে কিছু খয়রাতি ঘোষণা করে মানুষের মন জেতার চেষ্টা হবে। কিন্তু খয়রাতি দিয়ে স্থায়ী ভবিষ্যৎ নির্মাণের সম্ভাবনা নেই। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
২০২৪ ভোটের বছর। লোকসভা ভোট এপ্রিল-মে মাস নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে। ফলে বছরের বড় একটা অংশই ভোট নিয়ে কাটবে। ভোটের বছর বলে অর্থনীতির দিকে এবার বাড়তি নজর। লোকসভা ভোটে অন্য আর যে ইস্যুই থাক না কেন, অর্থনীতি কখনওই উপেক্ষিত হয় না। এবারের লোকসভা ভোটে অর্থনীতির গুরুত্ব কিছুটা বেশি। গত লোকসভা ভোট থেকে এবারের ভোট, মধ্যবর্তী পাঁচ বছরে আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে কোভিড মহামারী এবং লকডাউন। এই সময়কালে দুটো বড় বড় যুদ্ধ দেখছে বিশ্ব। মহামারী ও যুদ্ধের বিপুল প্রভাব পড়েছে বিশ্বের অর্থনীতিতে (World Economy)। বস্তুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বড় বড় ধাক্কা কখনও আসেনি। এই ধাক্কা ভারতের অর্থনীতিতে এসেও আছড়ে পড়েছে। তাই লোকসভা ভোটে এবার অর্থনীতিকে ইস্যু হিসাবে সামান্যতম অবহেলা করার সুযোগ নেই।
২০২৪-এর অর্থনীতি কেমন যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ভারতের পক্ষে সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হল, ২০২৪-এও ‘এল নিনো’-র প্রভাবে মার খেতে পারে কৃষিক্ষেত্র। জলবায়ু নিয়ে সাম্প্রতিক পূর্বাভাস বলছে, ভারতে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত এল নিনোর প্রভাব থাকবে। এল নিনোর জেরে কী হতে পারে, তা ২০২৩-এ স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে। বর্ষায় দেশে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে। ২০২৩-এ যেভাবে কৃষি উৎপাদন মার খেয়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে ঘটেনি। ধান ও গম, দু’টি প্রধান খাদ্যশস্যর উৎপাদনই দেশে কমেছে। এবারও রবিশস্য চাষে তথ্য যতটুকু মিলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ধান ও গম দুটো উৎপাদনই অনেক কম হতে চলেছে। বৃষ্টিপাতের অভাবে বহু অঞ্চলেই ধানের চারা রোপণ করা যায়নি। জমিতে জল না দাঁড়ালে ধানের চারা রোপণ করা যায় না। গম চাষের জন্য লাগে আর্দ্র আবহাওয়া। এল নিনো বাতাসে শুষ্কতা বাড়িয়েছে। কৃষি উৎপাদন কম হওয়ার কারণে ২০২৩ জুড়ে খাদ্যপণ্যর ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এই মূল্যবৃদ্ধির নাগপাশ থেকে অর্থনীতিকে অদূরভবিষ্যতে মুক্ত করার সম্ভাবনা নেই।
[আরও পড়ুন: তামিলনাড়ুতে ২০ হাজার কোটির প্রকল্পের সূচনায় মোদি, পদ্মের জন্য খুলবে দক্ষিণের দ্বার?]
বৃষ্টির অভাবে কৃষি উৎপাদন কমায় এবং মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় গ্রামাঞ্চলে কৃষকের আয় কমেছে। ২০২৩ সালে সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়েছে ভোগ্যপণ্যর গ্রামীণ বাজার। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রয়েছে এবারও। ভোগ্যপণ্যর গ্রামীণ বাজার মার খেলে তার প্রভাব উৎপাদন শিল্পেও এসে পড়ে। ২০২৩-এর মতো ২০২৪-এ তাই কৃষির সঙ্গে শিল্পেও মার খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোভিডের পর ২০২৩-এ ভারতের অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দঁাড়িয়েছিল। ২০২৩ জুড়ে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার সাত শতাংশের উপরেই ছিল। কিন্তু এখনও অবধি যা পূর্বাভাস, তাতে ২০২৪-এ আর্থিক বৃদ্ধির হার সাত শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে।
কোভিডের পর থেকে বিশ্বজুড়ে মূল্যবৃদ্ধি চলছে। ২০২২-এ মূল্যবৃদ্ধির হার একটা সর্বোচ্চ বিন্দুতে চলে গিয়েছিল। ২০২২-এর নভেম্বরে ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলে। ২০২৩-এ উন্নত দেশগুলিতে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় ২০২৩-এর শেষের দিকে মূল্যবৃদ্ধির হার তিন শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। িকন্তু ভারতে এখনও মূল্যবৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি রয়েছে। গত জুলাই মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৪ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। এখন কিছুটা কমে ছয় শতাংশের কাছাকাছি হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি যে ২০২৪-এ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। কারণ, কৃষি উৎপাদন মার খেলে মূল্যবৃদ্ধির চাপ থাকবেই। আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে মূলত খাদ্যপণ্যর দাম বাড়ার ফলেই।
একদিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার কম এবং অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির চাপ, ২০২৪-এর অর্থনীতি সম্পর্কে এই দু’টি পূর্বাভাসই নরেন্দ্র মোদিকে যথেষ্ট চিন্তায় রাখবে। আর্থিক বৃদ্ধির হার না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ থাকবে না। অন্যদিকে, মূল্যবৃদ্ধি দেশবাসীর প্রকৃত অায় কমাবে। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সবসময়ই ভোটের ফলে প্রত্যক্ষ করা যায়। কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়াও ভোটে নিশ্চিতভাবে ইসু্য হবে। মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ঘাটতির দিক থেকে নজর ঘোরাতেই বিজেপি রামমন্দির উদ্বোধনের উপর এত গুরুত্ব দিচ্ছে। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি রাজে্য জয় পেয়েছে বিজেপি। এর মধে্য মধ্যপ্রদেশের জয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল বিজেপির কাছে। তিন রাজে্যর জয়ের পিছনে নির্দিষ্ট করে কোনও একটি কারণ কাজ করেনি। অনেকগুলি বিষয়ের উপর দঁাড়িয়ে ফলাফলের বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: অন্ধ্রে নতুন অঙ্ক! কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী জগনের বোন?]
তিন রাজে্যর জয় বিজেপির পক্ষে লোকসভা ভোটের আগে এক অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করেছে। এই বাতাবরণ বজায় থাকতে থাকতেই বিজেপি লোকসভা ভোট সেরে নিতে চায়। সে কারণে এবার লোকসভা ভোট দু’-একমাস এগিয়ে এলেও িবস্মিত হওয়ার কিছু নেই। অর্থনীতি সম্পর্কে নানারকম পূর্বাভাস বিজেপির ভোট এগিয়ে আনার তাগিদ নিশ্চিত করেই বৃদ্ধি করছে। ২০২৪ যত এগবে, তত অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবগুলি সামনে অাসতে পারে। প্রচুর বেসরকারি লগ্নি এসে দ্রুত পরিস্থিতি বদলে দেবে এমন অাশা স্বয়ং মোদিও করেন না।
আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতির হাল কী থাকবে, তার উপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল ভারতের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতির যে পূর্বাভাস দিচ্ছে, সেখানে বলা হচ্ছে ২০২৪-এ বিশ্বে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং কিছুটা হলেও অার্থিক বৃদ্ধির হার কমবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ইউরোপে আর্থিক মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার বাড়িয়েছে। সুদের হার বৃদ্ধির জের অর্থনীতিতে এসে পড়তে শুরু করেছে। লগ্নি কমেছে। উন্নত দেশগুলিতে আর্থিক মন্দা দেখা দিলে ভারতের পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। এমনকী, পরিষেবা রফতানিও কমতে পারে। পণ্য ও পরিষেবা রফতানি কমলে ভারতের অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই ধাক্কা খাবে।
[আরও পড়ুন: প্রতীক্ষার অবসান, রামমন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে এই শিল্পীর রামলালার, জানাল ট্রাস্ট]
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়িয়েছে। বাণিজি্যক ব্যাঙ্কগুলি জনগণকে বেশি সুদ দিচ্ছে। সুদ বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি লগ্নি কমে। তাতে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খায়। কিন্তু এখনও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় সুদ কমার খুব একটা লক্ষণ নেই। সুদের হার একটা উচ্চতায় তুলে রেখে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটানো একটা কঠিন কাজ। ২০২৪ সালে দেশের অর্থনীতির সামনে এটাও একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। যেহেতু ভোটের বছর, তাই বছরের গোড়ার দিকে সরকারি মূলধনী লগ্নি বাড়ার সম্ভাবনা কম। আর্থিক বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিকে পুরোটাই নির্ভর করতে হবে বেসরকারি লগ্নির বৃদ্ধির দিকে। কিন্তু সেটা এই মুহূর্তে ঘটছে না। বিশ্বজুড়ে আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে নরেন্দ্র মোদির আমলে গত দশ বছরে দেশে বেসরকারি লগ্নি বাড়েনি। সেরকম বড় কোনও নয়া প্রকল্পও দেখা যায়নি। যার জের কর্মসংস্থানে করুণ দশা।
বছর ভাল যাবে বললে মানুষ মূলত তার আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির কথাই বোঝে। ২০২৪ সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যা পূর্বাভাস, তাতে আগামী বছরে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভাল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। শুধু শেয়ার বাজারের চাঙ্গা ভাব দিয়ে সার্বিক অর্থনীতি ভাল বলা যায় না। শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে ক’জনেরই বা লগ্নি রয়েছে! কৃষি উৎপাদন মার খাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তাতে গ্রামীণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ নেই। খাদ্যপণ্য-সহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যর মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং মানুষ অারও গরিব হবে। শিল্পেও তেমন কোনও আশার আলো নেই। গ্রামাঞ্চলে ভোগ্যপণ্যর চাহিদা কমার প্রবণতা চলতে থাকলে কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির আশা আরও থাকবে না। ভোটের আগে সরকারের তরফে কিছু খয়রাতি ঘোষণা করে মানুষের মন জেতার চেষ্টা হবে। কিন্তু খয়রাতি দিয়ে স্থায়ী ভবিষ্যৎ নির্মাণের সম্ভাবনা নেই। অার্থিক সংকট কাটার ক্ষেত্রে এখনও কোনও আশার আলো দেখাতে পারছে না ২০২৪।