ঘেমে যাচ্ছেন! মহিলাদের এই অস্বস্তি সবসময় স্বাভাবিক নয়। হরমোনের ওঠা-নামা জানান দেয় ঘামের আধিক্য। সাবধান করলেন এইচ পি ঘোষ হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডা. দেবারতি ভড়।
মহিলার বয়স সবে ৫০ পেরিয়েছে, হঠাৎ করেই দেখছেন যখন-তখন ভীষণ ঘাম হচ্ছে। এতটাই ঘর্মাক্ত হয়ে যাচ্ছেন যে পুরো জামা নিমেষে ভিজে চুপচুপে। আমার কাছে এসে অভিযোগ, "প্রচুর ঘাম হচ্ছে, ২-৩ মিনিট হাওয়ায় না থাকলেই জামা-কাপড় পুরো ভিজে যাচ্ছে, এটা একেবারেই স্বাভাবিক গরমকালের ঘাম হওয়া নয়। আর এমনিতেই আগে এক ঘাম হতও না, হঠাৎ করেই মাসখানেক এই লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছ। কেন হচ্ছে বলুন তো?"--- এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। যেহেতু ঘাম হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার তাই অনেকেই বিষয়টা সেই ভাবে গুরুত্ব দেন না। বিশেষত হরমোনাল সমস্যা বা হরমোনের অসামঞ্জস্যের কারণে এই লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেনোপজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
ছবি: সংগৃহীত
কেন হয়?
মহিলাদের বয়সকালে অত্যধিক ঘাম হওয়াকে ডাক্তারি পরিভাষায় হট ফ্লাশ বলা হয়। এর প্রধান কারণ হল ইস্ট্রোজেন হরমোনের রাশ, এফএসএইচ হরমোনের বৃদ্ধি, আর কিছু নিউরোট্রান্সমিটার যেমন নিউরোকাইনিন বি-এর প্রাদুর্ভাব। এই নিউরোট্রান্সমিটার মস্তিষ্কের ভেসোমোটর সেন্টারে গিয়ে (যেখানে তাপ নিয়ন্ত্রক বা শরীরের তাপমাত্রা কন্ট্রোল হয়) সেন্টারটিকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে। এর প্রভাবে চামড়ার নিচে অবস্থানকারী শিরা-উপশিরাগুলির ভাসোডিলেশন শুরু হয়। অর্থাৎ শিরাগুলি আরও প্রশস্ত হয়ে যায় ও অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহিত হওয়ার কারণে গরম লাগতে থাকে, অতিরিক্ত ঘাম হতে থাকে।
নানা পরিবর্তন
এই সময় শরীরে হরমোনাল নানা পরিবর্তন ঘটে। এফএসএইচ এবং এলএইচ-এই হরমোনগুলি অত্যধিক মাত্রায় বেড়ে যায়, এস্ট্রাডিওলের অত্যধিক মাত্রায় কমে যায় ও টেস্টোস্টেরনের কিছু আধিক্য, বা টেস্টোস্টেরন (পুরুষ হরমোন) এবং ইস্ট্রোজেন (মহিলা হরমোন) হরমোনের স্বাভাবিক অনুপাতের তারতম্য ঘটে। যে কারণে এই বয়সে অনেক মেয়েদের গোঁফ ও হালকা দাড়ি বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া মহিলাদের হরমোন বা ইস্ট্রোজেন রাশ অনেক যাওয়ার কারণে হাড়ও অত্যন্ত দুর্বল, ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করা খুব দরকার। না হলে হঠাৎ করে হাড় ভাঙা থেকে অন্যান্য অস্বস্তিগুলি প্রকট হতে শুরু করে।
ছবি: সংগৃহীত
কী হলে সাবধান হবেন?
গাছের যেমন পাতা ঝরে যায়, ফলন কমতে থাকে তেমনই মহিলাদেরও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে আসে নানা পরিবর্তন। স্বাভাবিক নিয়মে বয়স বাড়লে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ১২ মাস পর যদি আর ফিরে না আসে তখনই ডাক্তাররা একজনের মেনোপজ হয়ে গিয়েছে বলে গণ্য করেন। এটি স্বাভাবিকভাবে মহিলাদের ৫০-৫২ বছর বয়সে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই বয়সের আগেই অনেকের মেনোপজ হয়ে যায়। বিশেষত কিছু ওষুধ খাওয়ার কারণে, কেমো বা রেডিওথেরাপি চললে, জরায়ু ও দু’দিকের ডিম্বাশয় বাদ দেওয়ার অপারেশন যদি কারও করা হয় - সে সব ক্ষেত্রে সময়ের আগেই মেনোপজ হতে পারে। অনেক সময় মেনোপজের বয়স দেশ ও গোষ্ঠীর ভিত্তিতে আলাদা হতে পারে। কিন্তু ৪০ বছর বয়সের আগে যদি মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, তবে সেটিকে অস্বাভাবিক বা আর্লি মেনোপজ বলা হয়।
মেনোপজ আসার সঙ্গে মহিলাদের শরীরে কিছু মানসিক বা শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যে একটি প্রধান লক্ষণ হল অত্যধিক ঘাম হওয়া বা গরম লাগা ও তার সঙ্গে মুড পরিবর্তন, হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, খিটমিট বা বিরক্ত হওয়া, দুর্বলতা, ডিপ্রেশন বা অবসাদ, চামড়া কুঁচকে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই বয়সকালে ঘামের পরিমাণ বাড়লে সাবধান হতে হবে।
চিকিৎসা আছে
এই হট ফ্লাশের প্রধান চিকিৎসা হল মেনোপজাল হরমোন থেরাপি। আমরা মেয়েদের হরমোনে ইস্ট্রোজেনকে চামড়ার নিচে প্যাচ বা জেল হিসাবে লাগাতে পারি। এছাড়া এস্ট্রাডিওল গর্ভনিরোধক সম্মিলিত মৌখিক গর্ভনিরোধক পিল যে সব মহিলা সেবন করেন, তাঁদের মধ্যে ব্রেস্টে ক্যানসার, হার্টের অসুখ বা ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ বেশি দেখা যায়। হরমোন থেরাপি ছাড়াও অনেক ওষুধ রয়েছে যেগুলি নার্ভের ওষুধের মধ্যে পড়ে। যা দিয়ে এই হট ফ্লাশের চিকিৎসা সম্ভব। তবে হরমোন থেরাপি সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা।
দেখা গিয়েছে, যে সব মহিলা নিয়মিত যোগ ব্যায়াম, অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করেন, সিদ্ধ শাকসবজি, ফলমূলই খান, মেডিটেশন, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন, আকুপাংচার করেন, তাঁদের এই লক্ষণ কিছু হলেও কমানো সম্ভব। কগনেটিভ বিহেভিহারাল থেরাপি করেও নিদ্রাহীনতা, অস্থিরতা ও হট ফ্লাশের সমস্যা প্রতিহত করা সম্ভব। যে সব মহিলার বাড়িতে বা অতীতে ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছিল, হৃদরোগ বা সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছে, তাঁদের হরমোন থেরাপি দেওয়া যায় না। সেই সব ক্ষেত্রে ওষুধই ভরসা। নিউরোট্রান্সমিটারকে টার্গেট করে কিছু বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ হয়তো ভবিষ্যতে আসবে, যাতে এই রোগকে আরও সহজভাবে প্রতিহত করা সম্ভব হয়।