‘প্রথমে আনা হবে সিএবি। তারপর এনআরসি। এনআরসি শুধু বাংলার জন্যই না, পুরো দেশের জন্য।’ শাহ-কণ্ঠে ‘ক্রোনোলজি’ ফের উচ্চারিত হয়, লোকসভায়, দিল্লি দাঙ্গার কারণ ব্যাখ্যায়। ইদানীং শব্দটি প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে। কীভাবে? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘ক্রোনোলজি’ বা কালক্রম শব্দটি সর্বজনীন করে দিয়েছেন। সংসদের ভিতর-বাইরে শব্দটি বারবার ব্যবহারের পর থেকে তা ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েই চলেছে। প্রথম বলেছিলেন ২০১৯ সালে, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের তোড়জোড়ের সময়। বলেছিলেন, ‘আপ ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে। প্রথমে আনা হবে সিএবি। তারপর আসবে এনআরসি। এনআরসি শুধু বাংলার জন্যই আসবে না, আসবে পুরো দেশের জন্য। কারণ, ঘুসপেটের (অনুপ্রবেশ) সমস্যা গোটা দেশের। বাংলায় বেশি,সীমান্তবর্তী রাজ্য বলে।’ শাহ-কণ্ঠে ‘ক্রোনোলজি’ ফের উচ্চারিত পরের বছর, লোকসভায়, দিল্লি দাঙ্গার কারণ ব্যাখ্যার সময়। ইদানীং শব্দটি প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে বেশ কিছু ঘটনায়। স্পষ্টতর হচ্ছে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার একটির পর একটি ধাপ। অদৃশ্য থেকে ভেসে আসছে যেন সেই কণ্ঠ, ‘আপ ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে’।
কী সেই কালক্রম? অযোধ্যা অধ্যায় শেষ। রাম মন্দির তৈরি এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাও অতীত। ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫(ক) ধারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। কাশীতে বিশ্বনাথ করিডরও অতীত। বাকি কৃষ্ণ জন্মভূমির শৃঙ্খলমোচন। তিন তালাক নিষিদ্ধ অনেক দিন। জাতীয় শিক্ষানীতিও রূপায়িত। নজরে এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। তার আগে জরুরি জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি। আর প্রয়োজন মূলে পরিবর্তন। মূল, মানে ভারতীয় সংবিধানের ‘প্রিয়াম্বল’ বা ‘প্রস্তাবনা’। সেই উদ্যোগও গতি পাচ্ছে। কর্ণাটকের হিজাব ফরমান যাঁরা নিতান্তই ‘অবিবেচক সিদ্ধান্ত ও অবাঞ্ছিত’ মনে করেন তাঁদের বোঝা দরকার, বড় যুদ্ধ জেতার আগে ছোট ছোট লড়াই জিততে হয়। তাতে মূল লক্ষ্য হাসিলের আগে শত্রুর শক্তিহানি হয়, জয়ীর মনোবল বাড়ে। হিজাব বিতর্ক তেমনই এক কৌশল। বিজেপির গা-ঘামানো কসরতের পাশাপাশি মনোবল-বর্ধক বটিকা।
[আরও পড়ুন: বাজেটের সাত-পাঁচ ও আমরা]
কর্ণাটকে ১৯৮৩ সালে সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষকে নিজস্ব পোশাকবিধি তৈরির আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছিল। যেখানে নির্দিষ্ট পোশাকবিধি নেই সেখানে দেখা হয় পোশাকের দরুন শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে কি না। এতগুলো বছর হিজাব নিয়ে কোনও অশান্তি বা বিতর্ক সেখানে সৃষ্টি হয়নি। এখন হঠাৎ করে কারও কারও মনে হচ্ছে, হিজাব বৈষম্য সৃষ্টিকারী! হইচইয়ের পিছনে নতুন মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের ‘হাত’ দেখছেন কেউ কেউ। কেননা, তাঁর আমলে উপনির্বাচনে বিজেপির ফল আশাপ্রদ হয়নি। আগামী বছর রাজ্য বিধানসভার ভোট। তার আগে তাই ধর্মীয় মেরুকরণের হাওয়া তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সারা দেশেই দেখা যাচ্ছে, যেখানে ভোট সেখানে ধর্মই বিজেপির আস্তিনে লুকনো তুরুপের তাস। বড় যুদ্ধ (হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা) জয়ের আগে এগুলো হল ছোট লড়াইয়ের এক একটা ধাপ। ধাপে ধাপে সোপানের শীর্ষে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা। হিজাব বিতর্ক অবসানে কর্ণাটক হাই কোর্ট যে নিদানই দিক, জলঘোলা হয়ে গেল। চট করে তা থিতোবে না।
এমনই আরও একটা ধাপ জননিয়ন্ত্রণ আইন। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লালকেল্লা থেকে ভাষণে জনসংখ্যায় লাগাম পরানোর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। সেই থেকে এমন ধরনের আইন আনার কোমর কষা শুরু।
হিজাব বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখনই গত শুক্রবার, বিজেপির রাজ্যসভা সদস্য রাকেশ সিন্হা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একটা বেসরকারি বিল পেশ করেন। রাকেশ অনেক দিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলেন। এবার সুযোগ পেলেন। বিলের সারাংশ, সুস্থ জীবন ও দেশের স্বার্থে দুই সন্তান নীতিকে উৎসাহিত করা। স্বাভাবিকভাবেই বিলটি নিয়ে বিরোধিতা ছিল। এর লক্ষ্য যে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়ন’, বিরোধীরা সেই অভিযোগ এনেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিলটি সরকারি না হলেও নিশ্চিন্ত বোধ করার কারণ নেই। কেননা, বেসরকারি বিলকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার মোট ১৪টি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এই বিলও যে সরকারি অনুমোদন পাবে না তা মনে করা বাতুলতা। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির আগে এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ের অবতারণার লক্ষ্য গা-সওয়ানো। একটি-দু’টি করে এই ধরনের আইন চালু হলে জমি প্রস্তুতের পাশাপাশি বিরোধীদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে। বিজেপির ডাকাবুকো ঝাড়খণ্ডি নেতা নিশিকান্ত দুবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের এই ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে প্রকাশ্যে দাবি জানাতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি। গত সাত বছরের মোদি শাসন হিন্দুত্ববাদী সমাজকে এই সাহস জুগিয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করে হিন্দুত্ববাদী সমাজ আজকাল বুক ফুলিয়ে হিন্দুত্ব রক্ষার ব্রত নেয়। এটা প্রধানমন্ত্রীর অবদান। নিশিকান্তও তেমন সাহসী। আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু তাঁকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলনের সম্ভাবনার বিষয়টি নতুন আইন কমিশন খতিয়ে দেখবে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ২১তম আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি বলবীর সিং চৌহানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ২২তম কমিশন গঠিত হয়নি। বিলম্ব সংক্রান্ত মামলা ঝুলে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। নিষ্পত্তি না হলে সরকারের পক্ষে এগনো কঠিন। আপাতত চলছে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মন তৈরির পর্ব। অযোধ্যা, ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের মতো অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও সংঘের চাহিদার গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিজেপির জন্ম ইস্তক প্রতিটি নির্বাচনী ইস্তাহারে বিষয়টি জায়গা পেয়েছে। স্বপ্ন সাকারে মোদিও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিজেপির রাজ্যসভা সদস্য কিরোরিলাল মীনা ২০২০ সাল থেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বেসরকারি বিল পেশের তাল ঠুকে চলেছেন। এবারও সেই নোটিস তিনি দিয়েছেন। এই বিলের বিরোধিতায় চিঠিও জমা পড়েছে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের কাছে। এই ধরনের উদ্যোগের উদ্দেশ্য: বিতর্ক জিইয়ে রাখা। বিজেপি তখনই সিদ্ধান্ত নেবে যখন দেখবে জয় নিয়ে তারা নিশ্চিত।
সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধনের চেষ্টাও তেমন। এই তাগিদ যতটা সংঘের, তার চেয়ে ঢের বেশি মোদির। প্রধানমন্ত্রী নিজেই চান দেশের সংবিধানে নিজস্ব চিন্তা, ভাবনা ও আদর্শজনিত বিশ্বাসের ছাপ রাখতে। তাঁর সেই ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছেন কেরলের রাজ্যসভা সদস্য কে. জে. আলফোন্স। প্রথম মোদি সরকারের সংস্কৃতি ও পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বরেও আলফোন্স এই সংক্রান্ত এক বেসরকারি বিল রাজ্যসভায় আনতে চেয়েছিলেন। প্রবল বিরোধী প্রতিরোধের মুখে অধ্যক্ষ বিল পেশের বিষয়টি স্থগিত রেখেছিলেন। গত শুক্রবার বিলটি পেশের অনুমতি পেলেও আলফোন্স সভায় ছিলেন না। বিলটি পেশ হয়নি তবে বিষয়টি জিইয়ে থাকছে।
আলফোন্স চান প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দের বদলে ‘ন্যায়সংগত’ শব্দটি ঢোকাতে। কেন চান, তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি অর্থহীন হয়ে পড়েছে। শব্দটি ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যারা নিজেরাই ছত্রভঙ্গ। ‘ন্যায়সংগত’ শব্দ সেক্ষেত্রে মোদির দূরদৃষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সমাজের নিচুতলার মানুষের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। প্রস্তাবনায় ‘প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতার’ ক্ষেত্রে আলফোন্স চান ‘প্রতিষ্ঠা ও জন্ম, খাদ্য, শিক্ষা, চাকরি এবং মর্যাদা সহকারে সুযোগ ব্যবহারের সমতা নিশ্চিতভাবে লাভ’ এর উল্লেখ। তৃতীয় সংশোধন ‘সৌভ্রাতৃত্ব’-র ক্ষেত্রে। তিনি ‘ব্যক্তি মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য-সংহতি’-র সঙ্গে ‘সমাজ’ শব্দটি জুড়তে চেয়েছেন। আর চেয়েছেন প্রস্তাবনায় ‘পূর্ণ গার্হস্থ্য সুখ’ নিশ্চিত করতে। বিরোধীরা হাল ছাড়ছেন না। সংবিধানের প্রস্তাবনা অক্ষুণ্ণ রাখতে তাঁরা সচেষ্ট। কিন্তু কত দিন? উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।
নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়ে যাবে ২০২৪-এর ভোটের আগে। ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’-সহ যাবতীয় নির্মাণ যজ্ঞ, বিরোধী লব্জে যা ‘মোদিমহল’, সেই কাজও শেষ হবে মোদি জমানায়। সংঘের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির স্বপ্নও হয়তো সাকার হবে আজ বা কাল। কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বকীয়তা না দেখালে প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গঠন যে অসমাপ্ত থেকে যায়? অতএব, ‘ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে’।