রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: দেশ জুড়ে একদল তেজি মানুষ আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের মুখে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে এই অমৃতবাণী, তাঁরা মানুষের পাশে থাকতে চান, মানুষের কাজ করতে চান। এবং মানবকল্যাণের স্বার্থেই তাঁরা এ-দল থেকে ও-দলে, ও-দল থেকে সে-দলে ছুটোছুটি করেছেন। এবং এহেন পরিবেশে যে-বইটি আমি ‘গীতা’ পাঠের মতো প্রায় প্রত্যহ পড়ছি সেটি হল প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো, রাজনৈতিক দর্শনের একটি গভীর গ্রন্থ, ইতালিয়ান প্রজ্ঞার অনন্য নিদর্শন, নিকোলো মাকিয়াভেলি-র ‘দ্য প্রিন্স’। অনেক শিক্ষিত বাঙালিই ‘দ্য প্রিন্স’ পড়েছেন। কিন্তু কে জানত, এই বই ২০২১ সালে এমন নব তাৎপর্যের ঝাপটা দেবে আমাদের।
[আরও পড়ুন: চাকরি পেলেন ও খোয়ালেন সাংবাদিক নিধি রাজদান]
‘দ্য প্রিন্স’-এ মাকিয়াভেলি কী সাহসে ও স্বচ্ছতায়, কী সহজ ভাষায় ও দৃঢ়তায় বলেছেন, মানুষের জন্য মাঙ্গলিক কাজের এই তাড়না, এই অহরহ হিরণ্ময় হিতৈষা আসলে রাজনীতির কপট চাল! এবং তার থেকেও যেটা জরুরি কথা, মাকিয়াভেলি সমর্থন করছেন এই শঠতা, বলছেন তুখড় রাজনীতিক নেতা-নেত্রীকে মিথ্যা হিতৈষণার ভাবটি সারাক্ষণ প্রচার করতেই হবে!
নেতা বা শাসককে কেমন মানুষ হতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে কুণ্ঠাহীন মাকিয়াভেলি জানাচ্ছেন, The ruler should appear a man of compassion. নেতা বা শাসকের সঙ্গে কথা বলে, তার সান্নিধ্যে গিয়ে যেন সাধারণ মানুষের মনে হয়, আহা, কী দয়া মানুষটির মনে! সারাক্ষণ মানুষের মঙ্গল চান এই মানুষটি। এতদিনে একজন নেতা পেয়েছি বটে। যিনি সত্যি বোঝেন গরিব গেরস্থর দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু শুধু দয়া হলেই হল? রাজনীতিকের আর কোনও গুণের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে।
মাকিয়াভেলি জানাচ্ছেন, ভাল নেতাকে হতে হবে চতুর অভিনেতা। তাকে অভিনয় করতে হবে, ‘ম্যান অফ ফেথ’-এর। ‘ম্যান অফ ফেথ’ মানে যাকে বিশ্বাস করা যায়। সাধারণ মানুষ যাকে বিশ্বাস করে ক্ষমতার সিংহাসনে বসাবে। এবং ক্ষমতায় এসে সেই নেতা সত্যিই মানুষের কথা ভাববে, মানুষের জন্য সত্যিই কাজ করবে। নিজের পাতে ঝোল না-টেনে মানুষের পাতে সেই ঝোল দেবে। মাকিয়াভেলি বলছেন, ‘আদর্শ শাসক’ বা নেতা ভান করবে মানুষকে ভালবাসার, ‘আ ম্যান অফ গুড ফেথ’ এবং ‘আ ম্যান অফ ইন্টিগ্রিটি’ হওয়ার। ‘ম্যান অফ ইন্টিগ্রিটি’ মানে যে-ব্যক্তি সমস্ত কৃত্রিমতা, ছলচাতুরি সম্পূর্ণ পরিহার করে অটল ন্যায়পরায়ণতায় আশ্রিত! এ কি চাট্টিখানি ব্যাপার। মাকিয়াভেলি বলছেন, শুধু ‘অনেস্টি’ বা ‘সততা’ নয়। ‘ইন্টিগ্রিটি’ অর্থাৎ অখণ্ড, নিরন্তর সততা। এবার, ভেবে দেখুন, শাসক বা নেতাকে কত বড় অভিনেতা হতে বলছেন মাকিয়াভেলি, যাতে সাধারণ মানুষ নেতার অখণ্ড সততায় বিশ্বাস করে সহজেই। মানুষটি যে আসলে ধুরন্ধর, চতুর, কপট, তা যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে।
মাকিয়াভেলি এরপর একটি বিলিয়ন ডলার মূল্যের কথা বলছেন। সেই কথাটি হল, রাজনীতিকদের গুরু অরণ্যের দু’টি প্রাণী, একথাটা ভুললে চলবে না। একটি প্রাণী হল সিংহ। অন্যটি শিয়াল। এই দু’টি প্রাণীর কাছে জীবনদর্শনের দীক্ষা নেন শাসক ও নেতা। এবং সেটাই তো উচিত কাজ। যে-মানুষ চায় রাজনৈতিক ক্ষমতা সে কী শেখে সিংহ ও শিয়ালের কাছে? জানাচ্ছেন মাকিয়াভেলি: He learns from the fox and the lion. The lion is defenceless against the traps and a fox is defenceless against the wolves. Therefore one must be a fox in order to recognize traps and a lion to frighten off wolves. Those who simply act like lions, are stupid. নেতারা সিংহ এবং শিয়াল দু’জনকেই তাঁদের মাস্টারমশাইয়ের আসনে বসান। সিংহের প্রবল পরাক্রম। কিন্তু তারা ফাঁদে পড়ে। কোথায় ফাঁদ তা বোঝার বুদ্ধি তাদের নেই! শিয়ালের আশ্চর্য ক্ষমতা, ফাঁদ এড়িয়ে চলার। তাই রাজনীতিককে একই সঙ্গে সিংহ এবং শিয়াল হতে হবে। তবেই তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে। শুধুই যে নেতারা সিংহের মতো হুমকি দেন, তাঁরা কিন্তু ‘স্টুপিড’! ঠিক ফাঁদে পড়ে শেষ হবে।
প্রশ্ন হল, এই যে মানুষের জন্য দরদ ও ভালবাসা দেখিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা, ক্ষমতায় এলে কী রূপ ধারণ করেন নেতা ও শাসক? মাকিয়াভেলি-র উত্তরে কোনও সংশয়ের পরিসর নেই। কী মারাত্মক স্পষ্টবাদী মাকিয়াভেলি, পড়ুন: There are two ways of ruling: by law or by brute force. The first way is natural to men. The second to beasts. দু’ভাবে শাসন করা যায়। আইনের শাসন। এবং নিখাদ ক্ষমতার শাসন। প্রথম পদ্ধতি সভ্য মানুষের। দ্বিতীয় পদ্ধতি, অরণ্যের জানোয়ারের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা মানুষের ভাল কাজ করার জন্য ক্ষমতার আসনে আসে, তারা বুঝে যায়, আইনের পথে যোগ্য শাসন সম্ভব নয়। তখন তারা জান্তব শক্তির প্রয়োগে যায়। অবশ্যই, মানুষের মঙ্গলের জন্যই। মাকিয়াভেলি সংশয়াতীত উচ্চারণে জানিয়েছেন: But as the first way often proves inadequate, one must needs have recourse to the second! কিন্তু এই নেতারাই, শাসকরাই যে মানুষকে ভালবাসার বার্তা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে, মানুষের ভাল
করতে তাঁরা ক্ষমতায় বসেছেন? সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলেন?
মাকিয়াভেলি বলছেন, রাজনৈতিক দর্শনের এটাই তো গোড়ার কথা! নেতা উপরে-উপরে মানুষকে ভালবাসার ভান বজায় রাখবেন, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেই হবে। না হলে শাসন করবেন কী করে? মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারলে তার কাছে দেওয়া কোনও প্রতিশ্রুতিরই দাম নেই। আর মূল্যহীন, অর্থহীন প্রতিশ্রুতি ভাঙতেই বা কুণ্ঠা কীসের? মাকিয়াভেলি ঠিক কী বলেছেন স্মরণ করা যাক: Because men are wretched creatures who would not keep their word to you, you need not keep their word to them. সাধারণ মানুষ হতচ্ছাড়া জীব। তারা কি নিজেরা কথা দিয়ে কথা রাখে? সুতরাং তাদের কাছে কথা দিয়ে নেতারাই বা কথা রাখবেন কেন?
তবে একটা কথা। খুব জরুরি কথা কিন্তু। শাসক বা নেতাদের মুখে যেন ধর্মের কথা থাকে। রাজনীতির সঙ্গে ঠিক পরিমাণে ধর্ম মেশাতে পারলে শাসন করা সহজ হয়। শাসক বা নেতাকে তাই হতে হবে ‘a religious man’। আমাদের নেতা বা শাসক বেশ ধর্মপ্রাণ বা ধর্মভীরু, এসব সাধারণ মানুষ ভীষণ খায়। শাসক বা নেতা অহরহ ধর্মের কথা বলছেন মানেই মানুষটি দয়ালু। তাঁর দাঁত নেই, নখ নেই, হিংসা নেই, শুধু আছে দয়া-মায়া-ভালবাসা। এমন একটি নিটোল ধর্মভাব সম্পর্কে মাকিয়াভেলি এই মাস্টারস্ট্রোকটি দিয়েছেন একটি মারাত্মক লাইনে: And there is nothing so important as to seem to have this last quality.
ধর্মভীরু ও ধর্মবিশ্বাসের ভাবটি শাসককে বজায় রাখতেই হবে, বারবার বলেছেন মাকিয়াভেলি। কিন্তু পাশাপাশি আর একটি কথাও বলেছেন বইকি! কথাটি খুব সহজ হয়েও বেশ ধাক্কা দেয়: শাসক ও নেতাকে, তুখড় রাজনীতিককে, মানুষের ভালবাসার থেকে বেশি অর্জন করতে হবে মানুষের ভয়। যতই ধর্ম-ধর্ম করো না কেন, শাসককে মনে রাখতেই হবে, ‘it is far better to be feared than to be loved’! কেন? সহজ উত্তর মাকিয়াভেলি। কোনও আড়াল বা মারপ্যাঁচ নেই এই রাজনৈতিক-দার্শনিকের। তিনি জানাচ্ছেন, ‘Men worry less about doing an injury to one who makes himself loved than to one who makes himself feared.’ যে-ব্যক্তি ভালবাসে, ভালবাসা চায় মানুষের, তার ক্ষতি করতে মানুষ কম ভয় পায়। আর যে-ব্যক্তি অর্জন করতে পারে বা চায় মানুষের ভীতি, তার ক্ষতি করতে মানুষ অনেক বেশি ভয় পায়।
শাসক বা নেতারা একটি কথা ভোলেন না। না ভোলা-ই উচিত। কথাটা হল, সাধারণ মানুষ অতি জঘন্য জীব। তারা ভালবাসার কোনও দাম দেয় না। নিজেদের স্বার্থে ঘা লাগলেই তারা ভালবাসার সম্পর্ক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। সুতরাং নেতারা বোঝেন, উপর-উপর ভালবাসার অভিনয় চালিয়ে গিয়েও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। আর নেতারা এটাও জানেন যে ভালবেসে শাসন অসম্ভব। শাসন করতে হয় ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে। ‘The bond of love is one which men, wretched creatures that they are, break when it is to their advantage to do so.’
সাধারণ মানুষ অতীব ঘৃণ্য জীব, যারা ভালবাসার বন্ধন ছিঁড়ে নিজেদের স্বার্থে বেরিয়ে যেতে দ্বিধা করে না। সুতরাং তাদের ভালবেসে শাসন করা অর্থহীন। শাসন করতে ক্ষমতার ত্রাস প্রয়োজন, জানেন রাজনীতিকরা। তাই শাসকের পক্ষে নিষ্ঠুরতার অপবাদ কোনও অপবাদ নয়। বরং সেটাই সঠিক শংসা। এই হল মাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’-এর সারাৎসার। আজও, কী দুর্ভাগ্য, মনে হয়, এই অনন্য রাজনৈতিক দর্শনের যাথার্থ অক্ষুণ্ণ রয়েছে!
মাকিয়াভেলি-র লেখা আমাকে যেমন বিস্মিত করে, তেমনই বিস্মিত করে তাঁর জীবন, তাঁর যাপন, তাঁর বৈদুষ্য ও প্রজ্ঞা। একথা বলতেও আমি দ্বিধা করব না, আমি মুগ্ধ মাকিয়াভেলির রাজনৈতিক কূটজ্ঞানে। তাঁর সঙ্গে তুল্য শুধু আমাদের চাণক্য। বলা যায়, মাকিয়াভেলি ফ্লোরেন্সের চাণক্য। ১৪৬৯ সালে সেখানেই জন্ম তাঁর। তিনি হয়েছিলেন ফ্লোরেন্টাইন রিপাবলিকের সেক্রেটারি এবং সেকেন্ড চ্যান্সেলর। আবার ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে পতনও হয়েছিল তাঁর। এমনকী নির্বাসন! অথচ এই মানুষটি নিজের অধীনে একটি সৈন্যবাহিনী পর্যন্ত তৈরি করেছিলেন।
কেমন দেখতে ছিল তাঁকে? শয়তানের মতো? না দেবতা? অনেক বই থেকে খুঁটে খুঁটে এই তথ্যটি জোগাড় করতে পেরেছি। তাঁকে দেখলেই মনে হত, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান, লেখাপড়ায় উজ্জ্বল, কথায় ও লেখায় প্রগাঢ় স্কলার। তিনি ছিলেন মাঝারি উচ্চতার মানুষ। মেদহীন চেহারা। চোখ দু’টিতে সবসময় আলো। আর ঈগলের ঠোঁটের মতো নাক। তাঁর নিজের ঠোঁটে সর্বদা বিদ্রুপের ভাব। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে রিপাবলিকের ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছিলেন। তারপর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন। নির্বাসনে অত্যাচারিত হলেন। নির্বাসন থেকে ফিরে ফ্লোরেন্সে আর ফিরলেন না। শহর থেকে দূরে চলে গেলেন একটি ফার্ম হাউসে। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ঘর করলেন। কিন্তু কারও কাছের মানুষ হলেন না। ডুবে রইলেন সারস্বত সাধনায়। এক বিপুল লাইব্রেরি তৈরি করলেন তাঁর বাড়িতেই। সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা দিন কাটাতেন। বই পড়া আর লেখা, এই ছিল তাঁর কাজ। ‘দ্য প্রিন্স’ তাঁর মাস্টারপিস। তিনি ছিলেন এক উদ্ধত পণ্ডিত। আর, এই উদ্ধত পণ্ডিতের শেষ উপদেশ নেতা ও শাসকের প্রতি– যতরকম শয়তানি ও ক্ষমতা প্রদর্শন পারো, করে যাও। শুধু দু’টি ভুল কখনও কোরো না। এক, গরিব মানুষের জমি কেড়ে নিও না। ঠকিয়ে নিও না তাদের জীবনের তলানি সম্বল। দুই, গরিবের ঘরের মেয়ের গায়ে হাত দিও না। এই দু’টি অপরাধ করলে আন্দোলন হবেই।