shono
Advertisement

Breaking News

সিপিএময়ের দুঃসময়, বাংলায় কেন ভরাডুবি বামেদের?

দশ বছর আগে যে দল ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ছিল, এবার তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই বিধানসভায়।
Posted: 03:23 PM Jul 14, 2021Updated: 03:23 PM Jul 14, 2021

ইতিমধ্যেই রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ‘ভুল’ কোথায় হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভুল স্বীকার করার চেয়েও ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া বেশি জরুরি। সেটা কি সিপিএম কখনও সত্যি নিয়েছে? লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।  

Advertisement

 

রাজয় নয়, বিপর্যয়। প্রকৃত দুঃসময়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফল দেখার পর নিশ্চয়ই বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি সিপিএম (CPM) নেতাদের। দশ বছর আগে যে দল ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ছিল, এবার তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই রাজ্য বিধানসভায়। প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষের সমর্থন এসে দাঁড়িয়েছে ৪.৭ শতাংশে। বহুজন সমাজ পার্টি বা নোটা এরাজ্যে এমন ভোট পায়।

ভাগ্যিস জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাসের মতো বাম-বাংলার স্বর্ণযুগের নেতারা বেঁচে নেই। তাঁদের দেখে যেতে হল না, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে-পার্টি ভারতের ক্ষমতা দখলের স্লোগান দিয়েছিল, তাদের ভাঁড়ার শূন্য। বাম শরিক দলগুলির তেমন বল কোনও কালেই ছিল না। তারা পুরোপুরি সিপিএমের শক্তির উপর ভর করে চলত। কলকাতায় তাদের রাজ্য অফিসগুলি ক্রমশ ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হচ্ছে। যে-পার্টিকে অসংখ্য মানুষ ‘চোখের মণি’-র মতো রক্ষা করতেন- সেই সিপিএমের এই ভয়ংকর হাল কেন? কোন ভুলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে চলে গেল? ইতিমধ্যেই রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ‘ভুল’ কোথায় হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভুল স্বীকার করার চেয়েও ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া বেশি জরুরি। সেটা কি সিপিএম কখনও সত্যি নিয়েছে?

[আরও পড়ুন: বাংলা থেকে মোদির মন্ত্রিসভায় নতুন চার মুখ, কৌশল কি সফল হবে?]

বিজেপি বাংলায় এতটা ভোট বাড়াল কীভাবে? সমীক্ষা বলছে, ২০১৬ সালের পর থেকে বাম ভোট একটু একটু করে চলে যাচ্ছে বিজেপির দিকে। ধর্মীয় উন্মাদনা, অর্থ, ক্ষমতা বিজেপির আছে। সিপিএমের নেই। ফলে স্বেচ্ছায় ঘরছাড়ারা শূন্য ঘরে ফিরবেন কেন? তৃণমূলের উপর ক্রোধে ‘২১-এ রাম, ছাব্বিশে বাম’ স্লোগানে আহ্লাদিত হওয়ার কুফল কেমন, বুঝতে পারছেন কমরেড? অসুখ কোথায়?

১) গলদ গোড়ায়। পার্টি আগে, না জনগণ আগে? ভুল কার হয়? পার্টির না মানুষের? সিপিএম মনে করে আগে পার্টি, তারপর বাকি সব। পার্টি লাইনে কোনও ভুল নেই। ভুল জনগণের। বিরোধীদের প্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে বিপক্ষে ভোট দেয়।

২) ২০১১ সালে হারার পর সিপিএম নেতাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ক্রোধ তৈরি হয় মমতার প্রতি। কালীঘাটের গরিব ঘর থেকে উঠে আসা, ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়া একটি মেয়ে কি না হারিয়ে দিল ৩৪ বছরের ক্ষমতাকে! মেনে নিতে পারেননি নেতারা। স্বভাবতই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে যেনতেন প্রকারেণ মমতার অপসারণ। অন্যের ক্ষতি চাইতে গিয়ে নিজের ঘরে যে সিঁধ কেটে অন্য শক্তি ঢুকছে, তা নজরে আসেনি।

৩) বাংলার গ্রাউন্ড রিয়্যালিটির কোনও খোঁজ এবার ছিল না সিপিএম নেতাদের। বিজেপির বিভাজনের প্রচারে কীভাবে মুসলিম ভোট এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভোট একজোট হয়ে উঠছে, বুঝতে পারেনি আলিমুদ্দিন। পার্টির শীর্ষ নেতারা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলতেন, ‘আগে ও যাক। তারপর বিজেপিকে আমরা লড়ে নেব।’ কী বলছেন? ‘মমতা হারুক’ মানে তো ‘বিজেপি জিতুক’!

৪) সিপিএমের প্রচারে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ প্রধান ইস্যু ছিল না। বিজেপির বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িকতা’-র ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘স্বৈরতন্ত্র’-কে ইস্যু হিসাবে ৫০:৫০ অনুপাতে ভাগ করা হয়েছিল। যদিও ভোটের প্রচারে ৯০ শতাংশ মমতাকে গালিগালাজ করে বাকি ১০ শতাংশ রাখা হত নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের জন্য। এই বিভ্রান্তমূলক অবস্থানে মুসলিমরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। পার্টি-দরদিরাও এই অবস্থান গ্রহণ করেননি। এমন পরিচিত অনেক মানুষকে চিনি, যাঁরা বামপন্থী, কিন্তু এবার জোড়াফুলে ভোট দিয়েছেন স্রেফ বিজেপি (BJP) যেন না জেতে- সেই উদ্দেশ্যে। শহরজুড়ে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেন ‘নকশাল’-রা করছে বলে সিপিএম উড়িয়ে দেয়। তারা বুঝতে পারেনি, ওই সংবেদনশীল ‘ব্যানার’টি মুসলিম হোক বা হিন্দু- কোনও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিল না। তাদের কাছে মন্দের ভাল হয়ে ওঠে তৃণমূল।

৫) ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব! ভুল মেনেছে নেতৃত্ব। টুম্পা সোনার মতো এই বিজেমূল তত্ত্বেও ভারি আমোদ পেয়েছিলেন নেতারা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি সিবিআই যাচ্ছে, অথচ প্রচারে সিপিএম নেতারা বলছেন মোদি-মমতা সেটিং! মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

১৯৯৮ সালে তৃণমূলের জন্ম থেকে ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে-পরে কয়েক মাস কংগ্রেসের সঙ্গে জোটপর্ব বাদ দিলে ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত তৃণমূলের জোটসঙ্গী ছিল বিজেপি। এটা ছিল প্রকাশ্য। ১৯৯৮, ১৯৯৯ ও ২০০৪-এর লোকসভা ভোট ও ২০০৬ বিধানসভা ভোটে আসনভিত্তিক সমঝোতা ছিল। তারপর তৃণমূল-বিজেপির কোনও সম্পর্ক নেই গত ১৫ বছরে। অটলবিহারী বাজপেয়ী যতদিন সক্রিয় ছিলেন, ততদিন মমতা তাঁদের পাশে ছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিরা ক্ষমতাশালী হওয়ার পর মমতার সঙ্গে সমঝোতা তো দূরের কথা, সংঘাত লেগেই রয়েছে। এই বিধানসভা ভোটে বিজেপি যেভাবে তৃণমূ্‌লকে সরাতে নেমেছিল, তা দেশীয় রাজনীতিতে নজিরবিহীন। এরপরও ‘বিজেমূল’ তত্ত্বে যাঁরা আহ্লাদিত হন, হয় তাঁরা রাজনীতি বোঝেন না, নতুবা বোধশক্তিহীন।

৬) কংগ্রেসের সঙ্গে জোট কেন? ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত কংগ্রেস ছিল অচ্ছুৎ। ক্ষমতা হারাতেই তারা ধোয়া তুলসীপাতা! ’৭২-’৭৭ সালের সন্ত্রাস, এগারো জন পার্টি কমরেডের মৃত্যু-সহ হাজার অভিযোগ। কংগ্রেসের সঙ্গ খারাপ বলে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। ২০০৪-এ ইউপিএ-কে সমর্থন দিয়েও মন্ত্রিসভা এড়ানো হয়। ২০১৬-য় এসে হঠাৎ করে যদি বলা হয়, কংগ্রেসকে ভোট দাও- মানুষ মানবে কেন? একইভাবে, কংগ্রেসের যেসব লোক ৩৪ বছর সিপিএমের শাসনের বিরোধিতা করেছেন, তাঁরাও যে কাস্তে-হাতুড়িতে ভোট দেবেন না- সেটা বুঝতে গেলে বড় বোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে সিপিএম সমর্থকরা তা-ও পার্টির অনুশাসন মেনে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু কংগ্রেসিরা দেননি। এরপরও ২০২১-এ জোটে গেল সিপিএম। যার পরিণতি ওই চার শতাংশ ভোট। এই ভোট আরও বেশি করে দেখাল, বাংলায় কংগ্রেসকে মুসলিমরা ভোট দিলেন না। সবাই তৃণমূ্‌লে। তাই কংগ্রেসও শূন্য।

৭) কে আব্বাস সিদ্দিকি? তাঁর কী গ্রহণযোগ্যতা? একটি অল্পবয়সি ছেলে। গরম গরম কথা বলেন। তাতেই ‘নেতা’ হয়ে গেলেন! কী তাঁর লড়াই সংগ্রাম, আদর্শ, সমর্থন? শতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি নতজানু হল ফেজটুপিধারী ধর্মীয় গুরুর পায়ে! কোনও মানুষ মেনে নিতে পারেনি। আব্বাসের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সিপিএমকে সমর্থন করেও বহু হিন্দু ভোটার বিজেপির দিকে সরে গিয়েছেন। মুসলিমরা আরও সংঘবদ্ধ হয়েছেন তৃণমূলের দিকে। অনেকেই মনে করেন, আসলে তৃণমূলের মুসলিম ভোটব্যাংক ভাঙতেই জোট করা হয়। বুমেরাং হয়েছে।

৮) ভোটে ধস। পাঁচ বছর আগে ১০ শতাংশ ভোট ছিল বিজেপির। এখন ৩৮। লোকসভা ভোটে ৪০। পক্ষান্তরে গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বামেরা। এবার সেটা ৪। মানে যত বাম ভোট কমেছে, তত রাম ভোট বেড়েছে।
ভুল স্বীকার করতে গেলে এই বিষয়গুলির ময়নাতদন্ত করতে হবে। ফল প্রকাশের পর সত্যি কথাগুলো প্রকাশ্যে বলেছিলেন উত্তর দমদমের পরাজিত বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। পরে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। বাকিরা চুপ কেন?

পৃথিবী বদলে গিয়েছে। করোনা আরও বদলে দিয়েছে দুনিয়া। আন্তর্জাতিক বিশ্বে সভ্যতার বিকাশ এক সুতোয় বেঁধেছে মানুষকে। মানুষের ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম- সবকিছুর পথ আজ পরিবর্তিত। শ্রমের চরিত্র দেখা নয়, শ্রমকে রক্ষা করা প্রধান চ্যালেঞ্জ। ‘আমিই ঠিক’ বলার দিন শেষ। কেন মানুষ ভোট দিচ্ছেন না, সোজাসাপটা তার তো মূল্যায়ন করতে হবে! ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ করেই কেটে গেল দশকের পর দশক। যখন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দরকার ছিল, তখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। যখন বাংলায় নতুন প্রেক্ষাপটের উপর দাঁড়িয়ে বিজেপিকে রোখার দরকার ছিল, তখন মমতার উপর ক্রোধ! কেন? সব বদলাতে হবে। শুধু পার্টি কংগ্রেসে পাঁচদিন ধরে চর্বিতচর্বণ নয়, চাই পরিবর্তনের দলিল। আদর্শকে ভিত্তি করে নতুন পথ। না হলে আরও দুঃসময় সামনে।

[আরও পড়ুন: জ্বালানি জ্বালায় জর্জরিত জনতা, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদাসীন কেন কেন্দ্রীয় সরকার?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement