shono
Advertisement
Hindu Lives

দেশ, ধর্ম, নিরপেক্ষতা

যে কোনও মূল্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করতে হবে।
Published By: Biswadip DeyPosted: 01:51 PM Nov 30, 2024Updated: 01:51 PM Nov 30, 2024

রাজনীতি, ধর্ম, ভাষার ভিন্নতা– এই তিনটি ‘চলরাশি’ রাষ্ট্র ভাগাভাগিতে বরাবর সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে এই উপমহাদেশে। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা পছন্দ করছে না– এটা পরিষ্কার। কারণ, ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় হিন্দু বা মুসলিম, কোনও মৌলবাদের ঠাঁই নেই। লিখছেন শুভময় মৈত্র

Advertisement

হিংসার ক্ষেত্রে বাঙালিরা কখনওই খুব একটা পিছিয়ে থাকে না। যে-অংশটি প্রথম বিশ্বের দেশে গিয়ে কাজ করে, তারা তুলনায় সাবধানী হয়ে যায়। কিন্তু ভারতের দু’টি রাজ্য– পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা এবং পড়শি বাংলাদেশে– রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রকোপ ভয়ংকর। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, উদারবাদী বাঙালি ভোটের সময় অল্প হাতাহাতি করেছে এই দৃষ্টান্তও প্রচুর।

শাসক অথবা শাসক দলের প্রতিনিধি হিসাবে মানুষ মারার উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় প্রায় সব প্রধান দলের জীবনপঞ্জিতে উজ্জ্বল। এবং, বিরোধীরাও একই প্রকৃতির। এরই সঙ্গে বাংলায় রয়েছে চরম আধিপত্যবাদী রাজনীতি। আলাদা করে তার মধ্যে কংগ্রেস, সিপিআইএম, বিজেপি, তৃণমূল টেনে লাভ নেই। হিংসা অন্যান্য রাজ্যেও আছে, আছে সারা পৃথিবীতে। কিন্তু সারাক্ষণ রাজনৈতিক আলোচনা, তর্কাতর্কি, মাঝেমাঝেই হানাহানি, আর নির্বাচনের আগে-পরে নিয়মিত খুনোখুনি-অভিযোগ– এই ঘরানা একান্ত বাঙালিদের। ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস, ১৯২৫ সালের কমিউনিস্ট বা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন– কেউ আলাদা নয়। একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেই তা মালুম পাওয়া যায়। এই যে আমরা, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজও তো বিভিন্ন রাজনৈতিক তর্কের সময় কতটা ‘অসহিষ্ণু’ হয়ে উঠি।

প্রেক্ষিতটা সামলে নিয়ে এবার বাংলাদেশে উঁকি মারা যাক। সেখানে রাজনৈতিক হিংসার প্রকোপ প্রবল। সাম্প্রতিক সময়ে একদিকে যেমন আওয়ামি লিগ ধর্মনিরপেক্ষতাকে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনই অন্যদিকে নির্বাচনী আধিপত্যবাদে তারা বেশ গোলমেলে। ফলে, বাংলাদেশের বড় অংশের মানুষের রাগ সে-জায়গায় জায়েজ। অর্থাৎ, যেটা প্রথমে স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে লিখতে চাইছি, তা হল, বিশ্বের অন্যান্য কয়েকটি জাতি বা গোষ্ঠীর মতোই, বাঙালিরাও, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের অপরাধে অপরাধী। এখানে অভিযোগ বা অভিযুক্ত-সংক্রান্ত কোনও ধন্দে পড়ে যাওয়ার দরকার নেই, কারণ, উদাহরণ প্রচুর। প্রশ্ন হল, কে কখন কোন দলে গিয়ে কতটা পেশি ফোলাবে।

‘আধিপত্যবাদ’ যখন বাড়তে থাকে তখন আবার মানুষ একসঙ্গে রুখে দঁাড়ায়। পশ্চিমবঙ্গ ১৯৭৭ বা ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন সে-উদাহরণ দেখেছে। তবে এমন গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ তো আর প্রত্যহ হয় না। ফলে সরকার টিকে যায়। অর্থাৎ, বুঝতে অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশে একটানা শেখ হাসিনা এবং তঁার দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ চলছিল। বিষয়টি নেতিবাচক। অন্যদিকে, ইতিবাচক উদাহরণ হিসাবে আসবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে এই দলের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির কথা। অন্যদিকে, বিএনপি বা জামাতের গণতন্ত্র রক্ষার দাবি সংগত হলেও, তারা পাড় মৌলবাদী। বিশেষ করে ‘ইসকন’-কে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিলে জামাত ঠিক কী– সে প্রশ্ন উঠবেই। তার থেকেও বড় কথা, একবার ক্ষমতা পেলে তারা একাধারে রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ ও মৌলবাদ– দুই-ই চালিয়ে যাবে, তাও প্রায় নিশ্চিত। আপাতত নোবেলজয়ী (অর্থনীতিতে নয়, শান্তিতে) মহম্মদ ইউনুসের হাত ধরে সেই অশান্তি পাকিয়ে তোলার চেষ্টা সফল। সেই সঙ্গে আছে চূড়ান্ত ভারত-বিরোধিতা।

মুক্তিযুদ্ধর সময় ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত যেভাবে বড় দাদার মতো বাংলাদেশের পাশে দঁাড়িয়েছিল, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। মুসলিম মৌলবাদীদের দাপট এখন বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে যথেষ্ট। ফলে, এই মুহূর্তে হিন্দু রাষ্ট্রবাদী বিজেপি বড়দাকে তারা সহ্য করতে পারবে না– স্বাভাবিক। আর, সেই সহ্য না-করাটা যত বেশি করে সামনে আসবে, তত ভারতে বিজেপির সুবিধা।

ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু। ফলে সহজ অঙ্কে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে তাদের উপর অত্যাচার– এই দেশের হিন্দুদের রাজনৈতিকভাবে বিজেপির দিকে যেতে প্রভাবিত করবে। অর্থাৎ, এখানে ‘চলরাশি’ একদিকে রাজনীতি এবং ধর্ম। তারা হাতে হাত মিলিয়েই চলে। ধর্মের নিরিখে হিন্দু এবং মুসলমানের দ্বন্দ্বের বিষয়টি এই উপমহাদেশে পরিষ্কার। ঝামেলাটা শুরু করে গিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতাকালীন দেশনেতারা। ‘ধর্ম’ নিয়ে খেলা করতে গিয়ে এমন একটা ‘পাকিস্তান’ বানালেন যে, দুই দিকে দুই কলাগাছ, মধ্যিখানে মহারাজ– ভারত।

স্বাভাবিকভাবেই এরকম খণ্ডাংশ নিয়ে মৌলবাদী মুসলিমদের পক্ষে দেশ চালানো মুশকিল। তাই ধর্ম এরপর ভাগ হয়ে গেল ভাষায়। বাংলা ভাষার লড়াইয়ে পাকিস্তান ভেঙে হল বাংলাদেশ। রাজনীতি, ধর্ম, এবং ভাষার এই ভিন্নতা মূল তিনটি ‘চলরাশি’ (ভেরিয়েব্‌ল), রাষ্ট্র ভাগাভাগির ক্ষেত্রে। এবার বাংলাদেশের মৌলবাদী মুসলিমরা আগে-পিছে না-ভেবে অত্যাচার চালাচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর (নিজেদের মধ্যেও মারামারি করছে রাজনীতির দ্বন্দ্বে)। আর মুশকিলে পড়ছে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী মুসলিমরা, যেখানে তারা সংখ্যালঘু।
এবার পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের কথায় আসা যাক। পশ্চিমবঙ্গের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল– তৃণমূল, কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় সেই ভাবনা স্বাভাবিক। আর, সেই ভাবা যদি বেশি হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে মুসলিম-তোষণের অভিযোগ ওঠে। একটানা এই অভিযোগ করে চলেছে বিজেপি, এবং এই প্রসঙ্গে তাদের হিন্দু রাষ্ট্রবাদী ভাবনা স্বচ্ছ। এবার গোপনে কে, কী চক্রান্ত করছে– সেই বিষয়টি তো রাজনৈতিক আলোচনার অংশ নয়, সেসব গভীর তদন্তের বিষয়। কিন্তু খোলা পথে কী হচ্ছে?

আপাতত, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার পশ্চিবঙ্গের হিন্দুরা পছন্দ করছে না– এটা পরিষ্কার। তাই তারা প্রশ্ন করছে, তৃণমূল, কংগ্রেস বা সিপিআই(এম)-কে (ঠিক যেমন ওপার বাংলায় আওয়ামি লিগকে সংখ্যালঘু হিন্দু-তোষণ এবং ‘ভারতের দালালি’ করার অভিযোগ শুনতে হত)। সেই উত্তরের প্রয়োজন আছে।
কিছু উত্তর এর মধ্যেই এসব দলের আকাশপাতায় আছে। তবু আরও বেশি দৃঢ়তা এবং স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না-করতে পারলে সে এক বড় অপরাধ! মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম তোষণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীদের আমাদের সংবিধানে স্থান নেই। ঠিক যেমনটা নেই হিন্দু মৌলবাদীদের। সোজাকথায়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচারের নিরিখে এই তিনটি দলের দ্রুত উত্তর আমরা দাবি করছি। চাইছি সর্বদলীয় এবং সর্বধর্মের মিছিল। এর মধ্যেই অবশ্য ত্রিপুরায় বামপন্থীদের বড় মিছিলের খবর পাওয়া গিয়েছে। বিবৃতি দিয়েছে, সিপিআই(এম) নেতৃত্ব। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলেছেন সংসদের বাইরে দঁাড়িয়ে, পরে বিশদ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস নেতারাও মুখ খুলছেন। তবে তা যেন বড় নম্রভাবে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজনৈতিক দলের ধর্মনিরপেক্ষতা মিনমিন করলে, তখন সংখ্যালঘু-তোষণের কথা আসবেই। প্যালেস্তাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা এড়িয়ে গিয়ে মৌলবাদের কম-বেশি নিয়ে আলোচনা ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক বিজ্ঞাপন নয়।

শেষে কিন্তু বলতেই হয়, বিজেপি কি এই আলোচনায় বাদ থাকবে? তাদের নেতারা সীমান্তে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে স্লোগান দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রে সরকার তো চালায় বিজেপি। তারা ঠিক কতটা জোরে হুংকার দিচ্ছে? না কি শুধুই আলগা বিদেশনীতির নিরিখে এক-দু’ লাইনের বার্তা? উলটে সেই বার্তায় আবার লাল চোখ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ– ভারতের বক্তব্য না কি তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।

এই মুহূর্তে কি পত্রপাঠ ডেকে পাঠানো যেত না সে-দেশের কূটনীতিকদের? দিল্লি বা কলকাতায় বসে থাকা সে-দেশের রাষ্ট্রদূতের হাতে ঢাকার টিকিট ধরিয়ে দেওয়া যেত না? ভারত থেকে আদানি কোম্পানির যে প্রচুর বিদ্যুৎ যায় বাংলাদেশে, যার জন্য বাংলাদেশ সময়মতো টাকা দেয় না বলে শোনা যায়, সেখানে বার্তা দেওয়া যেত না?
সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ, বাংলাদেশ থেকে এ-দেশে চিকিৎসা করাতে আসা মানুষদের দিয়ে মুচলেকা দেওয়ানো যেত না যে, নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশের নাগরিক বলে ঘোষণা করলে তবেই ভারতে ঢোকা যাবে? দমদম থেকে খানচারেক যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ঢাকার উপর চক্কর দিয়ে এলে কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যেত? হিংসামুক্ত পৃথিবী আমরা প্রত্যেকেই চাই। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে কঠোর তো হতেই হবে। দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে লড়াই যেমন এই বাংলার আওয়াজ, তেমনই পড়শি দেশেও যে গোলমাল চলছে– সেই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক নিন্দার প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের অভিযোগ ও বাস্তবের কূটনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় হাত ধরে চলে না। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক-হত্যার বিরুদ্ধে যেভাবে রাস্তা থেকে রাতভোর দখল হয়েছে, সেই একই তীব্রতার আন্দোলন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের নিরিখে হতেই পারে। কারণ, দুই বাংলা একে-ওপরের পাশের বাড়ি। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু উদারবাদী শিক্ষিত বাঙালিদের বার্তাটাও খুব দরকার।

শেষ করব এই বলে– তৃণমূল, কংগ্রেস বা সিপিআই(এম)কে তো তাদের স্বচ্ছ উত্তর দিতেই হবে। কিন্তু বিজেপিরও দায় আছে জানানোর যে, কেন্দ্রীয় সরকার কী করছে। দায় আছে– এই বঙ্গের প্রগতিশীল সংখ্যালঘুদের। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ আইএসএফ কী বলছে শুনতে হবে তো! এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের উদারবাদী হিন্দুদের বার্তা খুব পরিষ্কার থাকা উচিত। যে কোনও মূল্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করতে হবে এই পশ্চিমবঙ্গে, এই ভারতে। এই সুযোগে ভারতে সংখ্যালঘুদের উৎখাত করার কোনও চেষ্টা বাড়তে দিলে আরও উৎসাহ পেয়ে যাবে দু’-দেশের মৌলবাদীরাই। উদারবাদী, প্রগতিশীল, শিক্ষিত, বাংলাভাষী ‘সংখ্যাগুরু’ এবং ‘সংখ্যালঘু’ নাগরিক সমাজকে তাই এই হেমন্তে কঁাথাচাপা দিয়ে মুখ না-ঢেকে ধর্মনিরপেক্ষতায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • রাজনীতি, ধর্ম, ভাষার ভিন্নতা– এই তিনটি ‘চলরাশি’ রাষ্ট্র ভাগাভাগিতে বরাবর সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে এই উপমহাদেশে।
  • বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা পছন্দ করছে না– এটা পরিষ্কার।
  • কারণ, ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় হিন্দু বা মুসলিম, কোনও মৌলবাদের ঠাঁই নেই।
Advertisement