shono
Advertisement

বড়পর্দায় ভারতীয় সিনেমার আদিপুরুষ হীরালাল সেনের জীবন, পড়ুন ফিল্ম রিভিউ

সেই সময়ের কাহিনি কতটা তুলে ধরতে পারলেন পরিচালক?
Posted: 06:01 PM Mar 05, 2021Updated: 12:45 PM Mar 08, 2021

নির্মল ধর: ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ দাদাসাহেব ফালকের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে ক’বছর আগে ‘হরিশচন্দ্রচি ফ্যাক্টরি’ (Harishchandrachi Factory) নামে একটি সুন্দর ছবি বানিয়েছিলেন মারাঠি পরিচালক পরেশ মোকাশি (Paresh Mokashi)। তখন থেকেই ভাবনা ছিল কেন আমরা, প্রকৃত পথিকৃৎ হীরালাল সেনকে (Hiralal Sen) নিয়ে কোনও ছবি করছি না কেন?
বাঙালি হিসেবে এক বাঙালির কৃতিত্বকে সর্বভারতীয় স্তরে নিয়ে যেতেই পারিনি এতদিন। বঞ্চিত থেকে গিয়েছেন হীরালাল। তাঁকে অন্তত শ্রদ্ধা জানাতে পারলে কিঞ্চিৎ পাপস্খালন হতে পারে। যাই হোক, সেই কাজটা শেষপর্যন্ত করলেন অরুণ রায় (Arun Roy), যাঁর আস্তিনে রয়েছে ‘ওরা ১১’ এবং ‘চোলাই’ এর মতো জনপ্রিয় ও বিতর্কিত ছবি। শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় সিনেমায় হীরালাল সেনের অবদানকে মুছে দেওয়া কখনই সম্ভব নয়। তাঁর অনমনীয় সংগ্রামকে আন্দাজ করাও এখনও সম্ভব নয়।

Advertisement

সখের ফটোগ্রাফি থেকে সিনেমা তৈরির কাজে তরুণ হীরালালের আত্মনিয়োগের কাজটি সামাজিকভাবে তো বটেই, পারিবারিকভাবেও ছিল কাঁটায় ভরা। তখন সিনেমা ও নাটকের মানুষদের তেমন সুনাম ছিল না সামাজিক পরিমণ্ডলে। মেয়েদের তো নিম্মরুচির ভাষা বলা হত। হীরালাল সেই সব বাধা অতিক্রম করেই এগিয়েছিলেন সিনেমা তৈরির কাজে। তাঁকে সদর্থক সমর্থন জানিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলা নাট্যজগতের প্রবাদপ্রতিম মানুষ অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, যাঁর ক্লাসিক থিয়েটার তখন ছিল বাংলা নাটকের হৃৎপিণ্ড। অমর দত্তর সান্নিধ্য শুধু নয়, তাঁর সক্রিয় সহযোগিতা হীরালাল সেনকে বাড়তি সাহস জুগিয়েছিল। আবার একই সময়ে কট্টর ব্যবসায়ী জে এফ ম্যাডান বাংলায় সিনেমা দেখানোর কাজটি করছিলেন বিদেশ থেকে টুকরো টুকরো ছবি আনিয়ে। কলকাতার ময়দানে তাঁবু খাটিয়ে সেই ছবি দেখান হত। হীরালাল তখন ভাই মতিলালকে দায়িত্ব দেন তাঁর তোলা ছবি দেখানোর। মতিলালও তেমনটাই করছিলেন। সেন ভাইদের ফিল্মের ব্যবসা চলছিল বেশ ভালই। উপরন্তু ছিল অমরেন্দ্র দত্তর ক্লাসিক থিয়েটারে নাটকের আগে ও পরে তাঁর তোলা ছবির নিয়মিত প্রদর্শনী। কলকাতার বাঙালি দর্শক বেশি ভিড় করতেন হীরালালের তোলা দেশি ছবি দেখতে। এটা নিয়ে ম্যাডানের সঙ্গে লড়াই তো ছিলই।

চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক অরুণ রায়, খুবই বিশ্বস্ততার সঙ্গে এইসব খুঁটিনাটি তুলে এনে কাহিনির মধ্যে তথ্যচিত্রের মেজাজটাও সুন্দর বুনে দিয়েছেন। এনেছেন নটি কুসুমকুমারী ও অমরেন্দ্রর ঘনিষ্ঠতার গল্পও। কিন্তু অন্তর থেকে কুসুম থেকে হীরালালকে পছন্দ করতেন তাও দেখানো হয়েছে। ধ্বস্ত সময়ের হীরালালের প্রিয় ক্যামেরার দখল নেওয়ার চেষ্টা, তাঁর ভাই মতিলালের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে তোলার পেছনে ম্যাডান কোম্পানির চর হিসেবে কাজ করার কাহিনিও দেখানো হয়েছে।

[আরও পড়ুন: প্রথম 3D বাংলা ছবিতে জয়া, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফেরালেন ‘অলাতচক্র’র টিজারে]

স্যার সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধী বক্তৃতার যে ছবি তুলেছিলেন হীরালাল, সেই খবরও ব্রিটিশ পুলিশের কাছে চর মতিলালই দেয়। বাংলা সিনেমার ‘জনক’ হওয়ার লোভে হীরালাল সেনের ছবির গুদামে জে ফ ম্যাডানের আগুন লাগানোর ঘটনাটিও দেখানো হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত ওই আগুনের ঘটনা ‘দুর্ঘটনা’ বলেই জানা ছিল। অরুণ রায় সেই ঐতিহাসিক সত্যটি প্রকাশ করলেন। তাঁর গবেষণা ও সাহসকে ‘সাবাশ’ জানাতেই হবে। জানি, এর ফলে ভারতীয় সিনেমার পিতৃত্বের দাবিদার দাদাসাহেব ফালকের হাত থেকে হীরালাল সেনের হাতে চলে আসবে না ঠিকই, কিন্তু একটা দলিল তো রইল। অবশ্য এই প্রয়োজনীয় কাজটি করে রাখার জন্য তিনি ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ রইলেন। আর এতদিনে অনিবার্য ভুলের মাশুল গুনলেন। অরুণ রায়ের ছবিতে তথ্যের খুঁটিনাটির কী কী ভ্রান্তি বা বিকৃতি আছে, বা আছে কিনা, তার চাইতেও বড় কথা পরিচালক অবিমৃষ্যকারী বাঙালির হয়ে কাজটিত করলেন।

হ্যাঁ, তাঁর ছবি পরিপাটিভাবে তৈরি হলেও তৎকালীন বাস্তবকে সত্যিই কি তুলে ধরতে পারল? এ প্রশ্ন আসবেই। অমর দত্ত, হীরালালদের কোনও প্রতিবেশীকে দেখাই গেল না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বোঝাতে গুটিকয় দীন দরিদ্র মানুষের কাঠি হতে মিছিল কেমন যেন অবাস্তব লাগে। তাছাড়া, তখনকার পুরনো কলকাতা শহর দেখানোর ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কৃপণ। গোপী ভগতের ক্যামেরার সামনে পুরনো কলকাতার কোনও চেহারাই এল না। জানি, এই কম্পিউটার যুগে দাঁড়িয়ে সেটা পুনর্নির্মাণ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু কিছু চেষ্টা তো করা যেত। তার চাইতেও বড় কথা – এমন একটি তথ্যসমৃদ্ধ সিনেমা রঙিন হবে কেন? সাদা-কালোয় হওয়া উচিত ছিল, নিদেন পক্ষে সেপিয়া টোনে। তাহলে সময়ের একটা পরশ পেতে পারতেন দর্শক। এতো উচ্চকিত রঙের ব্যবহার ভাল লাগেনি। ময়ূখ-মৈনাকের আবহ কিন্তু ছবির বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তৈরি। ধন্যবাদ জুটিকে।

এবার রইল অভিনয়। বেশিরভাগ নতুন মুখ নিয়ে কাজ করেছেন অরুণ। সেটা প্রশংসনীয়। চেনা মুখে হীরালাল, অমর দত্ত, হেমাঙ্গিনী, কুসুমকুমারীদের আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধে হত। যেমনটি ঘটেছে ম্যাডানের চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে রাখায়। হীরালাল সেনের পাশাপাশি অরুণ রায় নিজের চিত্রনাট্য ক্লাসিক থিয়েটারের আমারেন্দ্রনাথ দত্তকেও প্রায় সমান প্রাধান্য দিয়েছেন, সুতরাং এই ছবি তৎকালীন বাংলা নাট্যচিত্রেরও একটা পরিবেশ তুলে আনে। বেশির ভাগ নতুন মুখ নিয়ে কাজ করেছেন অরুণ।  তরুণ নাট্যাভিনেতা অর্ণ মুখোপাধ্যায় হয়েছেন অমরেন্দ্রনাথ। তৎকালীন মেজাজ ও অভিনয়ের নাট্য ভঙ্গি সুন্দর এনেছেন তিনি। সবচাইতে অবাক করে দেন হীরালালের ভূমিকায় নতুন মুখ কিঞ্জল নন্দ। খুবই স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ তাঁর অভিনয়। চরিত্রায়নের ত্রুটি চিত্রনাট্যের, তাঁর নয়। অনুষ্কা চক্রবর্তীর হেমাঙ্গিনী এবং তন্নিষ্ঠা বিশ্বাসের কুসুম বিশ্বাস্য, আবেগ ও বিরহী মুহূর্তে স্বতস্ফুর্ত। মতিলালের চরিত্রে পার্থ বিশ্বাস তেমন সুযোগই পাননি। তবে এই ছবি তো একটা জীবন ও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার দলিল, সেখানে চরিত্রের জটিল দিকগুলোতেও একটু বাড়তি নজর দেওয়া উচিত ছিল। যার অভাব ছবিটিকে অনেকাংশেই প্রাণহীন করে তোলে।
অরুণ রায়কে ধন্যবাদ শুধু হারিয়ে যাওয়া কিংবা ভুলে মেরে দেওয়া বাঙালিকে বাংলা সিনেমার প্রকৃত জনককে সেটা জানিয়ে দেওয়ায়। এটাই এই ছবি দেখার একমাত্র কারণ হতে পারে।

[আরও পড়ুন: সুশান্ত মামলায় মাদক যোগ, রিয়া চক্রবর্তী-সহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এনসিবির]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement