‘নাইয়া’ পত্রিকার ১৯৯১-এর এপ্রিল সংখ্যায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি ব্যাপারটাকে বিকৃত করে রামকে যেভাবে হাজির করছে, সেই রাম ফায়ারিং রাম। রাম কিন্তু কখনওই ফায়ারিং নয়।’’ তখনও বাবরি ভাঙা হয়নি, বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে আসা দূরস্থান! লিখলেন অর্ণব সাহা।
‘হারুন’, সুদেষ্ণা বলল, ‘আমাকে চুমু খেয়েছে।’ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ভারতবর্ষ’ শুরু হচ্ছে এই বাক্যটি দিয়ে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২, যেদিন উন্মত্ত করসেবকদের দল চোখের নিমেষে গুঁড়িয়ে দিল বাবরি মসজিদ, ঠিক সেদিনই, কলেজবেলার বন্ধু পিনাকীর স্ত্রীকে বলপূর্বক শারীরিকভাবে ভোগ করেছিল হারুন। স্বামীর কাছে স্বীকারোক্তির মুহূর্তে সুদেষ্ণা পিনাকীর হাত শক্ত করে ধরে বলেছিল– ‘‘সে কি রোখ! সে কি আক্রোশ! যেন দাঙ্গায় নেমেছে। পুরো হিন্দু-মুসলমান করে তুলল ব্যাপারটা, জানো?… যেন খুনে। যেন খুন করছে।’’
মনে পড়বে, বাবরি ধ্বংসের পর দেশ জুড়ে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের রণধ্বনি নিয়ে লেখা সন্দীপনের সেই বিখ্যাত গদ্য– ‘বুট-পরা শ্রীরামচন্দ্রের পদধ্বনি’। চার দশক আগে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যে অভিযানের সূচনা, এই বছরের ২২ জানুয়ারি, খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যেন সে-বৃত্তই সম্পূর্ণ হল। ‘রামলাল্লা’ ফিরে এলেন অযোধ্যায়।
[আরও পড়ুন: যতকাণ্ড যোগীরাজ্যে, সরকারি টাকা হাতাতে দিদির কপালেই সিঁদুর দিলেন ভাই!]
১৮ হাজার কোটি টাকার ঐশ্বর্য, আড়ম্বর আর বৈভবে পরিপূর্ণ নতুন রামমন্দিরের গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত হলেন রামলালা। যেন মন্দির নয়, সঞ্জয় লীলা বনশালির নতুন সিনেমার মহার্ঘ সেট। কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন অযোধ্যা নগরীর চেহারা রাতারাতি বদলে গিয়েছে ঝঁা-চকচকে রাস্তাঘাট, অনবরত ঘণ্টাধ্বনি, লাউডস্পিকারে উচ্চকিত ভজন, স্টোন-কাটার আর রোড-রোলারের যান্ত্রিক ক্যাকোফোনির গগনবিদারী শব্দে।
‘নাগারা’ রীতির এই স্থাপত্যের সম্পূর্ণ আয়তন ৫৭,৪০০ বর্গ ফুট, ২০ ফুট উচ্চতার তিনটি তল, প্রত্যেকটির উচ্চতা ২০ ফুট। ডার্ক স্টোনে তৈরি ৫১ ইঞ্চি উচ্চতার রামলালার মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল এই মন্দিরে। উত্তরাখণ্ডের জ্যোতিষপীঠের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী যতই বলুন– ‘ভারতে চিরকাল রাজা আর ধর্মগুরুর আসন পৃথক এবং অসম্পূর্ণ মন্দিরে রামলাল্লার প্রাণপ্রতিষ্ঠা শাস্ত্রমতে অনৈতিক। এ কেবল ভাজপার রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট তোলার কৌশলমাত্র’– সেই অভিযোগকে আমল দেওয়ার কোনও তাগিদ কেন্দ্রের শাসক দল বিন্দুমাত্র বোধ করেনি। বরং রামনামে ভর করে তৃতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতাদখলের স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে তারা। শোনা যাচ্ছে, বারাণসীর বিখ্যাত জ্যোতিষী, জ্ঞানেশ্বর শাস্ত্রী দ্রাবিড়কে নাকি চাপ দেওয়া হয়েছিল মন্দির উদ্বোধনের দিনটি যে কোনও মূল্যেই ফেব্রুয়ারি শুরুর আগে ঘোষণা করার জন্য। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’-র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে? যেখানে হীরকরাজ নিজেই নিজের মূর্তি উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছিলেন– ‘বেলা দ্বিপ্রহরে মূর্তি উন্মোচন হবে!’
[আরও পড়ুন: ৪ মাসের নাতিকে ২৪০ কোটি দিলেন নারায়ণমূর্তি, ‘এজন্যই কি ৭০ ঘণ্টা খাটব?’ তোপ নেটদুনিয়ার]
কোন অযোধ্যাকে পিছনে ফেলে ভারতের এই নতুন কর্পোরেট ‘আধ্যাত্মিক নগরী’-র উত্থান ঘটল? এই নতুন কংক্রিট নগরীর ‘রামপথ’, ‘ভক্তিপথ’, ‘ধর্মপথ’, ‘শ্রীরামজন্মভূমিপথ’ গড়ে উঠেছে শয়ে-শয়ে ছোটখাট হিন্দু মন্দির, হিন্দুর বাসস্থান, দোকানপাট, মুসলিম বাড়িঘর বুলডোজারে পিষে দিয়ে। পুরনো স্থাপত্যের জায়গায় নতুন সৌধের নির্মাণ, অলংকরণ করা হয়েছে হালকা পিচ রঙে এলাকাকে রাঙিয়ে। রামলালা ৫০০ বছর বাদে এই নতুন তীর্থ– মেট্রোপলিসে ফিরে আসছেন বলে কথা! ১৭৮টি নবনির্মাণ প্রকল্পের জন্য, সরকারি হিসাবমতো ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গিয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা, আগামী ১০ বছরে এই অঙ্ক পৌঁছবে ৮৫ হাজার কোটি টাকায়। মহাঋষি বাল্মীকি বিমানবন্দরের জন্য আনুমানিক খরচ ১,৪৫০ কোটি টাকা, একইসঙ্গে ঢেলে সাজানো হচ্ছে অযোধ্যা ধাম রেলওয়ে স্টেশনটিকে।
দেশ-বিদেশের সব আমির লোকজন এখানে পর্যটনে আসবেন! তাই হোটেল-ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। বিভিন্ন পঁাচতারা হোটেল-চেন এখানে নতুন আস্তানা গেড়েছে– তাজ, র্যাডিসন ফোর্ট, আইটিসি-র পাশাপাশি কম দামি অজস্র ‘ওয়ো’ হোটেলের ছড়াছড়ি এই নতুন অযোধ্যায়। অযোধ্যার অন্যান্য প্রাচীন মন্দিরও তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই যেন একাধিক ‘হোমস্টে’-র আয়োজন করছে। যেমন, নয়াঘাটের ‘তিনকলস’ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত, ভাজপা নেতা ও অযোধ্যার মেয়র মহন্ত গিরিশ পতি ত্রিপাঠী এই মন্দিরের পাশেই খুলেছেন ‘রাঘব ইন’ সরাইখানা। ২২ জানুয়ারি, রামমন্দির উদ্বোধনের দিন, একশোরও বেশি চার্টার্ড ফ্লাইট নেমেছিল অযোধ্যা বিমানবন্দরে। অনেকেই বলছেন, অযোধ্যা এবার ‘ধার্মিক স্থান’ থেকে ‘ধন-ধার্মিক স্থান’-এ রূপান্তরিত হতে চলেছে। শুধু মন্দির নির্মাণেই ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। ‘কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স’-এর হিসাব অনুযায়ী রামমন্দির দেশ জুড়ে এক লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে।
সম্প্রতি, ‘ভাইরাল’ হওয়া এক ভিডিও ক্লিপে মন্দির ট্রাস্টের সম্পাদক, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীণ নেতা চম্পত রাই সমগ্র দেশের ভক্তদের উদ্দেশে বলেছেন, আর একটুও সোনাদানা মন্দিরে দান না করতে। কারণ, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। অযোধ্যার অপরাধ জগৎও হাত গুটিয়ে বসে নেই। রামমন্দিরের এক-একটি ৬০ কোটি টাকা মূল্যের সোনায় মোড়া দরজার লোভে যে কোনও দিনই হয়তো মন্দিরের পুরোহিতদের গলাকাটা দেহ পাওয়া যাবে– বলেছেন চম্পত রাই। আর্থিক বৈষম্য এখন এই শহরে অত্যন্ত গভীর। যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ এখানে চলেছে, তার বেশিরভাগ সুফলই পাবে বিভিন্ন বহিরাগত সংস্থা। সৌন্দর্যায়নের নামে যে বিপুল ধ্বংসকার্য চলেছে, তার জন্য ‘রাম কি পৈড়ি’-র আশপাশের অজস্র ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৬০-৭০ বছরব্যাপী যঁারা বসবাস করছেন, তঁাদের বাড়িঘরদোরও রেয়াত করা হয়নি।
যদিও উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন জানিয়েছে, অযোধ্যার ৮০ ভাগ জমিই ‘নাসুল’ বা ‘খাস সরকারি’ জমি, তা-ই উচ্ছেদ হওয়া মানুষজনকে অতি সামান্য ভরতুকি বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অথচ, বেণিগঞ্জের এক সরকারি ব্যাঙ্ক-কর্মী, রাজেন্দ্র যাদব জানিয়েছেন, তঁাদের জমি এবং বসতভিটে ১৯৩৮ সালে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল, যা এখনকার স্থানীয় প্রশাসন বেমালুম অস্বীকার করছে। ফৈজাবাদের ওয়াজিরগঞ্জে রেলব্রিজ নির্মাণের জন্য আটটি দোকান ও ছ’টি বাড়ি ভাঙা হয়েছে, যার বাজারমূল্য এই মুহূর্তে দু’-কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাওয়া গিয়েছে মাত্র ৫১ লক্ষ টাকার। পরিবেশ-বান্ধব অযোধ্যানগরী গড়ার জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে ডিজেলচালিত অটোরিকশা। এক হাজার রিকশাচালকের পেটে লাথি পড়েছে। তাদের পরিবার কীভাবে বেঁচে আছে, কারও সেই ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই।
অনেকেই বলছেন, এই নতুন অযোধ্যা শ্রীরামচন্দ্রর আদর্শ থেকে বহু দূরে সরে এসেছে। এখানকার বাসিন্দা, ঠিকাশ্রমিক, দিনমজুর, ছোট দোকানদার, কারিগর শ্রেণি কীভাবে এই নতুন অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকবে কেউ জানে না। ৩০০ বছরের পুরনো, মাটিতে মিশিয়ে-দেওয়া ‘দশরথ মহল’-এর সামনে দঁাড়িয়ে এক ভক্ত জানিয়েছেন– ‘শ্রীরামচন্দ্রর আদর্শের সঙ্গে এখনকার অযোধ্যার নতুন রামের কোনও মিল নেই। রাম সত্যপালনের জন্য বনবাসে গিয়েছিলেন। তঁার খড়ম সিংহাসনে রেখে পুজো করেছিলেন ভরত। রাম যুদ্ধজয় করেছিলেন, কিন্তু কোনও পরাজিত রাজার ভূমি তিনি দখল করেননি।’ যে আগ্রাসী তিরধনুকধারী যোদ্ধা রামের ছবি এখনকার অযোধ্যার সর্বত্র, যে পেশিবহুল রামের বিরাট কাট-আউট ও পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে রয়েছে শহর, তার সঙ্গে যুগ-যুগব্যাপী প্রচলিত রামচন্দ্রর মিল নেই। রাম-সীতা বসে আছেন সিংহাসনে, পায়ের কাছে দাস্যরসের প্রতীক হনুমান– এই সর্বাতিশায়ী দেবাবতারের ছবির সঙ্গে এই ‘কর্পোরেট’ রাম একেবারেই বেমানান। কয়েক শতকব্যাপী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ছবিও এই অযোধ্যায় নেই। ‘রামপথ’-এর একটি চক লতা মঙ্গেশকরের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। ঠিক এখানেই থাকতেন বেগম আখতার। তঁার নাম মনেও পড়েনি কর্তাব্যক্তিদের।
একদা সংস্কৃতের বদলে অাওয়াধি ভাষায় রামচরিত লেখার জন্য কবি তুলসীদাসকে চরম হেনস্তা সহ্য করতে হয়েছিল উচ্চবর্ণের সমাজপ্রভুদের কাছ থেকে। বিতাড়িত ‘রামচরিতমানস’-কার লিখেছিলেন– ‘মাং কে খাইব, মসিত (মসজিদ) মে শোইব।’ সেই করুণ রসের আখ্যান এখনকার এই জঁাকজমকপূর্ণ রামের প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যকাব্যে কোথাও অবশিষ্ট নেই। রাজনীতিই এখনকার রামকে নিয়ন্ত্রিত করছে।
‘নাইয়া’ পত্রিকার ১৯৯১-এর এপ্রিল সংখ্যায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র বলেছিলেন– ‘বিজেপি ব্যাপারটাকে বিকৃত করে রামকে যেভাবে হাজির করছে, সেই রাম ফায়ারিং রাম। রাম কিন্তু কখনোই ফায়ারিং নয়।’ দীর্ঘ কথোপকথনে গৌতম ভদ্র মনে করিয়ে দেন, উত্তর ভারতের নিম্নবর্গের মানুষের চেতনায় রামচন্দ্র একাধিক নিজস্ব ইলিউশনের সমাহার। সেখানে রাষ্ট্রিক যুক্তিবাদী ইতিহাস-ভাবনার বদলে বিশ্বাস, পরম্পরা, লোকশ্রুতির সম্পূর্ণ আলাদা ভূমিকা রয়েছে। বিজেপি সেই ইলিউশনকেই ‘টুইস্ট করে চলেছে… রাম যেন বাড়ির বড়োকর্তা। তার কাছে সবাই সমর্পণ করুক। রাম সবাইকে দেখবে– এই হল তুলসিদাস, একটি পবিত্র ভক্তির আধার। বিজেপি সেটারই সুযোগ নিচ্ছে।’ তিনি যখন এই কথাগুলো বলেছিলেন, তখনও বাবরি ভাঙা হয়নি, বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে আসা দূরস্থান। হালে, ম্যানিফেস্টো অনুযায়ী রামমন্দিরের উদ্বোধনের পরে, টের পাওয়া যাচ্ছে, কর্পোরেট হিন্দুত্বের কাছে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে ব্যবহার করা ছিল স্পষ্টতই একটি স্থির রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এ কোন অযোধ্যায় ফিরে এলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম, দুঃখীর ত্রাতা শ্রীরামচন্দ্র?