ভারতীয় সংবাদপত্রর সূত্রপাত নিঃসন্দেহে ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া জেমস হিকি-র ‘বেঙ্গল গেজেট অর অরিজিনাল ক্যালকাটা অ্যাডভার্টাইজার’ পত্রিকা। যদিও, সংবাদপত্র বলতে বর্তমানে যা বোঝায়, বেঙ্গল গেজেট তেমনটা ছিল না। দুপৃষ্ঠার কাগজে হরেক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যৎসামান্য সংবাদ যেটুকু থাকত, তা মূলত প্রভাবশালী লোকজন, বিশেষত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেচ্ছা। আর এই কেচ্ছা লিখনের বাড়াবাড়িই কাল হল হিকির! লিখেছেন ঋত্বিক মল্লিক।
১৮০২ সালের অক্টোবর মাস। মলাক্কা প্রণালী বেয়ে চিনের দিকে এগিয়ে চলেছে জাহাজ ‘আজাক্স’। জাহাজে আছে এক থুরথুরে বুড়ো, লোকটা ব্যবসায়ী না শল্যচিকিৎসক, ঠিক ঠাহর হয় না। সে নাকি চিনে যাচ্ছে জায়ফল, চা আর পোর্সেলিন আনতে। এদিকে সঙ্গে আছে একগাদা ওষুধ, কাটাছেঁড়া-চিকিৎসার যন্ত্রপাতি। ওকে নিয়ে বাকিদের কৌতূহলের শেষ নেই! কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য জাহাজেই পরলোকপ্রাপ্তি হল তার। আপাদমস্তক একটা হ্যামকে মুড়ে সেলাই করে প্রার্থনা-টার্থনার যথাসংক্ষিপ্ত পর্ব সেরে, ডেক থেকে সাগরের জলে দেহটা বিসর্জন দিলেন ক্যাপ্টেন। সেই সঙ্গে তলিয়ে গেল ভারতের প্রথম সংবাদপত্রর ইতিহাস।
লোকটার নাম জেমস অগাস্টাস হিকি। খবরের কাগজের ভারতীয় গোড়াটা ধরে টান মারলে যে শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে হয় ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া হিকি-র ‘বেঙ্গল গেজেট অর অরিজিনাল ক্যালকাটা অ্যাডভার্টাইজার’ পত্রিকার কাছে, সে-তথ্য চেনা। কিন্তু চেনা গল্পেরই অচেনা পৃষ্ঠার খতিয়ান দিচ্ছেন অ্যান্ড্রিউ ওটিস, তাঁর “আনটোল্ড স্টোরি অফ ইন্ডিয়া’জ ফার্স্ট নিউজপেপার” বইয়ে।
[আরও পড়ুন: জন্মের প্রমাণপত্র হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয় আধার! বড় সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের]
সংবাদপত্র বলতে বর্তমানে যা বোঝায়, বেঙ্গল গেজেট ঠিক সেই অর্থে সংবাদপত্র ছিল না। দুপৃষ্ঠার কাগজে হরেক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যৎসামান্য সংবাদ যেটুকু থাকত, তা মূলত প্রভাবশালী লোকজন, বিশেষত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেচ্ছা। খোদ ওয়ারেন হেস্টিংসকে ‘ওয়াইল্ড’, ‘ডিসগ্রেসফুল’, ‘উইকেড’, ‘ডেসপোটিক’ বিবিধ বাছা বাছা বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন হিকি। ট্যাবলয়েডধর্মী এই গেজেট-কেচ্ছায় হেস্টিংসকে ধ্বজভঙ্গ পর্যন্ত বলা হয়েছিল একবার। রাগের মূল কারণ অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
১৭৮০-তেই প্রায় একই সময় হিকি-র গেজেটের পাশাপাশি প্রকাশিত হয় ‘ইন্ডিয়া গেজেট’– ‘বেঙ্গল গেজেট’ পড়ে বেশ কঠিন লড়াইয়ের মুখে। এদিকে লবণ ব্যবসায়ী পেটার রিড এবং থিয়েটার প্রযোজক বার্নার্ড মেসিন্ক ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এর মূল প্রকাশক হলেও এর পশ্চাৎপটে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর অবদানের কথা ছিল প্রায় ‘ওপেন সিক্রেট’। তঁার পরোক্ষ সাহায্যেই বে-এক্তিয়ারি নানা বিষয়ে সুবিধা পেতে থাকে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’। ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর চেয়ে আকারে বড়, চার পৃষ্ঠার এই কাগজটি গুণমানে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ বাড়তে বাড়তে একসময় কুৎসিত আকার নিল, যখন হিকি কেবল কুৎসাকেন্দ্রিক খবর পরিবেশনেই আগ্রহী হয়ে পড়লেন।
[আরও পড়ুন: সমরশক্তিতে শীর্ষে আমেরিকা, তালিকায় কত নম্বরে ভারত ও চিন?]
কলকাতার জনপরিষেবা-সংক্রান্ত আধিকারিক এডওয়ার্ড টিরেটা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কনট্র্যাকটর চার্লস ক্রফটেস, বাংলার সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস এলিজা ইম্পে– কেউই হিকি-র আক্রমণ থেকে বাদ যাননি। সরাসরি আইনি আক্রমণ এড়ানোর জন্য এঁদের মূল নাম হিকি সাধারণত ব্যবহার করতেন না, বরং বেশ কিছু উৎকট ব্যঙ্গাত্মক নামে তিনি এঁদের কাজকারবার রসিয়ে তুলে ধরতেন পাঠকের কাছে। ইম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বাংলার কোনও এক নদীতীর মেরামতির জন্য পুলবঁাধ গড়ার চুক্তি থেকে তিনি ব্যক্তিগত মুনাফা তুলেছেন। ‘পুলবঁাধ’-এর সূত্র ধরে তঁার নাম হল ‘পুলবান্ডি’। এভাবেই ‘ক্র্যাম টার্কি’, ‘টেন্ট পোল ইম্প্রমটু’, ‘লুসি চিনলেস’, ‘পম্পসো ব্র্যান্ডি-ফেস’, ‘ডিক স্কুইব’, ‘ন্যাট চাক্লহেড’, ‘ম্যাক বেকন ফেস’ প্রভৃতি হরেক নামের ভিড়ে হিকি কদর্য আক্রমণ শানিয়ে তুললেন গেজেটের পাতায় পাতায়।
স্বাভাবিকভাবেই, ফল খুব একটা ভালো হল না। যদিও সব অভিযোগ সত্যি, আর সেজন্যই এই কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির চোট সরকারপক্ষকে ফেলল রীতিমতো অস্বস্তির মুখে। বিশেষ করে হিকি একেবারে সাপের লেজে পা দিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনের প্রধান মাথা কিয়েরনান্ডারকে চটিয়ে। অভিযোগ, কিয়েরনান্ডার নাকি কোনও অনাথ-আশ্রমের ফান্ড থেকে টাকা সরিয়েছেন!
তবে, এই সংঘর্ষের একটা পুরনো ইতিহাসও ছিল। ‘বেঙ্গল গেজেট’-এরও বছর তিনেক আগে, ১৭৭৭ সালে হিকি তঁার ছাপাখানা চালু করেছিলেন কলকাতায়। সেবছরেরই নভেম্বরে আগামী বর্ষের একটি ক্যালেন্ডার সেখান থেকে ছাপার জন্য হিকি-র সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিয়েরনান্ডার। কিয়েরনান্ডার তখন দক্ষিণ ভারত থেকে বর্ষপঞ্জি আমদানি করছিলেন, একইসঙ্গে খোঁজ করছিলেন কোথায় তুলনামূলকভাবে একটু সস্তায় সেগুলো ছাপা যেতে পারে।
কিন্তু হিকি যে দাম বললেন, তা কিয়েরনান্ডারের পোষাল না মোটেই। দরাদরি থামিয়ে বরং নিজেই ছাপাখানা তৈরির কাজে লেগে পড়লেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তঁার ছেলে রবার্ট ১৭৭৮ সালে একটি প্রেস তৈরি করে এগিয়ে এলেন, যদিও প্রেসটি ঠিক কোথায় ছিল, সে-সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য এখন আর পাওয়া যায় না।
এদিকে হিকিও নিজের প্রেস থেকে ক্যালেন্ডার ছাপছেন। সস্তা দামে ক্যালেন্ডার বিক্রির লড়াইয়ে হিকি-র সঙ্গে পেরে না উঠে একেবারে বিনামূল্যেই ক্যালেন্ডার বিলি করতে শুরু করলেন কিয়েরনান্ডার। উপরন্তু, হিকি-র ক্যালেন্ডারের চেহারা দেখেই কিয়েরনান্ডারের সন্দেহ বদ্ধমূল হল, এই বর্ষপঞ্জিটি নির্ঘাত তঁার থেকেই চুরি করা। সম্ভবত যখন প্রথমবার হিকি-র সঙ্গে ক্যালেন্ডার ছাপার প্রস্তাব নিয়ে কিয়েরনান্ডারের কথাবার্তা চলছিল, তখনই হিকি এটি আত্মসাৎ করেন।
জল গড়াল বহুদূর। অনাথ আশ্রমের তহবিল তছরুপের অভিযোগ দিয়ে শুরু, এরপর ‘ক্যানিন্ডার’ নাম দিয়ে নিজের কাগজে কিয়েরনান্ডারের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন হিকি। কিন্তু একদিকে হেস্টিংস, অন্যদিকে কিয়েরনান্ডার– এই দুই প্রবল প্রতিপক্ষর মধ্যে জোট গড়ে উঠলে, হিকি-র পক্ষে তার ফল হল বিষবৎ। যৌথ অভিযোগ দায়ের হল হিকি-র বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় অভিযুক্ত হিকি-র কাগজের উপর থেকে যাবতীয় সরকারি পরিষেবা সরিয়ে নেওয়া হল, ডাক পরিবহণও নিষিদ্ধ হল। অবশেষে ১৭৮১ সালের ১২ জুন হিকিকে গ্রেফতার করে ধরে আনা হল চোর-ডাকাত-খুনিদের সঙ্গে একই কারাগারে। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে একের পর এক লম্বা হল অভিযোগের ফিরিস্তি, হিকি-র কারাদণ্ডর মেয়াদ ক্রমশ বেড়েই চলল। প্রথমটায় অবশ্য মোটেই দমে না গিয়ে লড়াকু হিকি ন’-মাস ধরে জেলে বসেই কাগজ বের করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৭৮২ সালের মার্চ মাসে কোর্টের রায় মোতাবেক, বন্ধ হল হিকি-র কাগজ।
পরিবার, ছেলেপুলের পড়াশোনার খরচ নিয়ে প্রায় নাভিশ্বাস উঠল হিকি-র। সব বেচেবুচে বন্ধক দিয়ে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় যখন মারা যাচ্ছেন তিনি, সম্পত্তি নিলামে উঠলে দেখা গেল একটা ঘড়ি, ঝাড়বাতি আর পুরনো মদ ছাড়া আর কিছুই নেই বিক্রির খাতায়। কিন্তু ছিল আসলে আরও অনেক কিছু। ছিল সেই কালির বোতল, টাইপ, মেশিন– একদিন যা হিকি-কে করে তুলেছিল ভয়ানকতম প্রতিপক্ষ। যার জোরে সবচেয়ে বড় দু’টি সামাজিক প্রতিষ্ঠান– সরকার আর মিশনারি, কাউকেই রেয়াত করেননি হিকি। ইতিহাসের পরিহাস এমনই, যে-কালির জোরে একদিন বিকিয়ে যেত পাতার পর পাতা গেজেট, ভারতের প্রথম সংবাদপত্রর সেই কালিও বিক্রিযোগ্য বলেই বিবেচিত হল না। অকেজো বলেই সেদিন পড়ে রইল সব।
হিকি’স বেঙ্গল গেজেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ ইন্ডিয়া’স ফার্স্ট নিউজপেপার
বাই অ্যান্ড্রিউ ওটিস
ওয়েস্টল্যান্ড পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৮