সন্দীপ্তা ভঞ্জ: “শোনো, তুমি আমাকে একবার বলো উত্তম কুমার… বলো না!”- বসন্ত বিলাপ’-এর সিধুর সেই চিরস্মরণীয় সংলাপ। ছবির সংলাপে উত্তম কুমার হওয়ার সাধ জাগলেও বাস্তবের সিধু কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছিলেন চেহারার গড়ন ঠিক না হলেও কিংবা হিরোর চরিত্রে ঠাঁই না পেলেও, শুধুমাত্র অভিনয়ক্ষমতায় ঠাঁই পাওয়া যায় দর্শকের মনের মণিকোঠায়। চিরতরের জন্য। ভানু বন্দ্যোপাধায়, রবি ঘোষ, জহরের উত্তরসূরি তিনি। বাংলা কমেডি জগতের অন্যতম নক্ষত্র। রোগা-প্যাটকা চেহারা, শ্যামবর্ণ, পাট পাট করে ব্যাক ব্রাশড চুল… চেহারায় হিরো গোছের ভাব না থাকলে কী হবে, অ্যাটিটিউডে ষোলো আনা। কেমন একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব! এমনটাই নাকি ছিলেন অভিনেতা চিন্ময় রায়। তাঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের চোখে ‘চিনু’ এরকমই।
[প্রয়াত অভিনেতা চিন্ময় রায়, শোকের ছায়া বাংলা চলচ্চিত্র জগতে]
সালটা ১৯৭০। তপন সিনহার ছবি ‘সাগিনা মাহাতো’। সেই ছবির কাস্টিংয়ের সময় ঘটেছিল এক মজার ঘটনা। একদিন নাকি পরিচালক তপনবাবু চিন্ময় রায়কে নিয়ে গিয়েছিলেন ছবির মূল অভিনেত্রী সায়রা বানুর কাছে। সেই প্রথম সাক্ষাৎ সায়রাবানু এবং চিন্ময় রায়ের। তপনবাবু তাঁকে পরিচয় করালেন অভিনেত্রীর সঙ্গে। বলেছিলেন, এ তোমার নায়ক। এর নাম চিন্ময়। তারপরের ঘটনা যা ঘটেছিল, তা স্মরণ করতে গিয়ে চিন্ময়বাবু একবার বেশ মজা পেয়েছিলেন। তবে, আদতে সেই সময়ে কিন্তু ঘটেছিল ঠিক তাঁর উলটোটা। সায়রাবানুর নায়ক বলে কথা, চেহারায় একটা হ্যান্ডসাম গোছের ভাব তো থাকতেই হবে! কিন্তু, এ তো পুরো উলটো। কাজেই যা ঘটার তাই ঘটল। দেখে শুধু অবাকই হলেন না অভিনেত্রী। সঙ্গে নাকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ারও জোগাড় হয়েছিল তাঁর। মনে মনে বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন চিন্ময়বাবু। এ তো গেল প্রথম সাক্ষাতের কথা। দ্বিতীয় সাক্ষাতের ঘটনা আরও মজাদার। পরের দিন ধূমপানে ব্যস্ত অভিনেতা। পরনে তাঁর সাদা জামা সাদা প্যান্ট। হঠাৎ-ই কোত্থেকে সায়রাবানু এসে হাত রাখলেন চিন্ময়ের কাঁধে। শুধু তাই নয়। বললেন, ‘হাই চিনু! হাউ স্মার্ট ইউ আর।’ তখন নাকি পালটা চিন্ময়বাবুর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে স্মৃতিচারণে বেশ কয়েকবার এই মজার কথা শেয়ার করেছেন তিনি।
আরেক ঘটনা ‘হাটেবাজারে’ ছবি মুক্তি পাওয়ার পরের। একদিন তিনি শ্যামবাজার থেকে ডবল ডেকার বাসে উঠেছেন। জনা কয়েক তাঁর মতোই রোগা লোকও বাসে উঠেছেন। তাঁরা চিন্ময়বাবুকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনি ‘হাটেবাজারে’ ছবিতে অভিনয় করেছেন? অভিনেতারও সপাট জবাব, হ্যাঁ ভাই করেছি। তৎক্ষণাৎ ওদিক থেকেও বাণের গতিতে প্রশ্ন, আপনার চেহারা তো ভালো নয় রোল পেলেন কী করে? তাঁর থেকেও অবাক করে দিয়ে আসে আরেক প্রশ্ন, আচ্ছা আপনি কী অমুক অভিনেতার বাড়ির বাজার করে দেন?… ভাবুন কী অনাসৃষ্টি কান্ড! অত বড় মাপের অভিনেতাকে নাকি এরকমটাও শুনতে হয়েছিল।
ঢলা প্যান্ট, ঢলা শার্ট, তবে গোঁজা। মুখে গোঁজা ধুম্রকাঠি। অবলীলাক্রমে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, মুখে একটা রকের ‘গুরুদেব’ গোছের হাসি। যেন সবজান্তা। তবে, কর্মে অষ্টরম্ভা। টেনিদা হোক কিংবা সিধুর চরিত্র পর্দায় এভাবেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন অভিনেতা চিন্ময় রায়। ‘চারমূর্তি’তে তাঁর চেলা ক্যাবলা, প্যালার মতো অগণিত ভক্তই রয়েছে বাংলা সিনেমার দর্শককুলে। আর থাকবেও।
[মুক্তি পেল শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘কণ্ঠ’র পোস্টার]
যিনি অনায়াসে তাঁর হারকিউলিস গোছের চেহারা নিয়ে একটা স্ক্রিন প্রেসেন্সে, কটা মাত্র সংলাপ দিয়েই মাত করে দিতে পারেন। অনায়াসেই টেক্কা দিতে পারেন পাশের অভিনেতাকে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে যদি বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টরের জন্য পুরস্কার বরাদ্দ থাকত। অনায়াসেই তা বছর বছর অগুন্তি পুরস্কার বাগিয়ে নিতে পারতেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর চরিত্র ‘টেনিদা’কে তিনি যে বাঙালির আট থেকে আশি সবার মনেই গেঁথে দিয়ে গিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। কী অসম্ভব কমিক টাইমিং। ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘ননী গোপালের বিয়ে’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর মতো ছবিতে তাঁর চরিত্র সিনেপ্রেমীদের কাছে চিরস্মরণীয় থাকবে। বাঙালি চিরকাল মনে রাখবে উমানাথ ভট্টাচার্যের (চারমূর্তির পরিচালক) টেনিদাকে।
The post বাঙালি চিরকাল মনে রাখবে পর্দার টেনিদাকে appeared first on Sangbad Pratidin.