সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক শক্তি ইজরায়েল। ইয়ম কিপুর-সহ একাধিক যুদ্ধে পড়শি আরব দেশগুলোর হেনস্তার সাক্ষী ইতিহাস। শুধু তাই নয়, মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র চাইতেও নাকি বেশি দক্ষ ইজরায়েলের মোসাদ! জেহাদি নেটওয়ার্কের নাড়ির খবর টেনে বের করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। এহেন ইজরায়েল ও ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির কুলীন শিরোমণি মোসাদকে শনিবার কার্যত বেকুব বানিয়ে দিয়েছে হামাস। কেন হামলার কথা জানতে পারল না ইজরায়েল, কেনই বা অন্ধকারে মোসাদ? উঠছে প্রশ্ন।
৬ অক্টোবর, ২০২৩। ইয়ম কিপুরের মতোই ইহুদিদের আর এক উৎসব সিমহাত টোরার দিন গাজা ভূখণ্ড থেকে ইজরায়লের বুকে বেনজির হামলা শুরু করে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি সংগঠন হামাস। কেবল প্রায় ৫ হাজার রকেট নয়, গাজা থেকে মোটর গ্লাইডারে চড়ে আকাশপথে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে জেহাদিরা। জল ও স্থলপথেও ইজরায়েলের বেশ কয়েকটি এলাকায় ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধারা। আপাতত হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইজরায়েল। এখনও পর্যন্ত লড়াইয়ে নিহত অন্তত দেড় হাজার মানুষ। প্রশ্ন উঠছে, হামাসের এতবড় মাপের হামলার কথা জানতে পারল না কেন মোসাদ বা ইজরায়েলের সেনা। কোনও ইঙ্গিত পেল না কেন সিআইএ? অনেকেরই ধারণা, ইন্টেলিজেন্স ইনপুট পেলেও যথাযথ পদক্ষেপ করেননি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ইয়ম কিপুর যুদ্ধের বার্ষিকীতে বার্তা দিতেই হামলা চালিয়েছে হামাস। ১৯৭৩ সালেও ইজরায়েলিদের বড় অংশই উৎসবে মেতে থাকার সময়ে হামলা চালিয়েছিল আরব দেশগুলো। এ বারেও গাজা সীমান্তবর্তী এলাকায় উৎসবে ব্যস্ত ইজরায়েলি ও অন্য দেশের নাগরিকদের উপরে হামলার সুযোগ পেয়েছে হামাস।
[আরও পড়ুন: ‘খাবার-জল-বিদ্যুৎ সব বন্ধ’, গাজা দখলের নীল নকশা প্রস্তুত ইজরায়েলের]
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২১ সাল থেকেই এই হামলার প্রস্তুতি করছিল হামাস। এতে মদত রয়েছে প্যালেস্টাইনের জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক জেহাদ ও লেবাননের হেজবোল্লার। অভিযানের টাকা জুগিয়েছে ইরান। তবে এই প্রস্তুতিপর্ব এতটাই গোপনে ও ধোকার টাটিতে মোড়া ছিল যে ইজরায়েল বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কার্যত অন্ধকারে ছিল সিআইএ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ২০২১ সালের মে মাসে জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ইহুদি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুগামীদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। তার পর তা ক্রমে ভয়াবহ আকার নেয়। প্রায় ১১ দিন ধরে হামাস ও ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ওই সংঘর্ষে ২৫৬ জন প্যালেস্তানীয়র মৃত্যু হয়। সেবার হামাসের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে তেল আভিভ। সেই বিধ্বস্ত ছবিই ধরে রাখতে সফল হয়েছে হামাস। মাঝে মাঝে হম্বিতম্বি করলেও সুন্নি সংগঠনটি যে এই মাপের হামলা চালানোর ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে তা জানতেও পারেনি মোসাদ। কারণ, হামলার প্রস্তুতির কথা নাকি জানতেন না খোদ হামাসের অনেক শীর্ষ নেতারাই। রয়াটার্সের মতে, সংগঠনটির প্রধান ইসমাইল হানিয়েহ বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। ‘টেরর নেটওয়ার্ক চ্যাটার’ বা ফোন তথা অনলাইনে এই হামলা নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। আর হলেও সেই কোড ভাঙতে পারেনি মোসাদ। গাজা ভূখণ্ডেই হামলার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ১ হাজার হামাস যোদ্ধাকে। তবে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য তাদের ঘুণাক্ষরেও জানতে দেওয়া হয়নি।
ইজরায়েলি ফৌজের সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রাক্তন আধিকারিক আলন আরভাৎজের মতে, “ইজরায়েলি সেনা কীভাবে ফোন ও ইমেলে নজরদারি চালায় তা জানতে পেরেছে হামাস। তাই এই নজরদারি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তারা।” এছাড়া, হামাসের অন্দরে ‘হিউমিন্ট’ বা হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স জোগাড় করার মতো লোক প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়েছে ইজরায়েলের সেনা।
অনেকেই বলছেন, ২০২০ সালে আমেরিকার পৌরহিত্যে ইজরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে আব্রাহামিক অ্যাকর্ড হয়। নয়া চুক্তি মোতাবেক, ইজরায়েলকে (Israel) একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। প্রতিদানে প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এলাকা অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা স্থগিত করবে ইহুদি দেশটি। উল্লেখ্য, কয়েক দশকের সংঘাতে ইতি টেনে মিশর ও জর্ডনের পর আরব দুনিয়ার তৃতীয় দেশ হিসাবে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। ফলে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দিকেই বেশি নজর রয়েছে তেল আভিভের। তাই গাজার দিকে নজরদারিতে কিছুটা ঢিলেমি চলে আসে। একই সঙ্গে, ইজরায়েলের রাজনৈতিক ডামাডোল, একাধিক নির্বাচন, অস্থির সরকার ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপ করার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর চেষ্টার ফলে দেশে নজিরবিহীন বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সেই সঙ্গে সৌদি আরবের কাছ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি পেতে ওয়াশিংটন ও রিয়াধের সঙ্গে জটিল এক ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় ব্যস্ত ছিল নেতানিয়াহু সরকার। ফলে গাজায় হামাসের গতিবিধির উপর কিছুটা নজর হালকা হয়ে যায়। সেই সুযোগই নিয়েছে হামাস।
কেন দ্রুত হামলা রুখতে ব্যর্থ হয় ইজরায়েলের সেনা?
শনিবার গাজা ভূখণ্ড থেকে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে শয়ে শয়ে হামাস যোদ্ধা। গাড়ি, মোটরসাইকেল ও মোটর গ্লাইডারে চেপে দুর্গসম সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে দক্ষিণ ইজরায়েলের অন্তত বাইশটি জায়গায় হামলা চালায় হামাস জঙ্গিরা। হামলার কিছুক্ষণ আগে থেকেই প্রায় ৫ হাজার রকেট ছুড়ে ইজরায়েলি সেনাকে ব্যস্ত রাখে হামাস। সীমানা প্রাচীরের গায়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফাটল তৈরি করে তারা। সেই ফাটল চওড়া করতে আগে থেকেই বুলডোজার মজুত রাখা হয়েছিল। গাজা প্রাচীরের কাছে মোতায়েন ইজরায়েলি সেনার আউটপোস্টগুলোর কমিউনিকেশন সিস্টেম জ্যাম করে দেয় জঙ্গিদের কমান্ডো ইউনিট। এছাড়া, উৎসবের আমেজ থাকায় প্রহরাও কিছুটা শিথিল ছিল। সেই সুযোগে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে শয়ে শয়ে হামাস যোদ্ধা। একে বলে ‘সোয়ার্মিং ট্যাকনিক’। অর্থাৎ সংখ্যায় বলীয়ান হয়ে আচমকা হামলা করে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া। বিবিসিকে ইজরায়েলের এক আধিকারিক বলেন, “কুইক রিঅ্যাকশন ফোর্স হিসাবে কার করতে আমাদের সেনা ব্যর্থ হয়েছে। তারা দ্রুত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেনি।”