প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন ‘আমি’-সর্বস্বতার অসহায় শিকার। এবার কি বদলাল তঁার ভাষ্য, অহং বর্জন করলেন তিনি?
চাপ বলে চাপ! প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রায় রাতারাতি নিজেকে বদলে ফেলেছেন। গত দশ বছর ধরে ক্রমাগত ‘আমি’, ‘আমি’ করেছেন। এবং তঁার এই অবারিত আত্মপ্রেম উত্তরোত্তর বাড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ তিনি, নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর পরেই, ‘আমি’-র গজদন্তমিনার থেকে ‘আমরা’-র বাস্তবভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছেন। এবং অবরোহণের কারণ অবশ্যই নিখাদ রাজনৈতিক চাপ। এনডিএ সাংসদদের মিটিংয়ে তিনি সচেতনভাবে ‘আমি’-বর্জিত হয়ে ক্রমাগত বলতে লাগলেন এনডিএ শরিকদের কথাই। কিন্তু গত দশ বছর তো ‘আমি’-সর্বস্ব মোদির মধে্য দেখা যায়নি এই ‘আমরা’-র মোদিকে। কোথায় হঠাৎ গেল তঁার ‘আমি’-র দম্ভ?
তঁার কথা শুনে আমাদের মনে ধাক্কা মারে, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে স্বয়ং সম্রাট সিজারকেই। সিজার নাটকে প্রায় সারাক্ষণ নিজেকে ‘সিজার’ নামেই সম্বোধন করেছেন। সিজারের এখন মন ভালো নেই, সিজার এখন চাইছে যুদ্ধ কিংবা সিজার এখন চাইছে শান্তি। শেক্সপিয়র দেখাতে চেয়েছেন, যখন একটি মানুষ নিজেকে ‘থার্ড পার্সন’ বা তৃতীয় বচনে সম্বোধন করে, তার দম্ভ তখন আকাশস্পর্শী, সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এবং এই সেই ভয়ংকর সর্বনাশা দর্প, গ্রিক নাটকের ‘হিউব্রিস’, যার ফলে বিনাশ হয়ে ওঠে অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী!
[আরও পড়ুন: মোদির শপথে চাঁদের হাট, থাকবেন মুইজ্জু,হাসিনা-সহ ৭ রাষ্ট্রপ্রধান, রইল পূর্ণাঙ্গ তালিকা]
অ্যারিস্টটল তঁার ‘পোয়েটিক্স’-এ ‘হিউব্রিস’-কেই মানুষের চূড়ান্ত ট্র্যাজিক ‘ফ্ল’ বা দুর্বলতা রূপে দেখিয়েছেন, যার ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে পতন। শেক্সপিয়র দেখিয়েছেন, কীভাবে ‘হিউব্রিস’-এর প্রকাশ ঘটে একটি মানুষের ‘আমি’-সর্বস্বতার মধে্য। অহংকারের এই চূড়ান্ত অবস্থায় একটি মানুষ নিজেকে নিজের নামেই ডাকতে শুরু করে। এবং এভাবেই, সম্পূর্ণ চূর্ণ হওয়ার আগে, দর্প হয়ে ওঠে হাস্যকর। সিজার ব্রুটাসের ছুরি খেয়ে পড়ে যাওয়ার আগে, শেক্সপিয়রের নাটকে, বলেছেন– ব্রুটাস, তুমিও মারলে ছুরি, তাহলে সিজার, তুমি এবার পড়েই যাও, ‘দেন ফল্ সিজার!’ নেপোলিয়ন থেকে হিটলার, সবাই উঠেছিলেন এই হাস্যকর ‘হিউব্রিস’-এর শীর্ষে। এবং সবার মধে্যই প্রকাশিত হয়েছিল নিজেদের ‘থার্ড পার্সন’-এ সম্বোধন করার দুর্বলতা। এবং সবার পতনও হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্রমশ হয়ে পড়েছিলেন এই ‘হিউব্রিস’ বা হাস্যকর দর্পের অসহায় শিকার। তিনি একের-পর-এক দাম্ভিক, দর্পিত ভাষণে নিজেকে ‘মোদি’ নামেই সম্বোধন করতেন। বারবার যে কোনও প্রতিশ্রুতিকে বলতেন ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। কিংবা বলতেন, মোদি কথা দিয়ে যাচ্ছেন। কিংবা বলতেন, মোদির প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনের ফল বেরনোর পরেই, তঁার কণ্ঠস্বর, শরীরভাষা বদলেছে। নির্বাচন-পরবর্তী ভাষণে একবারও নিজেকে ‘মোদি’ (PM Modi) বলে সম্বোধন করলেন না, বরং ‘এনডিএ’ শব্দটিই প্রধান হয়ে উঠল। এ কি নবজাগরণ?