দীপংকর দাশগুপ্ত: আধুনিক মানুষ নানা পরিষেবা পেয়ে অভ্যস্ত। মাসের শেষে একটি বিল আসে। সেই বিলে আজকাল প্রায়শই লেখা থাকে যে, বিলটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দিলে কিছু ছাড় পাওয়া যাবে। বৈদ্যুতিন মাধ্যম বলতে কম্পিউটার বা ফোন সহযোগে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে টাকা চুকিয়ে দেওয়া। বিল আসা আর সেই বিলের টাকা চুকিয়ে দেওয়া সবই হয় যন্ত্রের সাহায্যে। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে নিশ্চয়ই। অনেক সময়েই যে যান্ত্রিক ই-মেল মাধ্যমে বিলটি এসে হাজির হয়, সেই বিল আদৌ গ্রাহকের বিল নয়। একটু অন্যমনস্ক থাকলে পরেশবাবুর কাছে নরেশবাবুর বিল আসে, কারণ যন্ত্র পরেশ আর নরেশের মধ্যে তফাত তেমন ভাল বোঝে না। ফলে একই মানুষ পরেশবাবু ও নরেশবাবুর বিল দিয়ে ফেলেন একই মাসে।
[আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’! বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নীতীশ প্রশাসনের]
যন্ত্র কেন এমন করে, জানতে হলে সংস্থাটিকে ফোন করার প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই ফোন কেউ ধরে না। তারপর লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দেওয়ার ঝামেলা-টা এড়িয়ে, ঘরে বসে কাজটি করার সুবিধা পাওয়া-র মাশুল গুনতে হয়, শেষমেশ সেই সুদীর্ঘ লাইনের পিছনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর অর্থনীতি অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকে না, হইহই করে দৌড়ে চলে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রা কি সত্যিই সুখকর হয়ে চলেছে, না কি কোন যন্ত্রের কোন বোতাম টিপে কোন নরকে উপনীত হতে হবে, সেই চিন্তায় মানুষকে দিবা-রাত বিভোর থাকতে হয়?
আরেকটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্টতর হয়। এবার অপরেশবাবুর কথা ধরা যাক। হঠাৎ তাঁর ফোনে মেসেজ এল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ফোন কেটে দেওয়া হবে, কারণ কেওয়াইসি নিয়ে সমস্যা আছে। অপরেশবাবু সঙ্গে সঙ্গে টানে ফোন পরিষেবার আপিসে ফোন করলেন। একটি যান্ত্রিক কণ্ঠ ভেসে এল, কী কী পরিষেবার জন্য কী কী বোতাম টিপতে হবে সেই লিস্টি নিয়ে। কিন্তু তিনি যে-কথাটা জানতে চান, সেটা লিস্টিতে নেই। কারও সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা আলোচনা করার সুযোগ না দিয়েই ‘লাইন’ কেটে গেল। আবারও অনেক চেষ্টা করলেন। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তারপর ঠিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অকস্মাৎ তাঁর ফোন বেজে উঠল। অপর দিক থেকে এক ব্যক্তি বললেন, আপনার কেওয়াইসি আপডেট করা নেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আপনার ফোন কাজ করবে না। ঘাবড়ে গিয়ে অপরেশবাবু বলেন- ফোনের কেওয়াইসি? সে আবার কী? আমি তো সিম কার্ড নেওয়ার সময় আধার কার্ডের কপি জমা দিয়েছিলাম। তাহলে কি সেটাই আবার জমা দিতে হবে? উত্তরে শোনেন- না, এটা আমরা ফোন পরিষেবার আপিস থেকেই করে দিচ্ছি। আপনার বিল জমা দেওয়ার অ্যাপটা খুলুন। সেখান থেকে জমা দিন। অপরেশবাবু বলেন- কী জমা দেব? অ্যাপ দিয়ে তো আধার কার্ডের কপি জমা দেওয়া যায় না। উত্তর আসে- না না, ওসব করতে হবে না। ফোন চালু রাখার জন্য কেবল দশ টাকা জমা করে দিন। এটাই ‘কেওয়াইসি’ চালু রাখার নিয়ম হয়েছে। অপরেশবাবু ভাবেন- যাক বাঁচা গেল। ফোন পরিষেবার আপিসে গিয়ে দাঁড়িয়ে লাইন দেওয়ার চেয়ে এ ঢের ভাল। সামান্য দশ টাকার তো মামলা। তিনি বলেন- ঠিক আছে, দিয়ে দিচ্ছি। অপর পক্ষ বিগলিত কণ্ঠে বলে- আপনার ফোনে ‘টিম ভিউয়ার’ অ্যাপ খোলা আছে তো? ওটা ছাড়া আমরা কাজটা করতে পারব না। ওটা খুলে রাখুন, তাহলে খুব সহজেই আপনার কেওয়াইসি হয়ে যাবে। অপরেশবাবু বিপদে পড়েন। বলেন- ‘টিম ভিউয়ার’? সেটা কী ভাই? কেমন করে খুলব?
অচেনা কণ্ঠস্বরটি সরল করে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। অপরেশবাবু সহজেই তাঁর ফোনে টিম ভিউয়ার খুলে ফেলেন। বেশ খুশি খুশি ভাব, এই বয়সে এত সব যন্ত্রপাতি বুঝতে পারা সহজ কথা নয়! এবার অপর পক্ষ বলে- শুনুন, আপনার ব্যাংকের পাসওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলে কাউকে বলবেন না কিন্তু। আপনার সব টাকা পয়সা তুলে নেবে। সাবধান। অপরেশবাবু খুশি হয়ে বলেন- অবশ্যই। কণ্ঠস্বর এবার বলে– তাহলে আপনার ফোন থেকে পরিষেবার অ্যাপ দিয়ে দশ টাকা জমা করে দিন। দক্ষতার সঙ্গে অপরেশবাবু কাজটা করে ফেলেন। কেবল যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হওয়ায় তিনি জানেন না যে, টিম ভিউয়ার দিয়ে তাঁর ফোনে তিনি কী করছেন সবকিছু অপর পক্ষ দেখছে। বিশেষ করে সামান্য দশ টাকা জমা দেওয়ার জন্য যে লগ ইন ও পাসওয়ার্ড তিনি ব্যবহার করলেন, সেগুলো চালান হয়ে গেল অন্যত্র। তারপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ব্যাংক থেকে তাঁর কাছে ‘মেসেজ’ এল যে তিনি ৭৫ হাজার টাকা দান করেছেন কোনও এক অজানা সংস্থাকে। ব্যাংকে পড়ে আছে পাঁচশো টাকা!
অপরেশবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাংকে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে জানলেন যে, খবরটা তাঁকে জানাতে হবে লালবাজারে ফোন করে। স্থানীয় থানায় গেলেই সব করা যাবে। তাই গেলেন এবং থানার কর্তারা তাঁকে লালবাজারে খবরটা দিয়ে একখানা ডকেট নম্বর নিতে বললেন। সেই ডকেট নম্বর নিয়ে আবার ব্যাংকে গিয়ে জানালেন। জিজ্ঞেস করলেন- ভাই টাকাটা কি ফেরত পাওয়ার কোনও উপায় আছে? ব্যাংক বলল- নেই বলেই ধরে নিন, তবে আমরা চেষ্টা করব। অপরেশবাবুর পকেটে এখন ডকেট অবশ্যই আছে। তবে আর বিশেষ কিছু নেই। তাই তিনি হাঁপা চ্ছেন। প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি কিন্তু হনহনিয়ে এগচ্ছে।