এখনও দোকানের বোর্ডে লেখা। শুরু ১৯৪২ সালে। সুভাষচন্দ্রর জন্মদিনে আজও বিনামূল্যে তেলেভাজা বিলি করবে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স। লিখছেন সম্বিত বসু।
১৯৪২ সাল। স্বাধীনতা আসতে তখনও বছর পাঁচ বাকি। মাত্র এক বছর আগেই চলে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ’৪১ সালেই নেতাজি সুভাষচন্দ্রও ভারত ছেড়ে অন্তর্ধানে। আগস্ট মাস নাগাদ সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করা হয় ও দক্ষিণের নানা জেলে বন্দি করে রাখা হয় তাঁকে। এসব মিলিয়ে শোকাকুল গোটা দেশ। এদিকে আবার সৈন্য চালাচালির হিসাবে ইংরেজ আর মার্কিনদের সাউথ-ইস্ট এশিয়ান কমান্ডের প্রধান সামরিক ঘাঁটি করা হয় কলকাতাই। চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও। তবু স্বাধীনতার স্বপ্নে বিষের ছোবল পড়েনি। ছোবল যে পড়েনি, তার একটি প্রমাণ–
’৪২ সালের জানুয়ারি মাস। এক বাঙালি ভদ্রলোক একটু ইতস্তত হয়ে রাস্তায় লোকজনকে একটু থামতে বলছেন। দাঁড়ানো মাত্র কিছু একটা দিচ্ছেন। সময় ব্যয় করছেন না একেবারেই। ভদ্রলোকের হাতে একটি ঠোঙা। কাগজের।
স্বদেশি যুগের এই ঠোঙায় লুকিয়ে থাকতে পারত নিশ্চিতভাবেই বহু গোপন ছক, বোমার মশলা, রিভলভার, ছোট্ট চিঠি, পরবর্তী বৈঠকের স্থানকাল। কিন্তু তাঁর কাছে এহেন কিছুই ছিল না। কিন্তু বিপ্লবের স্বপ্নে তিনিও কম বিভোর ছিলেন না। ঠোঙাতে ছিল চপ। আজ্ঞে হ্যাঁ! তারিখটা আরও স্পষ্ট করে বললে ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪২। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। তখন লোক ডেকে হইহই করে খাওয়াতে পারছেন না সেই ভদ্রলোক। কারণ ব্রিটিশ আমল। জন্মদিনে কেক কাটাই এখন রীতি। পুরনো বাঙালি রেওয়াজ মেনে চললে পিঠে-পায়েস আবশ্যক। তাহলে কেন চপ?
[জন্মজয়ন্তীতে নেতাজিকে স্মরণ, দেশনায়ককে শ্রদ্ধা মোদি-মমতার]
১৯১৮ সাল। খেঁদু সাউ চলে এসেছেন কলকাতায়। বিহার থেকে প্রথমে হাওড়ায়, তারপর ‘রূপবাণী’ সিনেমা হলের সামনে তাঁর ছোট্ট চপের দোকান। আলুর চপ, পিঁয়াজি, ফুলুরি, আরও নানা আইটেম। নিজের হাতেই ভাজতেন তিনি। তেলেভাজার এই জাদুবিদ্যায় আর দ্রব্যগুণে দোকানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতার নানা কোনায়। দুয়ের দশকের মধ্যভাগ। খেঁদু সাউ চলেছেন তাঁর তেলেভাজা নিয়ে। সঙ্গে কেটলি। তাতে গরম চা। সঙ্গে খবরের কাগজ। কোথায় চলেছেন? কোনও দিন মানিকতলা, কোনও দিন কাশীপুর। যেদিন যেখান থেকে অর্ডার আসে। অর্ডার কিন্তু সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি থেকে আসেনি। আসে বিপ্লবীদের গোপন ডেরা থেকে। সেখানে পৌঁছে খেঁদু সাউ পেতে দেন একটি খবরের কাগজ। তার উপর বেঁটে পাহাড়ের মতো মুড়ির স্তূপ বানিয়ে তোলেন। তারপর চপ, পিঁয়াজি, ফুলুরি বের করে রাখেন একে একে। গোল হয়ে বসা বিপ্লবীদের মুখে তখন শহরের প্রান্ত প্রান্ত কীভাবে ইংরেজবিমুক্ত করে তোলা যায়– সেই স্বপ্নের ধারাভাষ্য চলছে। একজন সাধারণ মানুষ হয়েও তাঁর চোখ চকচক করে উঠেছিল। একমুঠো করে মুড়ি তুলে নিচ্ছিলেন সেই সব বিপ্লবীরা, আর তাঁরই হাতের তেলেভাজায় কামড়। যে শরীর স্বাধীনতার জন্য পুলিশের গুলি খেতে সদাপ্রস্তুত, যে শরীর মৃত্যুকে ডরায় না, সেই শরীরকে পুষ্ট করছে তাঁরই তেলেভাজা। তাঁদের চিন্তাকে উসকে দিচ্ছে তাঁরই হাতনির্মিত চা।
এমন চলতে চলতেই খেঁদু সাউও জড়িয়ে পড়লেন এই আন্দোলনে। তাঁকে বিপ্লবীরা তেলেভাজা খাওয়ার ছলেই বলে যেত গোপন খবর, ঠিক রাত্রি ক’টায়, কখন কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। তিনি গোপন ডেরায় গিয়ে বলে আসতেন সেই খবর। এই রকমই একটি ঠেকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল নেতাজির। তখনও ‘নেতাজি’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি, কিন্তু মনে রেখেছিলেন সুভাষচন্দ্রকে। এরপর খেঁদু সাউয়ের কী আর করার থাকতে পারে? যখন অনেক পরে তিনি দেখছেন এই সেই মানুষ, যাঁকে তিনি তেলেভাজা খাওয়াতে পেরেছেন। নিজেকে এর থেকে আর কী উপায়েই বা অনুপ্রাণিত করতেন তিনি? রিভলভার না, বোমা না, নেতাজির জন্মদিনে সেই ’৪২ সাল থেকেই চপ বিলি করে আসতে থাকলেন তিনি।
১৯৪২ সালে হাতিবাগানে জাপানি বোমা পড়েছিল। খেঁদু সাউয়ের দোকানের পাশের গলিতেও বোমা থেকে বেরনো লোহার টুকরো এসে পড়ে। কলকাতার অনেকেই তখন পালাচ্ছেন প্রাণভয়ে, নিজের বসতবাটি ছেড়ে। পালাননি খেঁদু সাউ। কারণ মৃত্যুভয়ে ভীত হতে তিনি শেখেননি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ’৪৮ সালের জন্মদিনে এই তেলেভাজা বিলি আর চোরাগোপ্তা রইল না। দোকানের বাইরে বোর্ড ও নেতাজির ছবি লাগিয়ে চলল লোকজন খাওয়ানো। লাইন পড়তে লাগল বিশাল। বড়দের চারটে ও ছোটদের দুটো। দোকানের নাম লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স। লোকে চেনে ‘নেতাজির চপের দোকান’ বলেই। ২০১৯ সালে এসেও ঐতিহাসিক রীতিটির কোনও নড়চড় হয়নি। খেঁদু সাউয়ের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ থেকে বর্তমানে নাতি কেষ্টকুমার সাউ (গুপ্ত), প্রপৌত্র সুধাংশু সাউ (গুপ্ত) বাঁচিয়ে রেখেছেন এই রেওয়াজ।
[রাহুলের টুইটে নেতাজির মৃত্যুদিন, ঐতিহাসিক ভুল কংগ্রেস সভাপতির]
আজও দোকানের বোর্ডে লেখা রয়েছে ‘নেতাজির চরণে ভরসা’। সেই ভরসা খেঁদু সাউ থেকে রক্তবাহিত হয়ে সুধাংশু সাউ পর্যন্ত এসেছে। শতবর্ষ পেরিয়ে এসেছে এই দোকান। তেলেভাজার স্বাদবদল ঘটেনি। তবে আগের মতো পলতার চপ এখন আর পাওয়া যায় না, যা কিনা সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তর অতিপ্রিয় ছিল। জহর রায় থেকে অঞ্জন দত্ত– সামনেই রূপবাণী ও মিনার্ভা থিয়েটারের জন্য সেলেব্রিটিদের যাতায়াত লেগেই থাকত।
এই বছরও তেলেভাজা ভাজা হবে মোট তিন জায়গায়। দেওয়া হবে প্যাকেটে করে। আগের মতোই এইদিন কোনওরকম বিক্রিবাটা চলবে না এই দোকানে। চলবে না টাকাপয়সার লেনদেন। ২৩ জানুয়ারি শ্রদ্ধার। নেতাজির প্রতি। এক অকৃত্রিম নেতাজিভক্ত খেঁদু সাউয়ের প্রতিও।
The post নেতাজির জন্মদিনে আজও বিনা পয়সায় তেলেভাজা বিলি করে শহরের এই দোকান appeared first on Sangbad Pratidin.