shono
Advertisement

‘দেশের সংস্কৃতি, আইন মানতে না পারলে বেরিয়ে যাও’, ব্রাসেলস-দাঙ্গা নিয়ে বিস্ফোরক রাইডার

কাতার বিশ্বকাপে মরক্কোর কাছে বেলজিয়ামের হার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
Posted: 02:23 PM Nov 28, 2022Updated: 02:55 PM Nov 28, 2022

কৃশানু মজুমদার ও মণিশংকর চৌধুরী: বেলজিয়াম (Belgium) অশান্ত। কাতার বিশ্বকাপে (Qatar World Cup 2022) রবিবার মরক্কোর (Morocco) কাছে হার মেনেছেন রোমেলু লুকাকুরা। তার পর থেকেই বেলজিয়ামের রাজধানী শহর ব্রাসেলস জুড়ে অশান্তির আগুন। দাঙ্গাবাজরা আগুন ধরিয়ে দেয় গাড়িতে। ইট ছুঁড়ে ভাঙচুর করা হয় গাড়ি। লাঠি হাতে অনেককেই ব্রাসেলসের রাজপথে দেখা গিয়েছে। দাঙ্গাকারীদের শান্ত করতে পথে নামে পুলিশ। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ব্যবহার করা হয়েছে। 

Advertisement

দেশের এই অশান্ত পরিস্থিতিতে একই সঙ্গে ব্যথিত এবং অসহায় বোধ করছেন ফিলিপ দি’ রাইডার (Philippe De Ridder)। এদেশের ফুটবলে বেশ পরিচিত মুখ তিনি। ইস্টবেঙ্গল কোচের রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে এদেশে এসেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় এসে লাল-হলুদকে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন বেলজিয়ান কোচ। গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত সেবারের ফেডারেশন কাপে একটিও গোল না খেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। পরে বাইচুং ভুটিয়ার ক্লাব সিকিম ইউনাইটেডকেও কোচিং করিয়েছেন। এখন স্পেনের টেনেরিফে ছুটি কাটাচ্ছেন তিনি। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল যখন রাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন সদ্য তাঁর ঘুম ভেঙেছে। কফির মগ হাতে দেশের উত্তাল পরিস্থিতির খোঁজখবর নিচ্ছেন। বেলজিয়ামে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের কাছে খবরাখবর নিচ্ছেন। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে রাইডার বলছেন, ”দেশের এই পরিস্থিতিতে আমি ব্যথিত। আমরা বেলজিয়ানরা উদারমনস্ক। তবে গত ২০-৩০ বছর ধরে পরিস্থিতি রীতিমতো জটিল হচ্ছে। ধিকিধিকি করে জ্বলছিল আগুন। রবিবার মরক্কোর কাছে বেলজিয়ামের হার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। কোনও অশান্তির জন্য ব্যক্তিবিশেষ বা নির্দিষ্ট কোনও সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। তবে অশান্তি ছড়ানোর জন্য দাঙ্গাবাজরা বেলিজয়াম-মরক্কো ম্যাচকেই বেছে নেয়। মরক্কোর জয়ের পরে ব্রাসেলসের রাস্তায় রাস্তায় নেমে পড়ে দাঙ্গাবাজরা। যথেচ্ছ ভাঙচুর করে ওরা।”

[আরও পড়ুন: মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জয়ের উদ্দাম সেলিব্রেশন, খালি গায়ে ড্রেসিংরুমে নাচ মেসির!]

 

উল্লেখ্য, বেলজিয়ামে মরোক্কানদের বাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই। ১৯১২ সালে উত্তর আফ্রিকার দেশটি ও অন্যান্য কলোনি থেকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোর জন্য হাজার হাজার মরোক্কানকে ইউরোপে নিয়ে আসে ফ্রান্স। ওই শ্রমিকদের অনেকেই সীমানা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে বেলজিয়ামে। বংশানুক্রমে তাঁরা থেকে যায় সেই দেশে। শুধু মরক্কো নয়, সাম্রাজ্যবাদী অতীতের ‘পাপস্খলনে’ কঙ্গোর বহু মানুষকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় বেলজিয়াম। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধে বহু শরণার্থীকে আশ্রয় দেয় বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো। তার পর থেকে খুন, ধর্ষণ-সহ দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলিতে। ব্যতিক্রম নয় বেলজিয়ামও। সুইডেন, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসে অভিবাসন বিরোধী হাওয়া জোরাল হয়। ২০২০ সালে কোরান পোড়ানোর চেষ্টা করায় উগ্র ড্যানিশ দক্ষিণপন্থী নেতা রাসমুস পালুদানের পাঁচ সমর্থককে ব্রাসেলস থেকে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। ওই সময়ও সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা গিয়েছিল ব্রাসেলসে।

বেলজিয়াম চিরকালই মুক্তমনা। দু’ বাহু বাড়িয়ে আশ্রয়হীনদের কাছে ডেকে আপন করে নেয় এই দেশ। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন হাজার হাজার শরণার্থীদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় বেলজিয়াম। ‘উই ওয়েলকাম রিফিউজিস’-এই প্ল্যাকার্ড হাতে শহরের রাজপথে দেখা যায় অসংখ্য বেলিজয়ানকে। সমুদ্র সৈকতে আইলান কুর্দির মৃতদেহ গোটা বিশ্বের চোখে জল এনেছে। বেলজিয়াম কিন্তু এরকম অসংখ্য আইলান কুর্দিদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছে। নিরাপদ আশ্রয়ে সেই সব শিশুরা। 

অথচ অভিবাসনের একটা নেতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হচ্ছে বেলজিয়ামে। মুক্তমনা দেশের আজকের এই অশান্ত পরিস্থিতির জন্য দায়ী মরক্কোর মুসলিম মৌলবাদীরা। খবরের ভিতরকার খবর তেমনটাই বলছে। যদিও মরোক্কান সম্প্রদায়ের অনেকেই এই মৌলবাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই জটিল বেলজিয়ামে। গত কয়েকবছর ধরে মরোক্কান অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে এদেশে। মরোক্কান অভিবাসীরা বেলজিয়ানদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হচ্ছেন। ফলে উত্তর আফ্রিকার দেশটির মানুষের স্রোত ক্রমবর্ধমান ইউরোপের এই দেশে। এহেন পরিস্থিতিতে সাধারণ বেলজিয়ানদের অবস্থা নিজের দেশে পরবাসীর মতো। মরোক্কান সম্প্রদায়ের মানুষরা বেলজিয়ামের সাধারণ নাগরিককে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছিল, এক বেলজিয়ান ফুটবল ভক্ত মোলিনবিকের এক স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাচ্ছিলেন। স্টেডিয়ামে পৌঁছনোর জন্য তিনি বাসে ওঠেন। সেই বাসে মরোক্কান ফুটবল-সমর্থকের সংখ্যা বেশি ছিল। তাঁরা সেই বেলজিয়ান-ফুটবলভক্তকে অন্য নজরে দেখতে শুরু করেছিল। সেই বেলজিয়ান তখন রীতিমতো অসহায়। অস্বস্তিবোধ কাজ করছিল তাঁর মধ্যে। মরোক্কানরা এমনভাবে সেই বেলজিয়ান-সমর্থককে দেখছিলেন যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনে হচ্ছিল, তিনি যেন বিদেশি। রাইডার বলছেন, ”যে জায়গায় ঘটনাটা ঘটেছে সেই জায়গাটাকে ব্রাসেলসের হৃদপিন্ডই বলা চলে। গ্র্যান্ড প্লেস থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। অনেক রাজপথই এসে মিশেছে এই গ্র্যান্ড প্লেসে। শুনছি একটা রাস্তা নাকি পুরোদস্তুর চলে গিয়েছে দাঙ্গাবাজদের দখলে।”

ভারতে কোচিং করিয়ে যাওয়া রাইডার আরও বলেন, ”আমি সবাইকে শ্রদ্ধা করি। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে বলবো, যে দেশে আপনি থাকছেন এবং কাজ করছেন, সেই দেশের সংস্কৃতি এবং আইনকে শ্রদ্ধা করা উচিত। যদি সেই দেশের সংস্কৃতি, আইন, নিয়মের সঙ্গে একমত হতে না পারেন সংশ্লিষ্ট কেউ, তাহলে সেই দেশ ছেড়েই তাঁর চলে যাওয়াই উচিত। এই পৃথিবী অনেক বড়। আমার মতে ভারতের মানুষ বেলজিয়ামের এই পরিস্থিতির কথা উপলব্ধি করতে পারবেন।” রাইডার ভুল কিছু বলেননি। এই দেশও তো রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের সমস্যায় দীর্ণ।

বেলজিয়ামে মরোক্কান পরিবারের সংখ্যা ইতিমধ্যে এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে সেখানকার স্কুলে মরোক্কান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাই বেশি। বেলজিয়াম-সরকার মরোক্কান পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করে। যে মরোক্কান পরিবারে তিনটি শিশু, তারা দ্বিগুণ আর্থিক সাহায্য পায় বেলজিয়াম সরকারের কাছ থেকে। ফলে অসন্তষের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছিল। আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। মরক্কোর জয়ের পর সেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। ব্রাসেলস-দাঙ্গা কিন্তু ভবিষ্যতের দক্ষিণপন্থীদের হাতে মশলা তুলে দিচ্ছে। আগামিদিনে পরিস্থিতি যে আরও ভয়ংকর হবে না, তা কে বলতে পারে! 

[আরও পড়ুন: উরুগুয়ের বিরুদ্ধে আজ নামছে পর্তুগাল, দানিলোর চোট ভাবাচ্ছে রোনাল্ডোদের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement