টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বৃহস্পতিবার ভারতের সামনে ইংল্যান্ড। ম্যাচের পারদ চড়তে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। শেষ চারের লড়াইয়ের আগে দুই দলের শক্তি-দুর্বলতা বিশ্লেষণ করলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন স্পিনার মন্টি পানেসার (Monty Panesar)। শুনলেন সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের প্রতিনিধি কৃশানু মজুমদার।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের সামনে ইংল্যান্ড। আপনার মতে কে এগিয়ে, কেইবা পিছিয়ে?
পানেসার– আমার মতে, ভারত-ইংল্যান্ড (India vs England) সেমিফাইনালে ভারতই কিন্তু এগিয়ে থেকে শুরু করছে। এই ম্যাচে ভারতকে ফেভারিট বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। অ্যাডিলেডের পিচে ভারত অনেক স্বচ্ছন্দ। বাইশ গজ স্পিন সহায়ক। বল ঘোরে। ভারত যে ধরনের ক্রিকেট খেলে থাকে, অ্যাডিলেডে সেই ক্রিকেট তুলে ধরা সম্ভব। কিন্তু পারথে যদি ম্যাচটা হত, তাহলে আমার ভোট যেত ইংল্যান্ডের দিকেই।
পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড কিন্তু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। যদিও টি-টোয়েন্টি অন্য ফরম্যাট। তবুও আপনার কি মনে হয় সেমিফাইনালে ভারতকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে ইংল্যান্ড?
পানেসার-ইংল্যান্ডের স্ট্র্যাটেজি কী হবে তার উপরে অনেককিছু নির্ভর করছে। ভারতের জন্য ইংল্যান্ড কঠিনতম প্রতিপক্ষ কিনা তা আমি জানি না। রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিদের বিরুদ্ধে নামার আগে ইংল্যান্ড খুবই সতর্ক এটাই আমি বলব। গেমপ্ল্যান কী হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে ইংল্যান্ড দলকে।খুব একটা ভাল পারফরম্যান্স যে করেছে ইংল্যান্ড এখানে, তা আমি বলব না। ওরা সবে জিততে শুরু করেছে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা জিততে হলে ইংল্যান্ডকে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সেরা ম্যাচটা খেলতে হবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
[আরও পড়ুন: সেমিফাইনালে স্বপ্নের পারফরম্যান্স, কিউয়িদের উড়িয়ে বিশ্বকাপের খেতাবি লড়াইয়ে পাকিস্তান]
২০০৭ সালের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আর ঘরে আসেনি ভারতের। সেই দলের সঙ্গ রোহিত শর্মার এই দলের পার্থক্য কী?
পানেসার-২০০৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত যদি পরিসংখ্যান দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছে ভারতই। যুবরাজ সিং ছক্কা হাঁকানোয় রেকর্ড গড়েছে। ২০০৭ সালে ভারতের দলটা খুবই শক্তিশালী ছিল। অধিকাংশ প্লেয়ার সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিল। সেই দলের সমশক্তিসম্পন্ন হতে অনেকটা সময় লেগেছে ভারতের। তবে ভারত এখন এমন একজনকে পেয়েছে যে ওয়ান্স ইন আ জেনারেশন ক্রিকেটার। তার নাম সূর্যকুমার যাদব। আমার মতে, সূর্যকুমারের মধ্যে যুবরাজকে ফিরে পেয়েছে ভারত। যুবরাজ ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ঠিক যেভাবে খেলেছিল, সূর্যও অনেকটা সেইভাবেই এখন খেলছে। ও যদি ২০-৩০ বল খেলে, তাহলে ভারতের জেতার দারুণ সুযোগ রয়েছে। হি ইজ আ ম্যাসিভ প্লেয়ার। তাছাড়া ভারতের এমন কয়েকজন ক্রিকেটার দলে রয়েছে যাদের যে কেউ একজন যে কোনও দিন ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা ধরে। সব মিলিয়ে ভারত দারুণ শক্তিশালী একটা দল।
ভারতের প্রথম একাদশে কি পরিবর্তন আনা দরকার? আপনার কী মনে হয়?
পানেসার-আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম একাদশে ঋষভ পন্থকে রাখা উচিত। ইংল্যান্ড অবশ্য চাইবে দীনেশ কার্তিককে খেলানো হোক। কারণ পন্থ অনেক বড় ম্যাচ উইনার। আমার ব্যক্তিগত মতামত, যুজবেন্দ্র চাহালকেও সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে সবটাই নির্ভর করছে পিচের চরিত্রের উপরে। পিচ যদি স্পিনারদের সহায়ক হয়, সেরকম ক্ষেত্রে নানা সমীকরণ আসতেই পারে। অ্যাডিলেডের পিচে অক্ষর প্যাটেল কেমন বল করে, সেটাও বেশ ইন্টারেস্টিং হবে। ইংল্যান্ড অবশ্যই তিন স্পিনার নিয়ে খেলতে নামবে। প্রথম দিকে মইন আলি, মিডল ওভারে লিয়াম লিভিংস্টোন, আদিল রশিদ শেষের দিকে উইকেট তোলার চেষ্টা করবে। অতীতে একটা বা দুটো স্পিনারের উপরে ভরসা করে খেলতে নামত ইংল্যান্ড। কিন্তু এখন তিন স্পিনার নিয়েই নামবে।
আপনি বলছেন ভারত খুবই শক্তিশালী দল। কিন্তু রোহিত শর্মা ফর্মে নেই। বিরাট কোহলি ধারাবাহিক ভাবে রান করছেন ঠিকই। হার্দিক পান্ডিয়া কিন্তু কখনও ভাল আবার কখনও মন্দ। সূর্যকুমার যাদব অবশ্য নজর কাড়ছেন। সব মিলিয়ে ভারতীয় দলের ব্যাটিং নিয়ে কী বলবেন?
পানেসার– ভারত নিঃসন্দেহে দারুণ শক্তিশালী দল। এমন সব প্লেয়ার দলে আছে যারা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে যে কোনও সময়ে। রোহিত শর্মা ছন্দে নেই ঠিকই কিন্তু সেমিফাইনালে ঘুরে দাঁড়াতেই পারে। সেরা ইনিংসটা হয়তো রোহিতের ব্যাট থেকেই এল সেমিফাইনালে। কেএল রাহুল ফর্মে ফিরছে। বিরাট কোহলি ধারাবাহিক ভাবে রান করছে। এই ধরনের বড় ম্যাচে কীভাবে খেলতে হয়, সেটা বিরাট কোহলি খুব ভাল করেই জানে।খেলার গতিটা ও সব থেকে ভাল বোঝে। কোহলি উইকেটে এলে অন্য ব্যাটসম্যানদের আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলার সুযোগ করে দেয়। শেষের দিকে প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কোহলি নিজেই। সূর্যকুমার যাদবও দারুণ ফর্মে রয়েছে।ভারতের বোলিংও বেশ ভাল। ভুবনেশ্বর কুমার দুর্দান্ত। বলতে গেলে ওই নেতৃত্ব দিচ্ছে বোলিং বিভাগকে।বলা ভাল অর্শদীপ সিংকে আক্রমণাত্মক বোলিং করার প্রেরণা জোগাচ্ছে ভুবিই। ফুলার লেন্থে বল করে বাউন্ডারিও দিচ্ছে বটে অর্শদীপ, তবে তা হতেই পারে।সুযোগ পেলেই বল সুইং করাচ্ছে।উইকেটও তুলে নিচ্ছে।ভারতের বোলিং বিভাগ পাওয়ার প্লেতে সত্যিই দুর্দান্ত বল করছে।
ইংল্যান্ড সম্পর্কে কী বলবেন? দলে কি পরিবর্তন দরকার?
পানেসার-ইংল্যান্ড ক্রিস জর্ডনকে আনতেই পারে। জর্ডন এককথায় দারুণ ফিল্ডার।স্পিনারের জায়গায় নামতে পারে জর্ডন। ও খেললে ফাস্ট বোলিং বিভাগে গভীরতা বাড়বে।স্যাম কারেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতেই পারে। পাওয়ার প্লে ও স্লগ ওভারে স্যাম কারেন ভাল বোলিং করে। উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা আছে। ইংল্যান্ড দলের অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী বোলার স্যাম কারেন। মার্ক উড গতিশীল বোলার।ও নিজের বোলিংয়ে গতি আনার চেষ্টা করে।তবে গতি দিয়ে ভারতীয় দলকে আতঙ্কিত করা যাবে না। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মার্ক যদি ওর স্লো-বাম্পার প্রয়োগ করে তাহলে ফল পেলেও পেতে পারে। ম্যাচ যদি অ্যাডিলেডের পরিবর্তে পারথে হত, তাহলে বলতাম মার্ক উডের বোলিং প্রভাব ফেলবে ম্যাচের উপরে। কিন্তু এখানে ওকে বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। কখন স্লোয়ার দিতে হবে, কখন জোরের সঙ্গে বল করতে হবে সেটা ওকেই স্থির করতে হবে।
এই সেমিফাইনাল কতটা আলাদা বলে আপনার মনে হচ্ছে?
পানেসার– আমার মনে হয় ইংল্যান্ড এখনও নিজেদের ছন্দ ফিরে পায়নি। যদিও ওরা ম্যাচ জিততে শুরু করেছে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বেশ ভাল খেলেছে ইংল্যান্ড। টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ড প্রাধান্য বিস্তারকারী একটা দল ঠিকই কিন্তু এখানে ওরা আন্ডারডগ। আমি ভারতকে ফেভারিট বলছি কারণ ওরা বেশ কয়েকটি হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ খেলেছে এবং জিতেছে। পার্থের ম্যাচটা অবশ্য ব্যতিক্রম।পারথের উইকেট খুব দ্রুত, গতিশীল। ওই পিচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হার মেনেছে ভারত। পিচের চরিত্রের উপর অনেককিছু নির্ভর করে। মন্থর পিচে এবং বল পড়ে যেখানে নীচে নেমে যায়, সেরকম ধরনের উইকেটে ভারতীয়রা ভাল খেলে থাকে। কিন্তু জীবন্ত পিচে যদি খেলা হয় এবং সেই পিচে যদি পেস ও বাউন্স থাকে, তাহলে ইংল্যান্ড কতটা মানিয়ে নিতে পারে, সেটাই দেখার।ইংল্যান্ডের জন্য উইকেটে গতি থাকা দরকার।অন্যদিকে অ্যাডিলেডের পিচের জন্যই ভারত ফেভারিট।
আপনি যদি সেমিফাইনালে নামতেন, তাহলে কোহলিকে কীভাবে বল করতেন?
পানেসার– লেগ স্টাম্প থেকে সরে এসে জায়গা তৈরি করে কোহলি এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে যে শটটা মেরে ছক্কা হাঁকায়, সেটাই যাতে ও আমাকে মারে তার জন্য লোভ দেখাতাম।অথবা তিনজন ফিল্ডারকে আমি ডিপে রাখতাম। ডিপ লং অন, ডিপ মিড উইকেট, ডিপ স্কোয়্যার লেগে ফিল্ডার সাজিয়ে রাখতাম। স্টাম্পে বল করে ওকে লেগসাইডে স্কোয়্যার শট খেলে বাউন্ডারি মারার জন্য প্রলুব্ধ করতাম। ঠিকঠাক মারলে বাউন্ডারি যেমন হতে পারে তেমনই সময়ের গন্ডগোলে আউটও হয়ে যেতে পারে। আর আমার বল যদি ঘোরে তাহলেও কোহলিকে আউট করার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
আপনি শচীন তেন্ডুলকরকে বল করেছেন। কোহলিকে দেখছেন। দুই সেরার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
পানেসার– কোহলি আর শচীনের মধ্যে পার্থক্য তো রয়েইছে। শচীন টেস্ট ক্রিকেট খেলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। একবার উইকেটে জমে গেলে শচীনকে আউট করা কঠিন হয়ে যেত। বিরাট অবশ্য অসংযত শট খেলতে ভয় পায় না এবং ওই শট খেলতে গিয়ে উইকেটও ছুঁড়ে দিয়ে আসে। তবে বিরাট যে তীব্রতা নিয়ে এখন খেলছে অনেকেই সেরকম খেলতে পারবে না।এই তীব্রতার মোকাবিলা করতে পারে না প্রতিপক্ষ। অনেক সময়ে খেলোয়াড়দের মনে বিরক্তির উদ্রেক করে। প্রতিপক্ষ অবশ্য এর জন্য তৈরি থাকতেই পারে।
এই ইংল্যান্ড দলে কাউকে কি আপনি মিস করেন?
পানেসার-অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফকে মিস করি। অবিশ্বাস্য প্লেয়ার। আমি বলব এখন যদি ফ্লিনটফ খেলত তাহলে বেন স্টোকসের থেকেও বড় ক্রিকেটার হত। ওর ব্যাটিং অনেকটা হার্দিক পান্ডিয়ার মতো। তবে বোলিংয়ের দিক থেকে ফ্লিনটফ কিন্তু বাকিদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। ফ্লিনটফ এখন টি টোয়েন্টি খেললে সেরা অলরাউন্ডার হতই।
ইংল্যান্ড হেরে গিয়েছে আয়ারল্যান্ডের কাছে। আবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পরিস্থিতি কঠিন করে জিতেছে। ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স কিন্তু মোটেও ধারাবাহিক নয়। আপনি কী বলবেন?
পানেসার-এবারের বিশ্বকাপে যে ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে, তা হল বড় এবং তথাকথিত ছোট দলগুলোর মধ্যে যে ব্যবধান অতীতে ছিল, তা ধীরে ধীরে কমছে। এর কারণ হল, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোর অনেক প্লেয়ার এই ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলছে। সেই লিগ খেলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজের দেশের হয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলতে নামছে তারা। অভিজ্ঞতার জন্যই বড় মঞ্চে খেলতে তারা একেবারেই ভীত নয়। একা হাতে ম্যাচ জেতাতেও পারছে। এবারের বিশ্বকাপে প্রবল ভাবে সেটা দেখা গিয়েছে। একটা দল আধিপত্য দেখিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবে এমনটা কিন্তু দেখা যায়নি এবারের প্রতিযোগিতায়।
এবার ইংল্যান্ডের প্রসঙ্গে আসি। ওরা এখনও নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারেনি। জস বাটলার ক্যাপ্টেন হিসেবে নতুন। শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওকে দারুণ লেগেছে। নেতা হিসেবে উঠে আসছে। তবে দলে কয়েকজন বয়স্ক ক্রিকেটার রয়েছে। আদিল রশিদ, বেন স্টোকসের বয়স বাড়ছে। অল্পবয়সি ক্রিকেটারও আছে দলে। ফলে এই দলে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের একটা মিশেল রয়েছে। আমি পরের বিশ্বকাপের দিকেই তাকিয়ে। ইংল্যান্ড নিজেদের কতটা গুছিয়ে নিতে পারে, সেটাই দেখার।
[আরও পড়ুন:আইপিএলের দলের মালিক মিতালি? প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের কথায় তুঙ্গে জল্পনা]