জনবাদী রাজনীতির এটি একটি বিপজ্জনক দিক। অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অর্থনীতিবিদ কোভিড অতিমারীর সময় সরকারকে জনবাদী নীতি গ্রহণের পক্ষে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রাজকোষ ঘাটতির ভয় পেলে চলবে না। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। কিন্তু, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, অন্যান্য সতর্কতা না নিয়ে জনবাদী এই পদক্ষেপের পরিণাম কী হতে পারে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
রিজার্ভ ব্যাংক পরপর ১১টি ঋণনীতি ঘোষণা করার পরও দেশে সুদের হার অপরিবর্তিত। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সংকটের পর অনেকেই এতে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে। ভারতে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে হতে তা কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনবে না তো? এখনই বলা যাচ্ছে না। যদিও ভারতের আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি, সুদের হার কম রেখে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। কম সুদের হারে শিল্পসংস্থাগুলি লগ্নি বাড়াবে। যা সৃষ্টি করবে কর্মসংস্থান। বাস্তবে তার আমরা ছিটেফোঁটাও দেখতে পাচ্ছি না। কয়েক দিন আগে রিজার্ভ ব্যাংক চলতি অর্থবর্ষেও আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে এনেছে বেশ কিছুটা। আর্থিক বর্ষের শেষে গিয়ে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। সুদ কমিয়ে শিল্পে লগ্নি টানা যাচ্ছে না, তবুও সুদের হার কম রেখে মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি নিয়ে আমরা চলেছি। সুদের হার কম থাকা মানে, বাজারে টাকার জোগান বাড়ে। যা অনিবার্যভাবে মুদ্রাস্ফীতিকে ডেকে আনে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো আমাদের মুদ্রাস্ফীতি এখনও দুই অঙ্কে যায়নি। দুই অঙ্কে মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটে যায়, তার উদাহরণ প্রতিবেশী দুই দেশে আমরা প্রবলভাবে প্রত্যক্ষ করছি। ইমরান খান ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিদায় হয়তো সময়ের অপেক্ষা।
[আরও পড়ুন: ক্রিকেট থেকে রাজনীতির মঞ্চে এসে একই হাল ইমরান ও সিধুর]
ইমরান ও রাজাপক্ষে- দু’জনেই তাঁদের স্বৈরাচারী প্রবণতাকে বজায় রেখে জনবাদী রাজনীতিকে হাতিয়ার করেছিলেন। উদারবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্বে ‘জনবাদ’ বলতে আমরা বুঝে থাকি, সরকারের তরফে গরিবদের স্বার্থবাহী বেশ কিছু পুনর্বণ্টনবাদী অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ। পাকিস্তানে ইমরান খান যেমন চালু করেছিলেন ভরতুকিতে খাদ্যসামগ্রী কেনার বন্দোবস্ত। মুদির দোকানে গিয়ে গরিব মানুষ চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি কিনলে দামে ৩০ শতাংশ ছাড় পেয়ে থাকে। ইমরান খানের সরকার সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল ভরতুকি দিয়ে প্রকল্পটি চালাচ্ছিল। পেট্রোল, ডিজেলেও ইমরান বিপুল ভরতুকি দিয়েছিলেন। যার ফলে পাকিস্তান পেট্রোল ও ডিজেলের দাম ভারতের থেকে অনেক কম। একইরকমভাবে শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়া রাজাপক্ষে ক্ষমতায় এসে করে বিরাট ছাড় দিতে শুরু করেন। শ্রীলঙ্কায় জিএসটি একধাক্কায় ১৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু গোতাবায়া মানুষকে কর ছাড়ের সুবিধা দিতে গিয়ে সরকারের আয় বিপুলভাবে কমিয়ে ফেলেন। শ্রীলঙ্কার জিডিপির দুই শতাংশ পর্যন্ত আয় কমে যায় কর কমার কারণে।
জনবাদী রাজনীতির এটি একটি বিপজ্জনক দিক। অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অর্থনীতিবিদ কোভিড অতিমারীর সময় সরকারকে জনবাদী নীতি গ্রহণের পক্ষে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রাজকোষ ঘাটতির ভয় পেলে চলবে না। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। কিন্তু, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, অন্যান্য সতর্কতা না নিয়ে জনবাদী এই পদক্ষেপের পরিণাম কী হতে পারে। পাকিস্তানে মার্চ মাসে মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছেছিল ১২.৭ শতাংশে। শ্রীলঙ্কায় সেটা দাঁড়াবে ১৯ শতাংশে। দুই দেশের ঘাড়েই বিপুল বৈদেশিক ঋণ। শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করতে আইএমএফ সম্মত হয়েছে। আইএমএফ-এর সপ্তদশতম ঋণ দ্বীপরাষ্ট্রটি পেতে চলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য পাকিস্তান এখনও আইএমএফের ঋণের আশ্বাস পাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কায় ডলারের দাম সে-দেশের টাকার বিনিময়ে ৩১৩ টাকায় পৌঁছেছে। পাকিস্তানে ১ ডলার প্রায় ১৮৫ টাকা। ফলে, দুই দেশই তাদের আমদানির খরচ মেটাতে পারছে না। যা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করছে। পাকিস্তানের রপ্তানি কমেনি।
সে-দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়নের জেরে আমদানির খরচ বিশাল বেড়ে গিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। একই অবস্থা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও। শ্রীলঙ্কায় অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট অনেকটা বেশি। তার প্রধান কারণ একদিকে যেমন শ্রীলঙ্কার আমদানি-নির্ভরতা বেশি এবং অন্যদিকে গোতাবায়া রাজাপক্ষের অবিবেচকের মতো রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত। গোতাবায়ার হঠাৎ পরিবেশ সচেতনতা এবং দেশকে রাতারাতি জৈব-কৃষিতে নিয়ে যাওয়ার ‘পাগলামি’ উৎপাদনকে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
ইমরান ও রাজাপক্ষের মতো জনবাদী রাজনীতির পথে নরেন্দ্র মোদিও হাঁটছেন। অতিমারী চলে গেলেও মোদির ফ্রি রেশন বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন নগদ হস্তান্তর প্রকল্পও জারি রয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে এসব প্রকল্পের একটা ভূমিকা থাকে। কোষাগারের উপর চাপ ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা তো আছেই। ইমরানের পতন নিশ্চিত হতেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে পাক-মুদ্রার অবমূল্যায়নের গতিকে রুদ্ধ করার একটা চেষ্টা হচ্ছে। ভারত এই পথে হাঁটবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিরোধী দলগুলি পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার পর মোদি সরকার একটু নড়েচড়ে বসেছে। রোজ যেভাবে ৮০-৮৪ পয়সা করে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তা কয়েক দিন হল বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বাজারে অন্য পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মূল্যবৃদ্ধি রোধে সুদ বাড়ানোর মতো কঠোর পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে মোদি সরকারের উচিত আর কালবিলম্ব না করা। ব্যাংকের সুদ বাড়লে উপকৃত হবে সাধারণ মানুষও। সঞ্চয় থেকে আয় বৃদ্ধি অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত চাহিদাও বেশ কিছুটা বাড়াতে পারে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সরকার বারেবারে জোগানের দিকে নজর দিয়ে চলেছে। অথচ তার কোনও প্রতিফলন আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘটছে না। কম সুদে আকৃষ্ট হয়ে যে লগ্নিকারীরা বিরাট সংখ্যায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে, এমনটা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। মোদি সরকার খেয়াল রাখুক যে, পাকিস্তানে ইমরানের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সে-দেশের নীতি-নির্ধারকরা অর্থনীতির বিভিন্ন সংশোধনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। যার মধ্যে সুদের হার বাড়ানোটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা ভোটের ফলপ্রকাশের পর অস্থায়ী স্পিকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শাহবাজ শরিফ ও বিলাওয়াল ভুট্টোকে কিছু বলার জন্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করলেন তরুণ বিলাওয়াল। তিনি বলেন, ‘এবার ফিরবে পুরনো পাকিস্তান।’ ইমরান ‘নয়া’ পাকিস্তানের স্লোগান দিয়েছিলেন। বিলাওয়াল পুরনো পাকিস্তান ফেরানোর কথা বলে কি শুধুই পরিবারতন্ত্র ফিরে আসার ইঙ্গিত দিলেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকে সে-কথাই বলছেন। শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় পুরনো পরিবারতন্ত্র ফিরেছে বলেই তাঁদের অভিমত। আরও একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, বেনজির-পুত্র বিলাওয়াল একইসঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও পুরনো পথে হাঁটার। শরিফের নেতৃত্বে ইমরানের জনবাদী অর্থনীতির যে আপাতত বিদায় ঘটবে, তা বলেই দেওয়া যায়। নতুন ভারতের কথা ফাটা রেকর্ডের মতো বারবার না শুনিয়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে মোদি সরকারও অর্থনীতিতে অন্তত ‘পুরনো ভারত’ ফেরানোর পথে এবার হাঁটুক।