ভারত- ১০৭
ইংল্যান্ড- ৩৫৭/৬
গৌতম ভট্টাচার্য: বিশ্বের আধুনিক সব স্টেডিয়ামে করা থাকছে সেলফি জোন। বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধবাদী ক্রিকেট মাঠে করা রয়েছে- মিডিয়া গ্যাপ। মিডিয়া গ্যাপ হল প্রেসবক্সের দু’দিকের দু’টো লিফটের মধ্যে ১২×১০ জায়গাটা। লর্ডস গত কুড়ি বছর ধরে ক্রিকেটভক্তদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের মিলনের একমাত্র রাস্তা হিসেবে এই মিডিয়া গ্যাপের ব্যবস্থা রেখেছে। ঠিক এই জায়গাটা পেরিয়ে ক্রিকেটাররা প্র্যাকটিসের জন্য নার্সারি এন্ডে আসেন। অথবা নার্সারি এন্ডে প্র্যাকটিস সেরে লর্ডস মাঠে ঢোকেন। বিশ্বকাপ ফুটবলে যেমন মিক্সড জোনের ব্যবস্থা আছে, এটাও তেমন বকলমে মিক্সড জোন। তবে সাপোর্টারদের। ক্রিকেটাররা রাজি হলে তাঁকে দাঁড় করিয়ে অনায়াসে আপনি অটোগ্রাফ নিতে পারেন। ছবি তুলতে পারেন। শনিবার প্রেসবক্সে ওঠার মুখে দেখলাম, মিডিয়া গ্যাপে একজনকে ঘিরে অসম্ভব ভিড়। প্রথমে মুখটা দেখতে পাইনি বলে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিছু পর আবিষ্কার করলাম, জো রুট। অন্তত দশ মিনিট ওখানে দাঁড়িয়ে ইংল্যান্ড অধিনায়ক অটোগ্রাফ দিলেন আর ছবি তুললেন।
বিহ্বল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। যেখানে একটু পরে ম্যাচ শুরু হবে, তিনি চার নম্বরে ব্যাট করবেন, সেখানে সকালে অনুরাগীদের এতটা সময়? নাকি ১০৭ রানে বিপক্ষকে নামিয়ে দিয়ে এতটাই কনফিডেন্ট হয়ে গিয়েছেন ইংরেজ অধিনায়ক? তুলনায় নার্সারি এন্ড থেকে যে ভারতীয় মুখগুলো ড্রেসিংরুমের দিকে আসছে, সেগুলো বিবর্ণ এবং ফ্যাকাশে। কে জানত, খেলার আগে দেখা মিডিয়া গ্যাপের একটা আপাত নিরামিষ ছবিই সারাদিনের প্রোমো হিসেবে হাজির হবে? ক্রিকেট মক্কায় সিরিজ ১-১ করার কথা ছিল। আপাতত কোহলির ভারত ০-২ নামক টেমস নিম্নচাপ আশঙ্কার দিকে গভীর উদ্বেগে তাকিয়ে। রোববার শুনছি ফের দিনভর বৃষ্টির পূর্বাভাস। বৃষ্টি না হয়ে হালকা মেঘলাও যদি হয়, অ্যান্ডারসনের ওইটুকু হলেই চলবে। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের জেমস বন্ড মেঘলা সেটিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর টিমকে সিরিজ হারের কিনারে আরও ঠেলে নিয়ে যেতে পারবেন।
[লর্ডসে ব্যর্থতার মধ্যেই বিরাটের জন্য এল সুখবর]
তিন রকম প্রজাতি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, যাদের বৃষ্টির পূর্বাভাসে মন আন্দোলিত হতে থাকে। চাষি, প্রেমিক মন আর কবি। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে চতুর্থ প্রজাতি হিসেবে উচ্চাঙ্গের সুইং বোলারকে যোগ করার সময় হয়েছে। আর বিপক্ষে এই রকম ব্যাটিং লাইন আপ যদি পায়, তা হলে সত্যি খুঁজতে হয়, ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি’ গানটা যদি রবীন্দ্রনাথ লন্ডনের হ্যামস্টেডের বহু স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি বসে লিখে থাকেন। ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে’ কবিতাটা কোথায় বসে লিখেছিলেন? রবীন্দ্র বিশারদদের শরণ নিয়ে জানা গেল, শিলাইদহে বসে উনিশশো সালে এই কবিতাটা লেখেন- নববর্ষা। নিজেই তাতে পরে সুর দেন। জিমি অ্যান্ডারসন নিশ্চিত কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেননি। কিন্তু এক-এক সময় মনে হচ্ছে, তাঁর জন্য চলতি সিরিজের এটাই থিম সং। বৃষ্টির জন্য তোড়জোড় করে আসবে কী ভারতকে গাঁথবেন।
লর্ডস টেস্টে ভারতীয় ক্রিকেটের রোম্যান্টিকতা প্রত্যক্ষ করতে ক্রিকেট অনুরাগীরা ভিড় করে আসে। সেই ১৯৩২-এর লর্ডসে মহম্মদ নিসারের পাঁচ উইকেট থেকে শুরু করে মানকড়ের ’৫২-র অমর ম্যাচ। বিশ্বকাপ জয়। এই মাঠে গত বার ইংল্যান্ডকে দুর্ধর্ষ ভাবে হারানো। ঐতিহাসিক ভাবে সেই সব বিক্রম যদি প্রাসাদোপম অট্টালিকা হয় এবারের লর্ডস ম্যাচ হল, অজান্তে জড়ো হয়ে থাকা ইঁট, চুন, সুরকি, সিমেন্ট। একটা তলাও হয়নি। আড়াইশো রানে অলরেডি পিছিয়ে। ইংল্যান্ড যদি এই অবস্থা থেকে ডিক্লেয়ার করে দেয়, অ্যান্ডারসনের হৃদয় ময়ূরের মতো নাচার জন্য অনেক সময় থাকবে। সম্ভাব্য বিপর্যয়ের জন্য যে ক’টা মুখের দিকে আঙুল উঠছে তার মধ্যে প্রথম নাম অধুনা বিশ্বের সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল ক্রিকেটার। এজবাস্টন ইনিংস-উত্তর তিনি ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি যত বন্দিত হচ্ছেন। তার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে তীক্ষ্ণ হচ্ছে অধিনায়ক হিসেবে তাঁর সমালোচনা। নাসের হুসেন শুরু করেছিলেন এজবাস্টনে। আজ তাঁর নেতৃত্বের চরম সমর্থক সঞ্জয় মঞ্জরেকরকে দেখলাম হতাশ হয়ে বলতে, “বিরাটের এত ফ্ল্যাট ক্যাপ্টেন্সি আমি কোনও দিন দেখিনি।”
[সুইংয়ে ব্যর্থতাই ফের ডোবাল ভারতকে, তৃতীয় দিনে বৃষ্টির ভরসায় কোহলিরা]
সমালোচনার তিরকে অন্যায্য বলার কোনও উপায় নেই। প্রথম সমালোচনা, অধিনায়ক হিসেবে দল নির্বাচনে অস্থিরতা। লর্ডস ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁর ৩৭তম টেস্ট। ব্যাটসম্যান হিসেবে এমন চমকপ্রদ পারফরম্যান্স এই টেস্টগুলোয় যে, ক্যাপ্টেন্সি কোথাও ব্যাটিং স্কিলে ভাইরাস ঢোকাচ্ছে বলার এতটুকু উপায় নেই। বরং ইংরেজ সাংবাদিকদের হাতে এদিন একটা অদ্ভুত স্ট্যাটস ঘুরছিল। আর নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান হচ্ছিল। তাতে লেখা, এ বছর বিদেশে ভারতীয় ব্যাটসলম্যানদের মধ্যে কোহলির গড় ৫০-এর উপরে। বাকিদের সম্মিলিত গড় ১৪। তা বলে ৩৭ টেস্টে ৩৭ রকম দল কেন? পৃথিবীর আর কোনও ক্যাপ্টেনের এই রেকর্ড নেই যে, সে কখনও পরপর দু’টেস্টে একই টিম খেলায়নি। সমালোচনা দুই, অস্থিরতায় ভুল এগারো বাছা। লর্ডসে যেমন। ভারতের এগারো বাছা নিয়ে ডেভিড গাওয়ার এবং কুমার সঙ্গকারা দু’জনকেই একইরকম আশ্চর্য দেখাচ্ছে। গাওয়ার বলছিলেন, “এজবাস্টনে তা-ও কিছুটা টার্ন ছিল। সেখানে দু’টো স্পিনার খেলানোর মানে হয়। কিন্তু এখানে যেমন প্রথম দিনটা বৃষ্টিতেই গেল, তখন তো কুলদীপকে না খেলিয়ে তৃতীয় পেসার খেলানো যেত। তার মানে টিম ম্যানেজমেন্টের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, এজবাস্টন ভুলে প্রায়শ্চিত্ত এখানে করব। সেটা করতে গিয়ে লর্ডসেও ভুল টিম খেলালো।”
টিম ম্যানেজমেন্ট মানে যদি অধিনায়ক+কোচ হয়, মাঠের সিদ্ধান্তর দায় তো বিরাটের এবং একা বিরাটের। তিন নম্বর সমালোচনা তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে। এজবাস্টনে ইংল্যান্ড সংহারক রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে তিনি দ্বিতীয় ওভারেই বল করতে ডাকেন কি না, কৌতুহল ছিল। অ্যালিস্টার কুককে পরপর দু’ইনিংসে নিজের দ্বিতীয় ওভারে বোল্ড করেছিলেন অশ্বিন। টিমে যেখানে ছয় জন বাঁ হাতি কী করে অশ্বিন সামলানো হবে, তা নিয়ে ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে প্রবল উৎকণ্ঠা ছিল। ব্রিটিশ প্রেসেও যা নিয়মিত এই ক’দিন প্রকাশ পেয়েছে। যদিও আজ রোদ উঠেছে এবং সারফেসও আলাদা, অশ্বিনকে তিনি শুরুতে দিলেন না বোঝা গেল। একমত না হলেও বোঝা গেল, পেসারদের উপরই চান্স নিয়েছেন। যুক্তি আছে।
কিন্তু কোন যুক্তিতে তিনি ইংল্যান্ডের কাছে টিমের এক নম্বর জুজুকে বল করতে ডাকেন ১৫৮ রান বোর্ডে ওঠার পর? ৩৭তম ওভারে? ভারতীয় ব্যাটিংয়ে ওই গরিবের সংসারের মধ্যে অশ্বিনের ২৯ সর্বোচ্চ। সাধারণ মনঃস্তত্ব বলে, আমি তো সেই বোলারকে আরও আগে আনব যে উইকেটে আছে এমনকী রান পেয়ে টগবগে। যে ম্যাচে প্রত্যেকটা রানের খেসারত প্রায় একশো পাউন্ড, সেখানে বিপক্ষ প্রথম ইনিংসে ৫০ রানে এগিয়ে যাওয়ার পর তিনি এক নম্বর স্পিনারকে আনবেন? চরম উপেক্ষিত বোলারকে যখন শেষমেশ আনলেন, বাটলার-বেয়ারস্টো সেট হয়ে গিয়েছেন। আর বোলারও উপেক্ষিত হতে হতে ম্যাচ থেকে উদাসী। সময় সময় চুয়াত্তরের ধূসর ইংল্যান্ড সফর মনে পড়ে যাচ্ছে। এমএস ধোনির টিমও ০-৪ সিরিজ হেরেছিল। কিন্তু তাদের এত অসহায় দেখায়নি। ক্রিস ওকসের মতো ব্যাটসম্যান কিনা সেঞ্চুরি করে চলে গেলেন! এত দুর্বল টিম। দু’টো কুড়ি বছরের ছেলে। তবু ইংল্যান্ডকে দেখে মনেই হল না, তার যে কোনও বেন স্টোকস নেই। এই ইংল্যান্ড বোধহয় আধুনিক সময়ের দুর্বলতম ব্যাটিং লাইন আপ। জো রুট ছাড়া এমন কেউ নেই যে বছরসাতেক আগের ধোনিকে ৪-০ চূর্ণ করা টিমে জায়গা পেতে পারে। ওই টিমটায় স্ট্রস ওপেন করতেন। কেভিন পিটারসেন বলে কেউ ছিলেন। বেল ছিলেন। বোলিংয়ে যদি অ্যান্ডারসনকে কোনও ভাবে সামলানো যায়, অন্য দিকটা সোনার খনি অপেক্ষা করে রয়েছে। চা বিরতির পর তো মেঘ করেও এল। যেন প্রকৃতি বললেন, এবার তোদেরও চান্স দিচ্ছি। কিন্তু চান্স নেবে কে?
মহম্মদ সামি ছাড়া সুইং করানোর লোক নেই। ইশান্ত রিভার্স সুইংয়ের চেষ্টা করলেন। না পাওয়া গেল সেটা, না সাবেকি সুইং। হার্দিক পাণ্ডিয়া একটা এলবিডব্লিউ পাওয়ায় কোহলি এমন ভাবে প্রিয় বন্ধুকে জাপটে ধরলেন, যেন পাঁচ উইকেট স্পেল শেষ করলেন। আসলে আইপিএল সৃষ্ট এই পিন আপ হিরো ৫৮ ওভার পর প্রথম টেস্ট উইকেট পেলেন। শেষ নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে। পেসারের যদি বিদেশে উইকেট পেতে ৫৮ ওভার লেগে যায়, তা হলে কি সে ব্যাটিং অলরাউন্ডার? তা হলে ব্যাটে এত নিচে নামে কেন? কে উত্তর দেবে? এখনকার সুপারস্টাররা মুখোমুখি প্রশ্ন দূরে থাক, অপ্রিয় টুইট দেখলেই রেগে যান। মিডিয়া ম্যানেজার বেচারির দ্রুত তলব হয়, এই রিপোর্টারটা যেন কোন কাগজের? হার্দিক পাণ্ডিয়া ম্যাচের শেষে বলে গেলেন, তাঁদের পরিকল্পনা সব ঠিক ছিল। শুধু বৃষ্টিতে বোলার্স ফুটমার্কটা গন্ডগোল হয়ে গেল। শুনে অ্যান্ডারসনের সামনে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মতো বাকস্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কি?
The post লর্ডসে দুর্যোগে ভারত আর প্রথম প্রশ্নের মুখে কোহলির অধিনায়কত্ব appeared first on Sangbad Pratidin.