shono
Advertisement

গৃহযুদ্ধে ছারখার মণিপুর, ‘চিত্রাঙ্গদার দেশে’ কীভাবে ফিরতে পারে শান্তি?

জনজাতিদের মধ্যে লড়াই নতুন কিছু নয় মণিপুরে।
Posted: 05:26 PM Jul 19, 2023Updated: 05:26 PM Jul 19, 2023

বিশ্বদীপ দে: মণিপুর বললেই বাঙালির মনে আঁকা হয়ে যায় ‘চিত্রাঙ্গদা’র কাব্যসৌন্দর্য! ব্রহ্মচর্য ব্রত নিয়ে মণিপুরে (Manipur) এসেছেন মধ্যম পাণ্ডব। অন্যদিকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী তথা রক্ষক রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। সেই প্রণয়লীলার কথাই মনে পড়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যটির কথা উঠলে। অথচ র্বতমানের ছবিটা একেবারেই আলাদা। জাতি দাঙ্গায় জ্বলতে থাকা মণিপুর সেই কাব্যসুষমার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করছে। অনেক চেষ্টাতেও সেই অশান্তি মেটার নাম নেই। সংখ্যাগুরু মেতেই জনজাতির সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘাত চলছে কুকি-ঝোমি ও অন্যান্য আদিবাসীদের। প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে শান্তি ফিরতে পারে মণিপুরে? কোন পথে মিলবে সমাধান সূত্র?

Advertisement

সমাধানের পথ খুঁজতে বসে প্রথমে সমস্যাটাকেই একটু বিস্তারিত ভাবে বোঝা প্রয়োজন। আসলে জনজাতিদের মধ্যে লড়াই নতুন কিছু নয় মণিপুরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সমস্যার ক্ষেত্রে রয়েছে সংখ্যাগুরু মেতেইদের তফসিলি উপজাতির তকমা দাবি। কুকি-ঝাোমি ও টাংখুল নাগাদের মতো রাজ্যের সংখ্যালঘু আদিবাসীদের ভয়, মেতেইরা এই তকমা পেলে তাদের অস্তিত্ব সংকট বাড়বে। পাহাড় ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত অন্যান্য এলাকায় মেতেইরা ঢুকে পড়লে তাদের উপরে নেমে আসবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের খাঁড়া। হাতছাড়া হবে জমি। তাই তারা এর প্রতিবাদ শুরু করেছিল।

[আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে বিরাট স্বস্তি, মোদির বিরুদ্ধে প্রমাণ জালিয়াতি মামলায় জামিন তিস্তা শীতলবাদের]

এদিকে মেতেইদের দাবি, ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে তাদের কিন্তু স্বীকৃতি ছিল উপজাতি হিসেবে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে মণিপুরের অন্তর্ভুক্তির পরে তারা সেই তকমা হারায়। এই ‘বঞ্চনা’র বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়টি। আর এখান থেকেই বচসার সূত্রপাত। অন্যান্য উপজাতিরা মেতেইদের ‘অন্যায়’ সুবিধা দিতে নারাজ। তাদের দাবি, মেতেইরা মণিপুরে অনেকটাই অগ্রসর। এমনকী, বিধানসভাতেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি তারাই। এই পরিস্থিতিতে তাদের তফসিলি উপজাতি-ভুক্ত করলে শিক্ষা থেকে কর্মক্ষেত্র, সবেতেই পিছিয়ে পড়বে কুকি-নাগা ও অন্যান্য উপজাতিরা।

এখানেই শেষ নয়। সমস্যার মেঘ ঘনাচ্ছিল গত বছর থেকেই। মণিপুর বিধানসভায় ২০২২ সালের গোড়াতেই প্রস্তাব পেশ হয় রাজ্যে এনআরসি লাগু করার। মায়ানমার থেকে আসা চিন-কুকি জনজাতির বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে মণিপুরে ঢুকে পড়েছেন বলে অভিযোগ। সেই সময় থেকেই অশান্তির পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে একতরফা ভাবে সশস্ত্র কুকি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (UPA) ও কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (KNO)-এর বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে মণিপুরের বিজেপি সরকার। গত শতাব্দীর সাতের দশকে তৈরি তিনটি গির্জা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এরপরই। তখন থেকেই প্রতিবাদ শুরু করেছিল খ্রিস্টান কুকিরা।

[আরও পড়ুন: মেধার জোরে ২ বছর বয়সেই ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে নাম তুলল দুর্গাপুরের খুদে, গর্বিত বাবা-মা]

এরপরই মে মাসে মেতেইদের তফসিলি উপজাতির তকমা দেওয়ার বিরোধিতা করতে মিছিল বের করে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’। কার্যতই আগুনে ঘি পড়ে এরপর থেকেই। ক্রমেই বাড়তে থাকে হিংসা। আর তা যেন চলে যেতে থাকে হাতের বাইরে। গোটা দেশের উদ্বেগ বাড়িয়ে গত প্রায় মাস তিনেক ধরেই মণিপুর অশান্ত।

এদিকে অশান্তি থামাতে পারছেন না বলে ক্রমেই কোণঠাসা মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং। তার ওপর তিনি নিজে মেতেই জনজাতির প্রতিনিধি। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে কুকিদের বাড়তি ক্ষোভের কারণ রয়েছে। অভিযোগ, অসমের বড়োদের মতোই মণিপুরের নির্দিষ্ট এলাকায় স্বায়ত্বশাসন পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিল কুকি-ঝোমিরা, তা সত্যি হতে পারছে না বিরেনের জন্যই। এদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও তাঁর উপর সন্তুষ্ট নয় বলেই শোনা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ইস্তফাও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত একপ্রস্থ ‘নাটকের’ পরে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন।

চলতে থাকা সংঘর্ষে কার্যতই রক্তস্নাত মণিপুর। সেনা নামিয়েও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পরিস্থিতি। মৃতের সংখ্যা শতাধিক। এমতাবস্থায় জুনে রাজ্যে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah)। মুখ্যমন্ত্রী বিরেনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন বিরেন। এরপর দিল্লি ফিরে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রিপোর্ট দেন শাহ। কিন্তু এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, মেইতেই-কুকি সংঘাতে রাশ টেনে মণিপুরকে শান্ত করার জন্য কোন পদক্ষেপ করা দরকার? কুকি নেতাদের দাবি, হয় পৃথক রাজ্য নয়তো ‘খ্রিস্টান’  মিজোরামে অন্তর্ভুক্তি। এছাড়া বিক্ষোভের আগুন নেভার উপায় নেই। যদিও এমন কিছু নিশ্চিত ভাবেই কাম্য নয় এবং কেন্দ্র এমন কোনও পদক্ষেপ করবেও না, তা নিশ্চিত বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

সেক্ষেত্রে রাজ্যের ভিতরে কয়েকটি অঞ্চলে কুকিদের স্বায়ত্বশাসন দিয়ে তবেই তফসিলি উপজাতির তকমা দেওয়ার পথে হাঁটতে পারে সরকার। তাহলে দুই তরফেই অসন্তোষের মাত্রা ততটা থাকবে না। ফলে শান্তি ফেরানোর পথ পরিষ্কার হতে পারে। যদিও সেক্ষেত্রেও সমস্যা থাকবে। কেননা কুকি ও মেতেইরা সব সময় একে অপরের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে থাকে। তাই একপক্ষের কোনও বিষয়ে লাভ হলে অন্যপক্ষ বিক্ষোভের আগুন জ্বালাতেই পারে। ফলে অশান্তির আঁচ অব্যাহত থাকার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তবুও দু’পক্ষকে শান্ত করতে এর কাছাকাছিই কোনও পদক্ষেপ করা যেতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। আপাতত যা পরিস্থিতি তাতে এর বাইরে কোনও পথ দেখা যাচ্ছে না। যে কোনওভাবেই হোক, সাম্প্রদায়িকতার বিষে বিপন্ন ‘চিত্রাঙ্গদার দেশে’ ফের শান্তি ফিরুক, সেই প্রার্থনাই করে চলেছে দেশের সাধারণ মানুষ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement