shono
Advertisement

Breaking News

ছত্রিশ বছর পরেও লর্ডস থেকে দেরাদুন তিরাশির বিশ্বজয়ের রেশ চলছে

২৫ জুন ১৯৮৩ হল ভারতীয় ক্রিকেটের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস। The post ছত্রিশ বছর পরেও লর্ডস থেকে দেরাদুন তিরাশির বিশ্বজয়ের রেশ চলছে appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 08:52 PM Jun 26, 2019Updated: 08:52 PM Jun 26, 2019

গৌতম ভট্টাচার্য: অভিনব সেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মঙ্গলবার সকাল-সকাল সন্দীপ পাটিলের গম্ভীর মেসেজ ঢোকে। বয়েজ টিম মিটিং অ্যাট সিক্স থার্টি পিএম। কিছু পরে সৈয়দ কিরমানি লেখেন, জওয়ানো হাজির হো যানা। আসলে বিশ্বকাপ চলাকালীন কপিল মোটামুটিভাবে ম্যাচের আগের দিন সাড়ে ছ’টাতেই টিম মিটিং ডাকতেন।

Advertisement

তাই বাকিদের এরপর স্মাইলি আর টুকটাক মন্তব্য। এরকমই চলছে বেশ কয়েক বছর। গ্রুপে আছেন তিরাশির কাপ জেতা টিমের চোদ্দো জন এবং খুব জনপ্রিয় ম্যানেজার মান সিং। মানের এখন অনেক বয়স। মোবাইল স্যাভি নন। বাবার সঙ্গে কথা বলে তাঁর হয়ে উত্তর দেন ছেলে। বছরজুড়ে গ্রুপে মেসেজ আদানপ্রদান চলতে থাকে। কিন্তু পঁচিশে জুন এলে সেটা হয়ে যায় একটা স্পেশ্যাল তারিখ।

[আরও পড়ুন: আফগানি গৃহযুদ্ধের মাঝে আজ রান রেট বাড়ানোই লক্ষ্য কোহিলদের]

কপিল দেব অতীতে এই প্ল্যাটফর্মে কাপ জয়ের সাফল্যের পিঠোপিঠি তাঁর আর গাভাসকরের অজানা যুগ্ম ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে বিশ্বকাপজয়ী দলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় শ্রীকান্তকে কন্ট্রোল করতে না পারার ব্যর্থতা। শ্রীকান্তের একটু পরপর নাক ঝাড়ার অভ্যেস আছে। গাভাসকর-কপিল দু’জনেই নাকি তাঁকে সাবধান করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পেলেই দম চেপে রাখবি। উনি চলে গেলে তবে নাক টানবি। কিন্তু মিসেস গান্ধী সামান্য দূরে এই অবস্থায় শ্রীকান্ত নাকি ফের নাক ঝেড়েছিলেন। এই নিয়ে প্রভূত রঙ্গ রসিকতা আর আড্ডা যা শুনলে মনে হবে এঁরা আজও যৌবনে।

কে বলবে রবি শাস্ত্রী ছাড়া বাকিরা সিনিয়র সিটিজেন হয়ে গিয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ অভিনব এ জন্য যে একটা টুর্নামেন্টজয়ী দল বার্ষিক রিইউনিয়নের মতো করে ছত্রিশ বছর পরেও নিজেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, এমন নজির কোথায়? লর্ডস প্রেস লাউঞ্জে বসা সুনীল গাভাসকর হাসছিলেন, “সকাল থেকে চনমনে হয়ে উঠেছে আমাদের গ্রুপ।” হয়তো বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয়রাও। বার্মি আর্মির তারস্বরে চিৎকার আর গান সেন্ট জনস উড চত্বরে চলছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ শুরুর আগে থেকে। কিন্তু পাশাপাশি যে একদল ভারতীয় মুখকেও ফেস্টুন হাতে দেখলাম : ’৮৩ লর্ডস যেখানে স্বপ্ন সত্যি হয়! কপিল দেব বলেন, “হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটুপ তো আগে ছিল না। কিন্তু সেই তিরাশির পর থেকে একদিনও হয়নি যে ২৫ জুন কেউ না কেউ অভিনন্দন জানায়নি।”

[আরও পড়ুন: চাপ ভারতের উপরেই থাকবে, মহারণের আগে হুঁশিয়ারি আসিফ ইকবালের]

অথচ তিরাশির ২৫ জুনে তো ভারতের একমাত্র বিশ্বকাপ জয় নয়। আরও টাটকা স্মৃতি শচীন-বিরাট সহ নিজের দেশে কাপ জেতার। লর্ডস প্রেসবক্স ক্লোজ সার্কিট টিভি এ দিনও ধোনির অমর ওয়াংখেড়ে ছক্কাটা দেখাচ্ছিল। কিন্তু সেই জয়ের রেশ নিয়ে পরবর্তীকালে আর মাতামাতি হয়নি। ধোনি ছেলেদের নিয়ে কোথাও আড্ডা মারতে বসা দূরে থাক, পরের বছর কাপ জয়ের বার্ষিকীতে মুম্বই থেকেও দু’কিলোমিটার দূরের ওয়াংখেড়েতে যাননি। বিশ্বকাপজয়ী এগারোর টিমের কোনও ডিজিট্যাল সহমর্মিতা আছে বলে কেউ জানে না। অথচ তিরাশি আজও চিরসজীব। প্রাণবন্ত।

গোটা টুর্নামেন্টে যিনি স্কোয়াডে থেকেও একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সেই সুনীল ওয়ালসন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে দেরাদুন থেকে ফোনে বলছিলেন, “ধোনিরা জেতার পর মনে হয়েছিল, আমাদেরটা পিছনে চলে গেল। কোথায় কী! সবার এমন প্রতিক্রিয়া আজকেও দেখছি যেন তিরাশিটাই একমাত্র। জানি না প্রথম সব কিছু মানুষের মনে বেশি থাকে বলে কি না।”

ছত্রিশ বছর বাদেও ওয়ালসনের চোখের সামনে সব পরিষ্কার ভাসে। “জিম্বাবোয়ের ওপেনার আলি শাহ এসে টিমগুলোর অফিসিয়াল লাইন আপ করে দাঁড়ানোর দিন মাঠেই বলল, আমরা-তোমরা সবাই সময় নষ্ট করতে এসেছি। ফাইনাল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভার্সেস অস্ট্রেলিয়া। এমনকী সেমিফাইনালের আগের রাতে বিবিসি টিভিতে টেড ডেক্সটার, ব্রায়ান ক্লোজ আর রে ইলিংওয়ার্থ মিলে ম্যাচ প্রিভিউ করতে বসে তিন জনই বললেন, ফাইনাল হবে ইংল্যান্ড ভার্সেস ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আমি প্রোগামটা দেখে টিমকে বলি। ম্যাচ শেষে যখন কার পার্কে ডেক্সটার আর ক্লোজকে দেখি মাথা নীচু করে হাঁটছেন। এটাও তো মনে হয় যেন এখুনি দেখে উঠলাম।”

[আরও পড়ুন: ধোনি বা কোহলি নন, সৌরভকেই সেরা অধিনায়ক বাছলেন সন্দীপ পাটিল]

ব্রিটিশ মিডিয়াকুলও ভারতকে পাত্তা দেওয়া দূরে থাক, যৎপরোনাস্তি তাচ্ছিল্য করেছিল। এঁদের অগ্রগণ্য ছিলেন উইজডেন সম্পাদক ডেভিড ফ্রিথ। ব্র্যাডম্যানের একশোর উপর ব্যক্তিগত চিঠি আছে ফ্রিথের হেফাজতে। ডনের বন্ধু বলে আরও বেশি সম্ভ্রম পেতেন ফ্রিথ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শর্ট পিচড বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লিখে ভিভের সঙ্গে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম ঘটেছিল তাঁর। এ হেন ফ্রিথ প্রাক তিরাশি বিশ্বকাপ দাবি তোলেন যে, ইন্ডিয়াকে খেলতে দেওয়া উচিত নয়। ওরা এতই সাবস্ট্যান্ডার্ড।

এরপর এক ধাপ এগিয়ে ‘উইজডেন ক্রিকেট মান্থলিতে’ লেখেন, এমন সাবস্ট্যান্ডার্ড টিম যদি বিশ্বকাপ জেতে তিনি ম্যাগাজিনের সব ক’টা পাতা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। কপিল কাপ হাতে তোলার পরেই ম্যানেজার মান সিং সংশ্লিষ্ট ম্যাগাজিনকে লিখিত প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে বলেন, ফ্রিথকে এবার সত্যি সত্যি পাতাগুলো খেতে হবে। ভারতীয় প্রতিবাদে একটা পাতা খেতে ফ্রিথ বাধ্য হন। এ দিন তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগযোগ করে দেখা গেল, খুব অসুস্থ। গত মাসে স্ত্রী ডেবি মারা গিয়েছেন। ই মেলে এরপর ফ্রিথ উত্তর দিলেন, ‘মোহিন্দরের সঙ্গে ম্যাচের দিনকয়েক বাদে আমার দেখা হয়। ও যথেষ্ট ভদ্রসভ্যই ছিল।’ মজা করে লিখেছেন, ‘তবে এই যে ভারতকে আমি এত উত্তেজিত করে জিতিয়েছিলাম, মনে হয় না পরবর্তীকালে তার কোনও ক্রেডিট আমায় দেওয়া হয়েছিল বলে।’ ফ্রিথ এবার ফেভারিট দেখছেন অস্ট্রেলিয়াকে। ভারত? ‘উঁহু চ্যাম্পিয়ন হতে দেখছি না।’

কিন্তু তাঁর উত্তরে কী এল গেল? তিরাশির নায়কদের কাছে ফ্রিথ কোনও বিবেচ্য বিষয়ই না। তাঁরা বরং রণবীরের ফিল্মটা সম্পর্কে খুব আশাবাদী যে ফিল্মে রক্ষিত হয়ে এই কীর্তি আরওই আধুনিক সময়ের কাছে পৌঁছবে। আর বলবিন্দর সিং সান্ধু যখন যুক্ত আছেন তখন ক্রিকেট নিয়ে অন্তত ভুলভাল কিছু দেখানো হবে না।
কত সব অজানা ঘটনা আছে কাপ জেতা ঘিরে। ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার যেমন বলছিলেন, “শশী কাপুর ম্যাচ দেখতে এসেছিল। ফাইনাল শেষে উদ্দীপনায় টিমের সঙ্গে অংশ নেবে কিন্তু ব্লেজার নেই। টাই নেই। এমসিসি মেম্বার্সে ঢুকবে কী করে? একটা মোটাসোটা সাহেবকে জ্যাকেট খুলিয়ে তখনও স্লিম থাকা শশী কোনও রকমে ঢুকেছিল।”

এবারের বিশ্বকাপে কোহলিদের লন্ডন নিবাস লর্ডস থেকে অনেক দূরে। টেমসের পারে। কিন্তু সেই আমলে দল ঠিক রাস্তা পারের হোটেলে উঠত। এখন যার নাম বদলে হয়েছে রিজেন্ট পার্ক দ্যানুবিয়াস। নতুন মালিক হাঙ্গেরিয়ান। তাই নামটা টিপিক্যাল ইংরেজ রাখা হয়নি। কিন্তু অন্দরমহলে ক্রিকেটের সাজসজ্জা আজও অক্ষত। হবস মিটিং রুম, ডেনিস কম্পটন সুইট, ট্রুম্যান সুইটস, ডব্লিউ জি গ্রেস সুইট। হোটেল ঘিরেও মজার গল্প আছে। ম্যাচ যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে একপেশে হয়ে যাচ্ছে তখন গাভাসকর হাত নেড়ে ডাকেন পাটিলকে। বলেন, “ডিপ থার্ডম্যানে তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছ তার পিছনেই পাম্মি বসে আছে। ওকে বলো হোটেল ফিরে যেতে। ভিভ যেমন মারছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাচ শেষ হয়ে যাবে। এখন ফাঁকায় বেরিয়ে যাক।” পাটিল হেসে বলেন, “জীবনে ওই একবারই সুনীলের ক্রিকেটপ্রজ্ঞাকে এত বড় ভুল করতে দেখেছি।” মার্সেলিন যখন উঠে পড়েছেন তখন হঠাৎ কপিলের সেই ক্যাচ। আবার তাঁর বসে পড়া। ভিভ সে দিনও লর্ডসে বসে আক্ষেপ করছিলেন, “গোটা ইন্ডিয়া টিমে তো ওই ক্যাচটা একটা লোকই ধরতে পারত। আর আমার পুলটা কি না ওর কাছেই গেল।”

[আরও পড়ুন: একটা ফোন বদলে দিয়েছিল জীবন, চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি শচীনের]

ও দিকে মদনলালের স্ত্রী তার আগেই মাঠ ছেড়েছেন। বন্ধু রোমিকে বলেন, ভিভ ওকে এত মারছে আমি আর দেখতে পারছি না। রোমির খুব খারাপ লাগছে তখন। হাজার হোক ক্যাপ্টেনের স্ত্রী। দু’জনেই বেরিয়ে যান গেট পাস না নিয়ে। আর মাঠে ফেরার উপায় ছিল না। হোটেল পৌঁছে টিভি চালিয়ে দেখেন, ভিভ আউট। এ বার দু’জনে এত নাচানাচি শুরু করেন যে হোটেল দ্রুত সিকিওরিটি পাঠায় ঘরে। তাদের সন্দেহ ছিল কেউ মহিলাদের শ্লীলতাহানি করেছে বলে তাঁরা এত চেঁচাচ্ছেন। সিকিওরিটিকে বহু বুঝিয়ে তারপর সে ঘর ছাড়ে।
এমনই অজস্র গল্প আর দমফাটা মজার কাহিনি। লর্ডসে মিনি অ্যাসেজ ম্যাচের মধ্যেও যদি ইংরেজ সাংবাদিকরা কেউ কেউ বলতে থাকেন, “আজকেই না?” তখন সত্যি চমৎকৃত হতে হয়। আর মনে হতে থাকে এ মাঠে ১৯৩২ সালে ভারতের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক যতই শুরু হোক, ২৫ জুন ১৯৮৩ হল তার প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার ছত্রিশ বছর আজ পূর্ণ হল! ওঁদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কেউ টেক্সট করবেন?

The post ছত্রিশ বছর পরেও লর্ডস থেকে দেরাদুন তিরাশির বিশ্বজয়ের রেশ চলছে appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement