রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: আরসিবি…আরসিবি! আরসিবি…আরসিবি!আরে, ইডেনে (Eden Gardens) হঠাৎ ‘আরসিবি’ হুঙ্কার কেন? বিরাট কোহলি এলেন নাকি? শহরে নামলেনই তো বিকেল-বিকেল, আর সন্ধের মধ্যেই গন্তব্য ইডেন?
নাহ্, ইডেনে সোমবার বিরাট কোহলি আসেননি। আরসিবিও (RCB) আসেনি। পুরো টিমই হোটেলে ছিল। ইডেনে এ দিন দফায় দফায় উপস্থিত ছিল তিনটে টিম। লখনউ সুপার জায়ান্টস। রাজস্থান রয়্যালস। গুজরাত টাইটান্স। কিন্তু ইডেনে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়ানো শ’দুই উন্মত্ত ক্রিকেট জনতা তা বুঝলে তো? কেকেআর হীন শহরের রুক্ষ-শুষ্ক আইপিএলে (IPL 2022) এঁরা এখন শুধু বুঝছেন বিরাট কোহলি। শহরে আইপিএল আর কোহলি– দু’টো শব্দ যেন রাতারাতি সমার্থক হয়ে গিয়েছে!
বিশ্বাস করুন, ইডেনে না গেলে বিশ্বাসই হবে না দিল্লির বিদায় ও অপ্রত্যাশিত কোহলির অবতরণ ঘিরে শহরজুড়ে কী পাগলামির জন্ম দিয়েছে। টিকিট-ফিকিট শেষ। সিএবি কর্তাদের দেখলে মায়া হবে। চাহিদা-প্রত্যাশার বেপরোয়া ঘূর্ণিঝড় যেন মুর্হুমুহু অবিরাম বয়ে যাচ্ছে এক একজনের উপর দিয়ে। মঙ্গলবার শহরে যে ঝোড়ো হাওয়া সমেত মাঝারি বৃষ্টি আছে, কেউ সে দিকে দৃকপাতও করছেন না।
ভারতীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও (Sourav Ganguly) বা দু’দণ্ড বসার সুযোগ কোথায়? এ দিন তিন দফায় ইডেনে আসতে হল সৌরভকে। কখনও সিএবি কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে পড়লেন। কখনও সোজা মাঠে। আসলে বৃষ্টির আশঙ্কায় পিচ সহ গোটা মাঠ ঢেকে রাখতে হচ্ছিল। তাই পিচ কেমন শেষ পর্যন্ত আচরণ করবে, তা নিয়ে একটা তিরতিরে টেনশন থাকে। এ দিন দুপুরে মাঠে ঢুকে সোজা প্রথমে পিচ দেখতে চলে যান সৌরভ। অদৃশ্য গার্ড নিয়ে পিচে একবার দাঁড়িয়ে পড়েন। তার পর ক্লাবহাউস ঘুরে সোজা কর্পোরেট বক্স। সেখানে কোথায় মেঝের টাইলস নড়ে গিয়েছে, ডিনারের জায়গায় ঠিকঠাক সব আছে কি না, সবই দেখতে হল। আসলে ইডেন মন্দির হলে তার শ্রেষ্ঠ পূজারি এখনও সৌরভ। ইডেনে খেলা মানে তার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ– পুরো দায়দায়িত্ব তাঁর। তা সে যতই তিনি আর সিএবি প্রেসিডেন্ট না থাকুন, যতই বোর্ডে চলে যান।
[আরও পড়ুন: আইপিএল প্লে অফে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ সিএবির, ধন্যবাদ জানালেন মমতা]
পরে ইডেন ছেড়ে বেরনোর সময় সৌরভকে জিজ্ঞাসা করা হল, হাওয়া অফিস বলছে মঙ্গলবার বৃষ্টি আছে। কী হবে তা হলে? শুনে সৌরভ উত্তর দিলেন, “আমরা তৈরি। বৃষ্টি হলে তো কিছু আর করার নেই।” তা, ইডেন তৈরি। পাঁচ-পাঁচটা সুপার সপার প্রস্তুত করে রাখা আছে। বলা হল, প্রচণ্ড বৃষ্টি হলেও অসুবিধে নেই। থামার আধঘণ্টার মধ্যে খেলা শুরু করে দেওয়া যাবে। সময় সময় ভাবলে খারাপই লাগবে। গত দু’বছর ধরে আইপিএলের উত্তাপে পোড়েনি শহর। দেখেনি কোহলি বা রোহিত নামের ব্যাটিং-বরপুত্রদের। করোনা কেড়েকুড়ে নিয়ে গিয়েছিল সমস্ত কিছু। ক্ষুধার্ত ভাবে এবার তাই সিটবেল্ট বাঁধছিল কলকাতা। কে জানত, মোক্ষম মুহূর্তে আকাশ আচমকা এমন শত্রুতার শিঙা ফুঁকে বসবে?
বিরাট ছেড়ে দিন। মঙ্গলবার প্রথম কোয়ালিফায়ারের (IPL 2022 Playoff) প্রেক্ষাপট দেখুন। নামেই গুজরাত টাইটান্স বনাম রাজস্থান রয়্যালস। আদতে তো বঙ্গ ক্রিকেট প্রশাসন বনাম ঋদ্ধিমান সাহা! গত কয়েক দিন ধরে সিএবি আর বঙ্গসন্তানের মধ্যে তুলকালামের পর এই প্রথম ইডেনে নামছেন ঋদ্ধিমান। কতটা দুঃখ যে পেয়েছেন, বোঝাও গেল। যখন সাংবাদিক সম্মেলনে বসে ঋদ্ধি এ দিন বলে গেলেন, তিনি গুজরাত টাইটান্সে খেলেন। তাই তাঁর ঘরের মাঠ এখন মোতেরা। ইডেন গার্ডেন্স নয়! যন্ত্রণার কত পুঁজরক্ত জমা হলে এ জিনিস বলে মানুষ? আজ ইডেনে ঋদ্ধিমান নামবেন যখন, বাড়তি তাগিদ কি ধমনীতে টের পাবেন না? এদিন ঋদ্ধিমান ইডেনে ঢুকলেন চুপচাপ, ট্রেনিং শেষ করে বেরোলেনও নিভৃতে। কোনও বাড়তি আহ্লাদ দেখাতে যাননি। মহম্মদ সামিকে বরং অনেক বেশি চনমনে দেখাল নিজের মাঠে ফিরতে পেরে।
ঠিক আছে, ‘প্রতিশোধে’র কাহিনিও না হয় সরিয়ে দিন। বাদবাকি ক্রিকেটীয় যুদ্ধের দিকে তাকান। জস বাটলার বনাম মহম্মদ সামি। যুজবেন্দ্র চাহাল বনাম রাহুল তেওয়াটিয়া। হার্দিক পাণ্ডিয়া বনাম রবিচন্দ্রন অশ্বিন। বাটলার বেশ মনোকষ্টেই ভুগছেন সাম্প্রতিক ফর্ম নিয়ে। বিশ্বাস নিতে চাইছেন, আইপিএল শুরুর দিকে নিজ ব্যাটিং থেকে। তা, মঙ্গলবার যে সামি তাঁর শরীর তাক করে বল করবেন, নিশ্চিত। এ দিন তার মহড়াও দিয়ে রাখলেন গুজরাতের বঙ্গ পেসার। যুজবেন্দ্র চাহাল আবার প্লে অফ আবহে এক পশলা মনখারাপ আমদানি করলেন শেন ওয়ার্ন নিয়ে বলে। বললেন, “আমি কী করছি, উপর থেকে দেখছে ওয়ার্ন।”
রাজস্থানকে আইপিএল চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ওয়ার্ন। চাহাল ১৪ ম্যাচে আপাতত ২৬ উইকেট নিয়ে একই ফ্র্যাঞ্চাইজিতে সেই পরম্পরা বহনের পথে। তবে সেই লক্ষ্যে এগোতে হলে সর্বাগ্রে ‘মিত্র বধ’ প্রয়োজন। রাহুল তেওয়াটিয়া বধ। চাহালের মতোই যিনি হরিয়ানার। এবং গুজরাতের মিডল অর্ডারের বলভরসা। ছোট থেকে যাঁর সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্বকে বিসর্জন দিয়ে মাঠে আজ নামতে হবে চাহালকে।
দেখবে না এ সব ইডেন? ইডেনের সাতষট্টি হাজার (একশো শতাংশ দর্শকই থাকছে) দেখবে না ঋদ্ধিমান-রূপকথা, বাটলার-বিস্ফোরণ, দুই বন্ধুর ডুয়েল? দু’টো প্লে অফ ম্যাচ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছাবার্তাও তো এসে গিয়েছে। এখন সব কিছুর বদলে দেখতে হবে নাকি বৃষ্টিপাত, হাওয়া অফিসের রিপোর্টে যা বলা আছে? বরুণ দেবতার খেয়ালখুশি ক্রিকেট দেবতা মানবেন তো?