সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ইরফানপুত্র বাবিল খানের ‘ফ্রাইডে নাইট প্ল্যান‘ সঙ্গে কেরিয়ারগ্রাফ নিয়ে আলোচনায় বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
‘কলা’ ছবিতে আপনার ডেবিউ প্রশংসিত হয়েছিল। ‘ফ্রাইডে নাইট প্ল্যান’ মুক্তি পেয়েছে বেশ কিছুদিন হল। কেমন প্রতিক্রিয়া?
– সত্যি কথা বলতে কী, ছবি মুক্তির পর আমি কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে ছিলাম (হাসি)। রিলিজের এক সপ্তাহ পর ফিরে আসি। মাম্মা আমাকে জানায়, ছবিটা অনেকেরই ভাল লেগেছে। আমি এমন একজন মানুষ যে ভালবাসায় বিশ্বাস করি। পৃথিবীতে আত্মার শান্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে ভালবাসার দেওয়া-নেওয়া খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। আর আজকের যুগে দাঁড়িয়ে সেটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় কারণ, সমাজ সবাইকে ‘কাটথ্রোট’ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়। এই পরিবেশে আমার নিজেকে আউট অফ প্লেস মনে হয়। আমি সমস্ত প্যাশন দিয়ে যে কাজ করেছি তার জন্য দর্শকের সামান্য ভালবাসা পেলেও আপ্লুত হই। পরের কাজ করার জন্য সাহস পাই।
‘ফ্রাইডে নাইট প্ল্যান’-এ আপনি একজন টিনএজ স্কুল পড়ুয়া, যে কলেজে ভর্তি হতে চলেছে। সে শান্ত, রিজার্ভড, কম কথা বলে। শুনেছি আপনার জীবনেও স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে আপনার খুব একটা জমত না?
– আমি কিন্তু সত্যিই ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইতাম। কিন্তু ওরা যেভাবে কথা বলত বা ওদের মুখের যে ভাষা সেটার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারতাম না। ওদের কাছে ম্যাসকুলিনিটির যে সংজ্ঞা তার সঙ্গে আমার ম্যাসকুলিনিটির ধারণা মিলত না। আমার কাছে সে-ই ‘পুরুষ’ যার সূক্ষ্ম বোধ কাজ করে, যে নিজের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বলতে পারে, ভালবাসার কথা বলতে পারে, অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। নিজের বেদনার কথা বলতে পারা আমার কাছে শক্তিশালী মনের পরিচয়। সমাজের কাছে সেটা ততটা ‘পুরুষালি’ নয়। এটাই আমাদের কন্ডিশনিং। স্কুলে এত কিছু বুঝতাম না। ভাবতাম, রোনা আ গয়া হ্যায় তো ক্যায়া হুয়া, ইয়ার ঠিক হ্যায়! তাদের নিয়ে আমার কোনও বায়াসনেস ছিল না। কিন্তু ওরা আমার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারত না। ওদের পার্টিতে আমি ডাক পেতাম না। একমাত্র ‘ফুটবল’ নিয়ে ওদের সঙ্গে কানেক্ট করতে পেরেছি।
‘ফ্রাইডে নাইট প্ল্যান’-এ যে চরিত্রে আপনি অভিনয় করেছেন সেই ‘সিদ্ধার্থ’কে দেখি নিজের ওপর অনেকটা দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে, বাবার মৃত্যুর পর। অভিনয় করতে গিয়ে নিজের সঙ্গে কতটা মিল খুঁজে পেয়েছেন?
– সিদ্ধার্থের বাবার মৃত্যুর পর ছবিতে যেটা দেখানো হয়েছে, একজন টিনএজ ছেলে হঠাৎ করে ‘ম্যাচিওর’ বা ‘রেসপনসিবল’ হওয়ার চেষ্টা করছে, বড় দাদা হিসাবে ছোট ভাইকে শাসন করার চেষ্টা করছে। সাধারণত আমাদের সমাজে তাই হয়ে থাকে। কিন্তু কীভাবে ‘দায়িত্ব’ নেওয়া যায় বা ‘ম্যাচিওর’ হওয়া যায়, সেটা আমাদের কেউ শেখায় না। ‘সিদ্ধার্থ’কেও কেউ বলে দেয়নি ‘দায়িত্ববান’, ‘ম্যাচিওর’ হওয়া কাকে বলে। ও নিজের মতো করে মানিয়ে নিতে গিয়ে ভুল পথে চালিত হয়। ‘ম্যাচিওর’ হওয়া মানে শুধুই ঠিক কাজ করা নয় সবসময়। ঠিক-ভুলের মাঝে ব্যালান্স করা, নিজের ভুল স্বীকার করে সেটাকে শোধরানো। আমি এমন পরিবারে মানুষ হয়েছি, যেখানে ‘ঠিক’, ‘ভুল’ আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বাবা এবং মা আমাকে ভুল করতে দিয়েছে, এবং বুঝতে সাহায্য করেছে ভুল কোথায় হচ্ছে! তবে এটাও ঠিক, বাবা চলে যাওয়ার পর নিজের ওপর বাড়তি একটা প্রেশার নিয়ে নিয়েছিলাম। সেটা রিলেট করতে পারি।
‘কলা’-র থেকেও ‘ফ্রাইডে নাইট প্ল্যান’ ছবিটা বাবিলের ব্যক্তিগত পরিসরের অনেক কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে সুবিধে বা অসুবিধে কী কী? কোনটা বেশি কঠিন?
– কোনও চরিত্রই বেশি কঠিন বা বেশি সহজ বলে মনে করি না। প্রতিটা চরিত্রের ক্ষেত্রেই নিজের সঙ্গে চরিত্রের কিছু মিল খুঁজে বের করতে হয়। জন্মগত কারণে, পরিবেশ এবং আপব্রিঙ্গিং-এর কারণে উই আর হু উই আর। কিন্তু প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু কমন ‘ট্রেট’ বা ‘বৈশিষ্ট্য’ আছে যা আমরা সামনে আনতে চাই না। অভিনয় করতে গিয়ে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো এক্সপ্লোর করতে হয় যেটা আমরা নিজেদের সম্পর্কে মানতে চাই না। প্রতিটা চরিত্রের সঙ্গে সেই জার্নিটা করতে হয়। এই জার্নিটা অনেস্ট হতে পারে, কিন্তু সহজ বা শক্ত নয়।
অভিনেতা হিসাবে কীভাবে দেখতে চান নিজেকে? চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কী মাথায় থাকে?
– নিজের জন্য কোনও প্রসেস ডিফাইন করতে চাই না। কী করব, কীভাবে করব, আগে থেকে জানতে চাই না। কোনও ছবি, বা চরিত্র সফলভাবে করতে পারব কি না, সেটা সেই মুহূর্তে কাজটা করতে করতে বুঝে নিতে চাই। সেই ছবি, বা চরিত্র, অনিশ্চিত সময়ের ওপর ছেড়ে দিতে চাই নিজেকে। আর সেই জন্যই বোধহয় সবসময় ভালনারেবল থাকতে চাই।
এত সহজে ভালনারেবল থাকার কথা খুব কম মানুষ বলে…
– ভালনারেবল থাকা যে সহজ বা কমফর্টেবল সেটা মনে করি না। আর আমি কমফর্টেবল থাকতেও চাই না। সবসময় আনন্দে থাকার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি।
বাবিলের মধ্যে ইরফান-ভক্তরা যে ইরফানের ছায়া খুঁজবে এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। এই বিষয়টা আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করে বা করতে পারে?
– ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত একটা প্রেশারে থাকি। কিন্তু সেই চাপটা এটা নয় যে বাবার মতো হতে পারলাম কি না। বাবার জুতোয় পা গলানোর চেষ্টা আমার নেই। আমার চাপটা অন্য জায়গায়। অভিনেতা হিসাবে দর্শকের ভালবাসার প্রতি আমার নিজের যে দায়িত্ব সেটাকে পূরণ করার। আমি বাবার ছেলে, ফলে যেটুকু ঝলক দেখা যায় সেটা স্বাভাবিকভাবেই আসে। সেটা চেষ্টা করে আনছি না। তবে সেটা দেখতে পেয়ে যদি দর্শকের ভাল লাগে, সেটা আমাকেও আনন্দ দেয়। কিন্তু সচেতনভাবে আমি বাবার মতো হওয়ার চেষ্টা করছি না।
আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় ক্রিটিক কে? মা, না ভাই?
– আমার মা সবচেয়ে বড় ক্রিটিক। ভাইও সমালোচনা করে তবে ইন জেনারেল। খুব স্পষ্ট ধারণার জায়গা থেকে মতামত পোষণ করে আয়ান। কিন্তু মাম্মা আমার সব কিছু খুঁটিয়ে দ্যাখে। মাম্মা আমার জীবনে সবকিছু। আমি জানি না মাম্মা না থাকলে আমি কী করব। মায়ের প্রতি আমার যে ভালবাসা, শ্রদ্ধা সেটা আমার কাজে, ব্যবহারে, সব কিছুতে প্রতিফলিত হয়।
আপনার পরবর্তী কাজ? শুনেছিলাম সুজিত সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা হচ্ছিল।
– হ্যাঁ, কাজ করার কথা হয়েছে, কিন্তু সেটা নিয়ে বলার সময় এটা নয়। তাছাড়া সুজিতদা আমাদের পারিবারিক বন্ধু এবং এতটাই কাছের যে, কোনও সাক্ষাৎকারে পরবর্তী কাজ প্রসঙ্গে তাঁর নাম নিতে চাইব না। তবে হ্যাঁ, যশরাজ প্রোডাকশনের ওয়েব সিরিজ ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ আমার পরবর্তী কাজ। কবে আসবে সেটা এখনও জানি না।