সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বাংলার মুখ্যসচিব (Chief Secretary) আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিতে বদলির নির্দেশ ঘিরে ফের কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত। ‘দক্ষ’ এই আইএএসকে (IAS) দিল্লিতে চাইছে কেন্দ্র। এদিকে ‘কর্মঠ’ আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়তে নারাজ রাজ্যও। প্রয়োজনে আদালতে যেতে পারে যুযুধান দু’পক্ষই। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্রের এহেন আচরণ কি সংবিধান বিরুদ্ধ? কেন্দ্র কি একতরফা ভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে?
সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, আইএএস কিংবা আইপিএস আধিকারিকদের নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের এই সংঘাত নতুন কিছু নয়। বরং ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো একাধিকবার এই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই এই সংকট এড়াতে সংবিধান এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের রুল বুকে কয়েকটি নিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
[আরও পড়ুন: বাজার ছেয়ে গিয়েছে ৫০০ টাকার জাল নোটে! সতর্ক করল খোদ রিজার্ভ ব্যাংক]
কী বলছে সেই নিয়ম? IAS কিংবা IPS আধিকারিককে ‘সেন্ট্রাল ডেপুটেশনে’ ডাকতেই পারে কেন্দ্র সরকার। IAS আধিকারিকদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি দেখে কেন্দ্রের কর্মী এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ক বিভাগ। যা খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে। ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকেই সাধারণত এটাই দস্তুর। কিন্তু এই বদলি নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর।
- IAS কিংবা IPS আধিকারিককের ‘এমপ্লয়মেন্ট অথরিটি’ অর্থাৎ তিনি রাজ্যের অধীনে কর্মরত হলে তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্র কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে না।
- ১৯৬৯ সালের All India Service Rules-এর ৭ নম্বর ধারা বলছে, কোনও IAS কিংবা IPS আধিকারিক যদি রাজ্যের অধীনে কর্মরত হন তবে তাঁর বিরুদ্ধে একমাত্র ব্যবস্থা নিতে পারে রাজ্য সরকার। রাজ্য অভিযোগ করলে বা বদলিতে মত দিলে তবেই ওই আধিকারিককে বদলি করা যায়।
- রাজ্যের অধীনে কর্মরত IAS কিংবা IPS বা IFS আধিকারিকদের বদলি করার ক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্রকে সহমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় এ বিষয়ে জল গড়াতে পারে আদালত পর্যন্তও।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ, এদিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জানিয়েছেন, মুখ্যসচিবের বদলি নিয়ে কেন্দ্র সরকার ইতিমধ্যে আদালতে ক্যাভিয়েট করে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, এ বিষয়ে মন্তান্তর হলে রাজ্য বা কেন্দ্র কিংবা সংশ্লিষ্ট আধিকারিক সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালের দ্বারস্থ হতে পারেন।
তবে IAS কিংবা IPS আধিকারিককে নিয়ে এই টানাপোড়েন প্রথম নয়।
- ২০০১ সালে কেন্দ্রে এনডিএ সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালীন তামিলনাড়ুতে এই সংকট তৈরি হয়েছিল। সে বছর ১৩ মে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন জয়ললিতা। আর জুন মাসে তৎকালীন বিরোধী দল ডিএমকের দুই নেতার বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হন তাঁরা। এদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন ডিএমকের দুই মন্ত্রী। তাঁদের ‘চাপে’ তিন আইপিএস আধিকারিককে বদলির নির্দেশ দেয় রাজ্য। এমনকী, রাজ্যপালকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ওই তিন আধিকারিক তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন। সেই সময় রাজ্যে ‘দক্ষ’ আধিকারিকের অভাবের অজুহাতে তাঁদের ছাড়তে রাজি হয়নি তামিলনাড়ুর তৎকালীন সরকার।
- গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তৃণমূলের ধরনায় উপস্থিত থাকার ‘অপরাধে’ তৎকালীন ডিজিপি বীরেন্দ্র-সহ আরও চার পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিব মলয় কুমার দে-কে চিঠিও দিয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কিন্তু রাজ্য সাফ জানিয়ে দেয়, তাঁরা ধরনায় অংশ নেননি।
- একুশের মহারণের আগে ফের চার আইপিএসকে সেন্ট্রাল ডেপুটেশনের নির্দেশ দেয় অমিত শাহের মন্ত্রক। দলীয় কর্মসূচিতে বাংলায় এসে হামলার মুখে পড়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাংলার তিন আইপিএস আধিকারিককে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কিন্তু রাজ্য তাঁদের ছাড়েনি। বদলে জানিয়েছিল এ রাজ্যে দক্ষ আধিকারিকের অভাব রয়েছে।
[আরও পড়ুন: ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রাণঘাতী হামলা’,মুখ্যসচিব বদলি ইস্যুতে মমতার পাশে সোনিয়ারা]
এবারও আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তেমনটাই জানিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, আগামী ৩১ মে-ই রাজ্যের মুখ্যসচিব পদে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু, রাজ্যের তরফে আগেই কেন্দ্রের কাছে তাঁকে এই পদে বহাল রাখার আরজি জানানো হয়। রাজ্যের সেই দাবি মেনে মুখ্যসচিব পদে তাঁর মেয়াদ তিন মাসের জন্য বাড়িয়েও দেয় কেন্দ্র। রাজ্য জানিয়েছে, গতবারের করোনা পরিস্থিতি ও আমফান মোকাবিলায় ভাল কাজ করেছেন আলাপন। ফলে রাজ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ রাজ্যের ক্ষতি করা। তাই তাঁর কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানোরও আরজি জানানো হয়েছে। এবার সেই যুক্তিকে হাতিয়ার মুখ্যসচিবের বদলি রুখতে কেন্দ্রকে চিঠি দিতে চলেছে রাজ্য সরকার।