shono
Advertisement

অপ্রত্যাশিত ট্র্যাপিজ

ভারতের প্রতি চিনের ‘নতুন বন্ধু’ রাশিয়ার মনোভাবই বা কেমন হবে?
Posted: 06:20 PM Mar 24, 2022Updated: 06:20 PM Mar 24, 2022

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধতা সরিয়ে ভারতকে আজ নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে। কিন্তু যে-দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ৭০ শতাংশ রাশিয়া নির্ভর, চিন ও পাকিস্তানের জোড়া-বিপদের মোকাবিলায় তার লাগামছাড়া বিরোধিতা কি সুবুদ্ধির নিদর্শন? ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা অনন্তকাল জিইয়ে না-রেখে চিন সমাধানে উদ্যোগী হলে রাশিয়ার প্রতি ভারতের প্রত্যাশা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে? ভারতের প্রতি চিনের ‘নতুন বন্ধু’ রাশিয়ার মনোভাবই বা কেমন হবে? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় 

Advertisement

 

ত ৭৫ বছরে পাকিস্তানের কোনও রাষ্ট্রনায়ক প্রকাশ্যে এভাবে ভারতের কূটনীতিকে কুর্নিশ করেননি। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেই কারণে অনন্য ও অদ্বিতীয়। ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’র কর্ণধার হিসাবে অবশ্যই এটা তাঁর বোধোদয়। বোধোদয়ের কারণ ও সময় চর্চা-যোগ্য। পরশু, শুক্রবার, পাক পার্লামেন্টে ইমরান খানকে অনাস্থা প্রস্তাবের মোকাবিলায় নামতে হচ্ছে। সংকট এবার অতীব গুরুতর। এতটাই যে, ইমরানের বিশ্বাস, ইউক্রেন সংকটে আমেরিকার পাশে না-দাঁড়িয়ে রাশিয়ার দিকে ঝোঁকায় রুষ্ট ওয়াশিংটন তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আদা-জল খেয়ে নেমেছে। ভারতীয় বিদেশনীতিকে সেলাম করার কারণও তাই। না হলে ভরা জনসভায় বলতেন না, ‘পশ্চিমি নেতারা ধরেই নিয়েছে পাকিস্তান তাদের দাস। তারা যা বলবে আমরা তাই করব। যেভাবে নাচাবে, সেভাবে নাচব।’ এর পরেই তিনি ভারতের তুলনাটা টানেন। বলেন, ‘কোয়াডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয়েও কীভাবে বিদেশনীতিতে নিরপেক্ষ থাকতে হয়, ভারত তা দেখিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। ভারত বিদেশনীতি তৈরি করে দেশের স্বার্থ বুঝে। স্বার্থ অনুযায়ী বদল ঘটায়। ওরা অভিনন্দযোগ্য।’

[আরও পড়ুন: ন্যাটোর জুজু দেখিয়ে ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করাই কি পুতিনের আসল উদ্দেশ্য?]

ইমরান যা বলেছেন, ভারতের শাসকের কাছে তা অবশ্যই শ্রুতিমধুর। গণতান্ত্রিক ভারতে এ এক অদ্ভুত ধারাবাহিকতা। সংকটের সময় বিভেদ ভুলে গোটা দেশ একজোট হয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা ভারতের এক দুর্দমনীয় শক্তি। বারবার এর প্রমাণ দেশবাসী পেয়েছে। এবারেও, এই ইউক্রেন সংকটের সময়েও, ভারত যে নীতি অনুসরণ করছে, তা অন্য অনেকের কাছে বিসদৃশ্য ঠেকলেও জাতীয় স্বার্থে এটাই ঠিক বিবেচ্য। ইমরান সেটাই উপলব্ধি করেছেন। মনমোহন সিং জমানায় তিন বছর ভারতের বিদেশ সচিবের দায়িত্ব পালন করার পর যিনি চার বছর দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে বহাল ছিলেন, সেই শিবশংকর মেনন পর্যন্ত বলেছেন, মোদি সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ইউক্রেন পরিস্থিতির সামাল দিচ্ছেন। বিনা দ্বিধায় তিনি বলেছেন, রাশিয়া যা করেছে ভারত তাকে ‘আগ্রাসন’ বলতেই পারত। কিন্তু এটা এমন এক সন্ধিক্ষণ যেখানে নাম করে দোষারোপে লাভ নেই। বিশেষ করে ইউক্রেন সংকট যখন সেই ১৯৯০ থেকে তিল তিল করে জমে আজ তালে রূপান্তরিত। শিবশংকর মনে করেন, দোষারোপের মধ্যে না ঢুকে ভারত বরং চেষ্টা করুক কীভাবে পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরে দুই পক্ষকে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

সন্দেহ নেই, ইউক্রেন সংকট ভারতকে শ্যাম ও কুল দুই-ই ধরে রাখার মতো কঠিন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এক দিকে সোভিয়েত আমল থেকে শুরু করে আজকের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, ‘বিশ্বাস’ নামক খিলান যার অন্যতম আধার; অন্যদিকে মার্কিন অক্ষের সঙ্গে সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক ও সামরিক বন্ধুত্ব রক্ষার দায়, যা চির-প্রতিদ্বন্দ্বী চিন ও পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জরুরি। এই দুই বিপরীতধর্মী টানাপোড়েনের মাঝে যে কোনও একটিকে বেছে নেওয়া শুধু কঠিনই নয়, অবিবেচনাপ্রসূত। ভারতের বিদেশনীতি তাই সঙ্গত কারণেই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’-র মতো। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে পাশে সরিয়ে ভারতকে আজ জাতীয় স্বার্থে বাস্তবতার রুখু জমিতে হাঁটতে হচ্ছে। নৈতিকতার এই জলাঞ্জলি দৃষ্টিকটু অবশ্যই, কিন্তু রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে আবশ্যিক।

কতটা দৃষ্টিকটু? জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা দিল্লি এলেন। হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হল। দুই প্রধানমন্ত্রী তারপর ভাষণ দিলেন। কিশিদা সরাসরি রাশিয়াকে দোষারোপ করে বললেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আন্তর্জাতিক রীতিনীতি-বিরুদ্ধ। গোটা বিশ্বকে তা কাঁপিয়ে দিয়েছে। গায়ের জোরে কাউকে আঞ্চলিক স্থিতাবস্থার বদল ঘটাতে দেওয়া যায় না।’ নরেন্দ্র মোদি কিন্তু রাশিয়ার নাম-গন্ধ পর্যন্ত করলেন না। ইউক্রেন প্রসঙ্গের অবতারণাও নয়। শুধু বললেন, ‘শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়েই সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হবে।’ একদিন পর একই আচরণ পরিলক্ষিত অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সঙ্গে মোদির ভার্চুয়াল বৈঠকেও। মরিসন যতটা রাশিয়াকে দুরমুশ করলেন, মোদি রইলেন ততটাই নিস্পৃহ। চতুর্দেশীয় জোট ‘কোয়াড’-এর সাফল্য-ব্যর্থতার সঙ্গে রাশিয়াকে না-জুড়ে নিরপেক্ষতার নামাবলি পরে ভারত পঁাকাল মাছের মতো নিজেকে তফাতে রাখল। পশ্চিমি বিশ্বের দাবিকে উপেক্ষা করে প্রাধান্য দিল দেশের স্বার্থকে।

রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ সভা ও মানবাধিকার পরিষদে তিন বার রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে ভোটদান পর্বে ভারত গরহাজির থেকেছে। এই ক্ষেত্রে চিন ও পাকিস্তানের পাশে একই কাতারে পাতা হয়েছে ভারতের আসন। ঘটনাটি অভিনব ও বিরল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় আশ্চর্যজনক কি? বিশেষত যখন আকাশ নিরাপদ রাখতে ‘মিগ’ বহর ছাড়াও ভারতের হাতে রয়েছে রাশিয়ায় তৈরি আড়াইশো অত্যাধুনিক ‘সুখোই-৩০’ যুদ্ধবিমান, ৭টি কিলো-ক্লাস সাবমেরিন, ১ হাজার ৩০০ ‘টি-৯০’ ট্যাঙ্ক? সবক’টির আয়ু অন্তত আরও এক দশক। যার অর্থ, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাশিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা। আরও ১০ বিলিয়ন ডলারের সমর সম্ভার আসার অপেক্ষায় রয়েছে যেগুলির মধ্যে রয়েছে, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং সারফেস টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র সম্বলিত ‘এস-৪০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যা না-কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত চাপে রেখেছে ভারতকে। যে-দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ৭০ শতাংশ রাশিয়া-নির্ভর, চিন ও পাকিস্তানের জোড়া-বিপদের মোকাবিলায় যার সহায়তা ছাড়া ভারতের রাতের ঘুমের বারোটা বাজবে, তার লাগামছাড়া বিরোধিতা কি সুবুদ্ধির নিদর্শন? পশ্চিমি শক্তির গোসা যতই হোক, বাইডেন যতই মনে করুন
রুশ আগ্রাসন নিয়ে কোয়াড সদস্যদের মধ্যে একমাত্র ভারতের অবস্থানই নড়বড়ে, এই ভূমিকায় নামা ছাড়া ভারতের উপায় ছিল না।

স্কট মরিসনের সঙ্গে মোদির বৈঠকের পর বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার দাবি, ভারত তার বাধ্যবাধকতা পশ্চিমি নেতাদের বোঝাতে পেরেছে। বুঝুক না বুঝুক ভারত বুঝছে, ‘কান্ট্রি ফার্স্ট’। এই অবস্থান ততক্ষণই কল্কে পাবে যতক্ষণ পর্যন্ত চিন ও পাকিস্তান ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি বিপদের কারণ না হচ্ছে। প্রথাগত লড়াইয়ে পাকিস্তান এখনও ভারতকে ভয় দেখানোর মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু চিনের প্রত্যক্ষ মদত থাকলে? ইউক্রেনের অভিজ্ঞতার আলোয় রাশিয়া যদি তেমন পরিস্থিতিতে ভারতের মতো ‘নিরপেক্ষ’ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়? বিষয়টি চিন্তার।

ইতিমধ্যেই চর্চিত অন্য এক সম্ভাব্য দৃশ্যপট, যেখানে মনে করা হচ্ছে, রাশিয়ার ইউক্রেন-নীতি চিনকে উদ্বুদ্ধ করবে তাইওয়ান দখলে। সম্প্রসারণবাদী চিনের মানচিত্রে তাইওয়ানের পর রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ। চিন বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ জিওফ ওয়েড ২০১৩ সালে তাঁর নিবন্ধ “চায়না’জ সিক্স ওয়ার্স ইন দ্য নেক্সট ফিফটি ইয়ার্স”-এ সেই ছকের রহস্য ফাঁস করে বলেছিলেন, প্রথম লড়াই তাইওয়ান দখলের, যা ২০২০-’২৫-এর মধ্যে বেজিং সেরে ফেলতে চায়। দ্বিতীয় লক্ষ্য, ২০৩০-এর মধ্যে দক্ষিণ চিন সাগরে ১০০ শতাংশ কর্তৃত্ব কায়েম। তারা তৃতীয় যুদ্ধটা লড়বে অরুণাচল প্রদেশে, ২০৩৫-’৪০ সালের মধ্যে। চিনের কাছে অরুণাচল প্রদেশ ‘দক্ষিণ তিব্বত’, যার দাবি তারা ছাড়তে নারাজ। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা অনন্তকাল জিইয়ে না-রেখে চিন তার খুশিমতো সমাধানে উদ্যোগী হলে রাশিয়ার প্রতি ভারতের প্রত্যাশা কোন পর্যায়ে পেঁৗছবে? ভারতের প্রতি চিনের ‘নতুন বন্ধু’ রাশিয়ার মনোভাবই বা তখন কেমন হবে? ইউক্রেন সংকট বৈষয়িক পরিস্থিতিকে সত্যিই জটিল করে তুলেছে। ভারতের কাছে এ এক অপ্রত্যাশিত ট্র্যাপিজ! যুদ্ধের প্রথম মাস শেষ হতে চলেছে। শান্তিরক্ষায় বৈশ্বিক নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ও ক্ষমতা কতখানি, ‘বিশ্বপিতা’ নরেন্দ্র মোদির কাছে সেই প্রমাণ রাখার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।

[আরও পড়ুন: সিপিএমের শূন্যপদ পূরণ তো হল, শূন্যস্থান পূরণ হবে কি?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement