আইপিও-র জগতে এখন পা রাখতে চান? সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না ভুল হবে? বিগত কিছু সপ্তাহের ট্রেন্ড বলছে, নতুনভাবে লগ্নি করতে আগ্রহী অনেকেই। বাজারে একগুচ্ছ নয়া অফার ডকুমেন্ট আসার খবরও রয়েছে। কী করবেন আর কী ভুলেও করবেন না, ব্যাখ্যা করলেন নীলাঞ্জন দে
আইপিও’র বাজার হয়তো আবার খবরের শিরোনামে আসতে চলেছে। বেশ কিছু ইনিশিয়াল পাবলিক অফারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। প্রস্তাবগুলির একাংশ ইতিমধ্যেই সেবির দরবারে, অনুমোদনের অপেক্ষায়। অন্যদিকে কর্পোরেট সেক্টরের অনেক নতুন প্লেয়ার তাদের শেয়ার বাজারে ছাড়বে বলে জানা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কি আইপিও-র দুনিয়ায় পা রাখা উচিত? বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে এই প্রশ্নের উত্তরই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
গত কয়েক সপ্তাহের ট্রেন্ড দেখলে বোঝা যায় নতুনভাবে লগ্নি করায় আগ্রহী অনেকেই। ইনভেস্টররা ইকুইটিতে ভালভাবেই অ্যালোকেশন করছেন, ইনডেক্স বেড়ে যাওয়ায় লাভ হয়েছে তাঁদের মধ্যে অনেকেরই। এই ‘পজিটিভ সেন্টিমেন্ট’ প্রাইমারি মার্কেটেও খাটে, বিশেষত যেখানে একগুচ্ছ নতুন অফার ডকুমেন্ট আসার খবর বাজারের আনাচেকানাচে ছড়িয়েছে। সেগুলি উঠে আসবে একাধিক সেক্টর থেকে – টেকনোলজি, ব্যাংকিং, নিউ এনার্জি, লজিস্টিক্স ইত্যাদি। মোটামুটি নামীদের মধ্যে আছে উৎকর্ষ স্মল ফাইন্যান্স ব্যাংক, ফিনকেয়ার স্মল ফাইন্যান্স ব্যাংক এবং গো ডিজিট জেনেরাল ইনসিওরেন্স। প্রসঙ্গত, এগুলি সবই BFSI Sector, অর্থাৎ ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের প্লেয়ার।
[আরও পড়ুন: পার্সোনাল লোন চাই? খুঁটিনাটি জেনে তবেই এগোন]
মনে রাখতে হবে গত বছরের প্রাইমারি মার্কেটের পরিস্থিতির সঙ্গে এই বছরের আইপিও’র বাজার ঠিক তুলনীয় নয়। ২০২১ সালে আমরা দেখেছি প্রচুর ‘ফান্ড মোবিলাইজেশন’, অনেক ধরনের সংস্থা ক্যাপিটাল মার্কেটে প্রথম পা রেখেছিলেন সেই বছর। প্রায় ১.১৪ লক্ষ কোটি টাকা উঠেছিল ইকুইটি মার্কেটে-সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর তেমন ঘটনাবহুল নয়। অবশ্য LIC-র জন্য পরিস্থিতি আংশিক সময়ের জন্যও ভিন্ন ছিল। এই প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা না করলেই নয়।
আজকের ব্রোকিং ইন্ডাস্ট্রির পরিভাষায়, অনেক আইপিও ‘হাই কনভিকশন বেটস’। এ সব ক্ষেত্রে ইনভেস্টরগণ জানেন, বা মনে মনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, বা কোনও বিশেষ কারণে সেটির ব্যবসা অতি দ্রুত লাভের মুখ দেখবে। অতএব বাজারে পা রাখার সন্ধিক্ষণেই তেমন ‘কাউন্টার’ কিনে নেওয়া উচিত। এমন আবেগের তাড়নাতেই IPO কিনতে বহু বিনিয়োগকারী ছোটেন।
আবার অন্যদিকে সবাই যে একই কারণে এই বাজারে আসেন তা নয়। তাঁরা জানেন মার্কেটে ‘ওয়ান ট্রিক পোনি’-র স্থান বেশি নেই-তাই প্রথম দিনেই বা (স্বল্প দিনেই) বাজিমাত করতে তাঁরা উদগ্রীব হয়ে পড়েন। হয়তো তাতে বিরাট প্রফিট সর্বদা পাওয়া যায় না তবে প্রথমেই বাজিমাতের উদাহরণ অনেকগুলিই আছে চোখের সামনে। আবার এ-ও বলে রাখি, সবসময় তেমন হওয়ার গ্যারান্টি তো নেই-ই, বহুদিন বাদেও IPO প্রাইসের নিচে পড়ে থাকার দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি পাওয়া সম্ভব।
‘সঞ্চয়’-এর পক্ষ থেকে যা বলা উচিত, তা সামান্য ভাষায় বলে নেওয়া যাক। দায়িত্বশীল বিনিয়োগ করার ইচ্ছা থেকে সবসময় অযথা উত্তেজিত তা হয়ে দেখেশুনে, বা অল্প অল্প করে, বিনিয়োগ করুন। এবং ফলের আশা তীব্র হলেও (নিরাশ হওয়ার পর) আঘাত পেতে হবে, এই কথাটি আত্মস্থ করা।
এছাড়াও বোঝা উচিত, IPO-তে যদি অ্যালটমেন্ট পেয়েও যান, নিজের পোর্টফোলিওর মধ্যে স্টকটির স্থান কোথায় থাকবে? একই সেক্টরে ওই একই শ্রেণীর স্টক কি আরও আছে? থাকলে সেই সেক্টরে কি আপনি over-weight থাকবেন? এই প্রসঙ্গে বলি, মনে করুন আপনার কাছে ইতিমধ্যে অনেকগুলি ছোট-বড় ব্যাঙ্ক শেয়ার আছে, নিজের ডিম্যাট অ্যাকাউন্টে সেগুলি দেখাই যাচ্ছে। তারপরেও আপনি যদি সর্বশেষ ব্যাংকের ইনিশিয়াল অফার কিনে নিতে চান, তাহলে নিশ্চয় জেনেবুঝেই তা করছেন? কিন্তু অন্য কোনও কারণের জন্য আপনার ডাইভারসিফিকেশনে খামতি এসে পড়বে না, আশা করি। আমার বক্তব্যের সরল উদ্দেশ্য, IPO-র বাজারে এসে ভাল স্টকের সন্ধান করতে হবে, এবং সব মিলিয়ে তাদের অবদানে যেন আপনার পোর্টফোলিও সমৃদ্ধশালী হয়।
এই বিষয়ে কয়েকটি সতর্কতা :–
#আপনি প্রাথমিকভাবে ভাল সংস্থার শেয়ার কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে চড়া দামে বিক্রি করতেই পারবেন, তার স্থিরতা নেই।
#কিনে নিয়ে হোল্ড করা থেকে অাপনাকে কেউ বারণ করছে না, তবে আগামিদিনে কোম্পানির কার্যকলাপ কী হয় তার খোঁজজখবর রাখুন। রেভেনিউ বা প্রফিট কীভাবে বাড়ছে (বা কমছে) তার খেয়াল রাখুন।
#যদি ছেড়ে দিতে মনস্থ করেন, তাহলে ঠিক কোন সময় তা করবেন (মানে কোন দামে ভ্যালুয়েশন পৌঁছবে) সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট নীতি মেনে চলুন। LIC-র IPO-র উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রাইসিং মনে আছে? সরকার ৯৮৯ টাকা দাম ধার্য করেছিলেন। লিস্টিং ডেব্যু যাকে বলা হয়, তা দেখলেও মনে পড়বে যে ইনিশিয়াল অ্যালটমেন্ট যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁরা নিরাশ হয়েছিলেন। তবে হয়তো তাঁদের অনেকেই পরে স্বল্পতর দামে সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে স্টকটি নিতে পেরেছেন। তাঁদের অ্যাভারেজ প্রাইস কমে এসেছে।
#ভবিষ্যতে IPO-অনেকগুলিই আসবে। তাদের জন্য তৈরি থাকতে এও বুঝে নিন আপনার টাকার যোগান আছে কি না ঠিকমতো। IPO-র জন্য লোন পাওয়া আজকাল সহজেই যায়, এবং বহু বিনিয়োগকারী ‘IPO, ফান্ডিং-এর’ উপর ভরসা রাখেন। সেক্ষেত্রে কী শর্তে লোন পাওয়া যাবে তা জেনে নিতে ভুলবেন না। একাধিক ইনস্টিটিউশনাল লেন্ডার এই ব্যপারে সক্রিয়, এবং বিনিয়োগকারীরা সঠিক সংস্থাটি বেছে নিতে পারবেন, এই আশা করব।
[আরও পড়ুন: নিতে হবে লগ্নির পাঠ, কুঁড়িতেই হোক স্বাবলম্বিতার হাতেখড়ি]
(লেখক লগ্নি বিশেষজ্ঞ)