‘পুষ্পা টু’-র শোয়ে ভিড়ের চাপে মারা যান এক মহিলা। যার জেরে গ্রেপ্তার হন দক্ষিণী সিনেমার সুপারস্টার আল্লু অর্জুন। অভিযোগ, পুলিশকে খবর না দিয়ে তিনি সিনেমা হলে গিয়েছিলেন। ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। এই ঘটনায় অনেকে আল্লু অর্জুনের তেমন দোষ পাচ্ছেন না। আবার অনেকে এটাকে ‘পাবলিসিটি স্টান্ট’ বলে দাগাতে চাইছেন। ‘আইকন’ নির্মাণের যে চতুর ও বাণিজ্যতাড়িত খেলা চলে, ভাবমূর্তি নির্মাণের জন্য আল্লু অর্জুন কি তেমন রাস্তা নিয়েছিলেন? লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘পুষ্পা’ আল্লু অর্জুন রাতারাতি সুপারস্টার হননি। ২১ বছরের শ্রম, নিষ্ঠতা, অর্জন, রণাভিযান পেরিয়ে তবেই না তিনি এখন মহাতারকা বলে প্রতিষ্ঠিত। আর, প্রতিটি সুপারস্টারের মতো তঁারও আছে ক্রমিক ক্ষয়িষ্ণুতা এবং অনিবার্য অবসানের অনিশ্চয়তাবোধ। সুতরাং তঁাকে অব্যাহত রাখতেই হবে ক্যারিশমা-উল্লোল যাপন এবং নিরন্তর প্রচারপ্রবাহ।
২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গঙ্গোত্রী’ দিয়ে সিনেমার স্রোতে আল্লু অর্জুনের সঁাতার শুরু। তারপর ‘বানি’ (২০০৫), ‘দেশমুদুরু’ (২০০৬), ‘পারুগু’ (২০০৮) এসব সিনেমার ঘাট পার হয়ে ২০২১ সালে ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ ছবিতে তিনি পৌঁছে যান আন্তর্জাতিক স্টারডমের বৃৃত্তে (তবে, দক্ষিণী সিনেমায় তিনি অনেক আগেই ‘তারকা’ বলে সমাদৃত হয়েছিলেন, তা হয়েছিলেন ২০০৪ সালে সুকুমার পরিচালিত ‘আর্য’ থেকে)। আর, এই বছর ফ্র্যাঞ্চাইজির দ্বিতীয় অ্যাডভেঞ্চার, ‘পুষ্পা টু: দ্য রুল’ ৪২ বছরের এই মহাতারকাকে পৌঁছে দিল কয়েক দিনের মধে্য ১০ হাজার কোটি টাকার বাণিজে্যর সুপার-সাফলে্য তৎসহ ভুবনজুড়ে প্রচারের তোলপাড়ে। কিন্তু এখানেই থামলে চলবে কেন? প্রচার-প্লাবনকে যে নিরন্তর রাখতেই হবে! অলক্ষে্য লেখা হল দুঃসাহসী চিত্রনাট্য– তুমুল প্রচারের অনিবার্য আয়ুধ। কিন্তু সেই চিত্রনাটে্য প্রবিষ্ট হল অপ্রতিরোধ্য অদৃষ্ট। কে ভাবতে পেরেছিল এই আকস্মিক বালাই! এই তড়িৎগতি ঘটনাপ্রবাহে অনেকেই খুঁজে পাচ্ছে (নিন্দুকদের চোখে অভিযোগ) চতুর ‘পাবলিসিটি স্টান্ট’। কিন্তু তারই মধে্য যে হঠাৎ থাবা বসাবে মৃতু্য ও ট্র্যাজেডি, এবং হাতের অনেকটাই বাইরে চলে যাবে খেলাটা, কে জানত! প্রচারমুখী খেলার নিয়তির পদার্পণ– বলা কি যায় না মারাত্মক এক শৌভিক বাস্তব!
ঘটনার শুরু, দিন দশেক আগে। ৪ ডিসেম্বর। স্থান: হায়দরাবাদের ‘সন্ধ্যা’ সিনেমা হল। সেখানে ‘পুষ্পা টু’-র প্রথম শো। জনসমুদ্র ঢেউ তুলছে ‘সন্ধ্যা’-র চারপাশে। কেউ নাকি জানে না হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হবেন সুপারস্টার, ‘পুষ্পা’-র নায়ক, আল্লু অর্জুন! পুলিশকে নাকি জানানোই হয়নি স্বয়ং ‘ঈশ্বর’-এর আবির্ভাব ঘটতে পারে বলে! চিত্রনাট্য এই পর্যন্ত নিখুঁত। আল্লু অর্জুন দৈব দীধিতির অপার্থিব আবেদন নিয়ে হুডখোলা মহাযানে ঢুকে পড়লেন উদ্বেল জনসমারোহে। আর, চিত্রনাট্য বেরিয়ে গেল হাতের বাইরে। বিষ্ণু দে-র ভাষায়, যে-মুহূর্তে ঘটল আল্লু অর্জুনের অপ্রত্যাশিত আগমন, ঠিক তখনই যেন ‘জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার’ আর অবিস্মরণীয় অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মনপ্রাণ বলে উঠল, ‘হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর/ আযোজন কঁাপে কামনার ঘোর।’
এই ‘ঘোর’ যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা জানা ছিল না কারও। সেই তাড়িত, অন্ধ ঘোরের শিকার হলেন তরুণ রেবতী। হাত ছাড়েননি তিনি তঁার আট বছরের ছেলের। ছেলের হাত ধরেই দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন। আর আট বছরের সেই বালকের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। রেবতীর স্বামী, বালকটির পিতা, শোকাহত ভাস্কর থানায় এফআইআর করলেন অাল্লু অর্জুনের নামে। প্রচারমুখী খেলার এ কী প্রক্ষিপ্ত প্রান্ত! কী করে আনা যাবে এই মৃতু্যময় শোকের ছায়াকেও কোনও সম্ভাব্য প্রলেপের বিশ্বাস্য আন্তরিকতায়? আল্লু অর্জুন মৃত রেবতীর স্বামী ভাস্করকে পাঠিয়ে দিলেন ২৫ লক্ষ টাকার ‘ক্ষতিপূরণ’। এবং দায়িত্ব নিলেন রেবতীর ছেলের চিকিৎসার। ভাস্করকে জানালেন, ‘আপনাদের পাশে আছি, যদিও এই ঘটনায় জানি না আমি কীভাবে দোষী হতে পারি?’
সতি্যই তো, কোনওভাবেই আল্লু অর্জুনকে ‘দোষী’ বলা যায় কি? অপরাধী যদি কাউকে, কিছুকে বলা যায়, সে তো এই সুপারস্টারের অপার আকর্ষণ। তঁার টানকে হাজার হাজার মানুষ সামলাতে পারছে না, তঁাকে দেখামাত্র সবাই তঁাকে কাছে পাওয়ার জন্য, একটিবার ছুঁয়ে দেখার রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার জন্য, তঁার দিকে ধাবমান। অবস্থা মুহূর্তে চলে যাচ্ছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই আকর্ষণের কারণেই তিনি ‘মহাতারকা’। দিন-রাত, বছরের-পর-বছর, কী অসামান্য গণিতশাসিত নিখুঁত চর্চার ফসল তঁার শরীর, তঁার সৌন্দর্য, তঁার সমস্ত নির্মিত ভঙ্গি ও তঁার ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্ব! এই যে তোলপাড়টা ঘটল, এই যে তঁার আকস্মিক আবির্ভাব টেনে নিয়ে এল জনপ্লাবন, এসব তো তঁারই সমারোহ ও সংকর্ষণের প্রমাণ। তঁার জন্য এই উন্মাদনা যে এমন অবিশ্বাস্য রূপ নেবে, ডেকে আনবে মৃতু্য, এ তো কল্পনাও করা যায় না।
তারকাদের জন্য এই উন্মাদনা, এ বুঝি চিরকালের সত্য! সেই কবে রবীন্দ্রনাথের মৃতু্যর কথা ভাবুন। কিংবা উত্তমকুমারের মৃতু্য। বাঙালির আবেগ এবং উন্মাদনা কিন্তু সতি্যই ছিল না নিয়ন্ত্রণে। হয়তো সেই আবেগতাড়িত মানুষের প্লাবনে কারও মৃতু্য ঘটেনি। কিন্তু ঘটতে যে পারত দুর্ঘটনা, যে কোনও মুহূর্তে, সে-কথা তো নিশ্চিত। রবীন্দ্রনাথের দেহ যেভাবে মানুষের মাথায়-মাথায়, জনসমুদ্রের ঢেউয়ের মধে্য, আত্মীয়দের চোখের সামনে, অদৃশ্য হয়ে গেল, তাতেও কি থেকে যায়নি বহু মানুষের হৃদয়বেদনা?
কিন্তু এই সতে্যর একটি উলটোদিকও আছে। আর সেই বিপ্রতীপ দিকের বার্তাটি হল, বেশিরভাগ মানুষ তৈরি করতে ভালবাসে উন্মাদনার, মাতিয়ে রাখার, নেশা-ধরানো ‘আইকন’। এমন একজন ‘আইকন’ বা ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষ চায়, যার আশ্চর্য আকর্ষণে তারা অন্ধ ভাবাবেগে নোঙর ফেলতে পারে। এবং যার টানে তারা, সমস্ত যুক্তিতর্ক থামিয়ে, খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে পারে। কোনও মানুষ বেছে নেয় তার ‘আদর্শ আইকন’-কে কোনও ধর্মগুরুর মধে্য, তো কারও ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন ইলন মাস্কের মতো কোনও কিমাশ্চর্য ধনকুবের! কেউ অন্ধ আবেগে তার সমস্ত হৃদয় বেঁধে রাখে মেসির পদযুগে, তো কেউ বা হঠাৎ কোনও দোকানে বা রেস্তোরঁায় শচীনকে দেখে হারাতে পারে সভ্যতা, সম্বিত এবং ব্যবহারে হয়ে উঠতে পারে দিশাহারা। এই ‘আইকন’ প্রবণতা সাধারণ মানুষের একপ্রকার দুর্বলতাই, যা বেয়াড়াভাবে জড়িয়ে ধরে তারা বেঁচে থাকে। এবং মানুষের এই নায়ক-নায়িকা পুজোর সুযোগ নেয় কিছু মানুষ। এসব মানুষ অসামান্য প্রতিভার অধিকারী হতে পারেন। এবং তঁাদের প্রতিভার, তঁাদের বিচিত্র গুণাবলির আকর্ষণকে আমি কোনওভাবে অস্বীকার করছি না। কিন্তু তঁাদের আকর্ষণ এবং সান্নিধ্য আমরা যতই উপভোগ করি না কেন, তঁাদের ব্যক্তিত্বের অঁাচ আমাদের যতই টানুক না কেন, তঁাদের অন্ধ আবেগে ভেসে গিয়ে জ্ঞানগমি্য হারিয়ে পাগলামি করব কেন? কেন তঁাদের দেব আমাদের আবেগময় দুর্বলতার সুযোগ নিতে? এবং কেন তঁাদের গড়ে তুলতে দেব, আমাদের দুর্বলতার উপরেই ঈপ্সিত ভাবমূর্তি? প্রতিটি ভাবমূর্তি, প্রতিটি চর্চিত প্রকাশ কিন্তু নির্মিত, কপট, এবং চতুর। প্রতিটি ভাবমূর্তির সৃজনে একটিই উদ্দেশ্য কাজ করছে, কী করে চুরি করব আবেগ, কীভাবে ছিনিয়ে নেব মন, কীভাবে ধৌত করব মস্তিষ্ক, কীভাবে জিতে নেব যুক্তি-তর্ক সরানো অন্ধভক্তি ও মুগ্ধতা।
এই যে চারিদিকে গজিয়ে উঠেছে প্রবল বাণিজি্যক উৎসাহনে ও উদ্দেশে্য ‘নায়ক-নায়িকা’ সংস্কৃতি, এটা কিন্তু আইকন-কালচারের এক উৎকট ভাল্গার রূপ। কোটি-কোটি টাকা খরচ করে কিছু মানব-মানবীকে লার্জার-দ্যান-লাইফ ভাবমূর্তিতে সৃজন করা হচ্ছে। এই সৃজনের মধে্য কোনও রকম কপটতা, চাতুর্য, অসাধুতা, মিথ্যাচার নেই– তেমন বলি কী করে? এই আইকন-সংস্কৃতির এক অমোঘ নির্মাণ আল্লু অর্জুন।
তঁার গল্পে ফের ফিরে যাই চলুন। সেই ৪ ডিসেম্বর তঁার হঠাৎ দৈব আবির্ভাব ডেকে নিয়ে এল জনসমুদ্র, তাড়িত আবেগের দিশাহারা ভিড়, এবং সেই ভিড়ে মারা গেলেন বালক পুত্রর হাত ধরে এক তরুণী মা– সেই ঘটনার দিন দশ-বারো পরের ঘটনা। সকালবেলা বেডরুমে বসে চা খাচ্ছেন ‘পুষ্পা টু’-র অবিকল্প নায়ক, সুপারহিট আল্লু অর্জুন। তঁার ঘরে ঢুকে এল হায়দরাবাদের একটি পুলিশ দল। বলল, ‘আপনাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছি। সহযোগিতা করুন।’ ভাবলেশহীন আল্লু উঠে পড়লেন। স্ত্রীর গালে চুমু দিলেন। বাবাকে বললেন, ‘একটু ঘুরে আসছি। ভেবো না।’ পুলিশদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। তঁার সাদা টি-শার্টে লেখা পুষ্পার ডায়ালগ: ‘ফ্লাওয়ার নহি, ফায়ার হ্যায় হম্’ (দেখুন, ছবির কীভাবে প্রচার হচ্ছে)।’
পুলিশ অবশ্য তঁাকে জানিয়ে দিয়েছে কী অপরাধে তিনি অ্যারেস্টেড– পুলিশকে না-জানিয়ে তিনি তঁার ছবির প্রিমিয়ারে ‘সন্ধ্যা’ সিনেমা হলে গিয়েছেন। এবং তার ফলে ভীষণ ভিড়ে এক মহিলার মৃতু্য। তাই তঁাকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার যে-ধারায় অ্যারেস্ট করা হল: ধারা ১০৫, অনিচ্ছাকৃত মৃতু্য ঘটানোর অভিযোগে। এরপর আল্লু অর্জুনকে আদালতে পেশ করা হয়। নিম্ন আদালত তঁাকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতে পাঠাল। এরপরই হায়দরাবাদের হাই কোর্টে অ্যাপিল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে জরুরি শুনানি। সন্ধেবেলায় আল্লু অর্জুনের অন্তর্বর্তী জামিন হয়ে গেল। তবে জামিনের কাগজপত্র রেডি করা গেল না। রাত হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার রাত জেলেই কাটালেন আল্লু। ভালই হল। সারা রাত জেলের বাইরে চলল ভক্তদের প্রার্থনা, স্তবগান, প্রতিবাদ। আরও এক কাণ্ড ঘটল– ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে মৃত রেবতীর স্বামী বললেন, ‘আমি আল্লুর বিরুদ্ধে কেস তুলে নিচ্ছি। ওঁর তো কোনও দোষ নেই। আমার স্ত্রীর মৃতু্যর জন্য ওকে দায়ী করতে পারি না।’
এসব দেখে-শুনে অনেকেই তাই বলছেন, চিত্রনাট্য আগে থেকেই লেখা ছিল। তবে কিছু ডিটেলের কাজ, ইন্টারপোলেশন, পরে ঢুকেছে। ‘আইকন’ সংস্কৃতির মূলকথাটি হল, ‘আইকন’ বা ভাবমূর্তিটি যেন অক্ষত থাকে। নেটিজেনের বক্তব্য, আল্লু অর্জুনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তিতে মোটেও অঁাচড় পড়েনি– যাই ঘটে থাক না কেন! অনেকে আবার এই ঘটনায় আল্লু অর্জুনের বিরুদ্ধ ‘লবি’-র অতিসক্রিয়তা খুঁজে পেয়েছেন। এ অনুমান ঠিক না ভুল আমরা এখনও জানি না, তবে আল্লু অর্জুনের ‘আইকনিক স্টেটাস’ যে এতে ক্ষুণ্ণ হবে না, তা নিশ্চিত। তবু চাপা সংশয়ের দোলাচল যে থেকে যায় না গায়ে কুয়াশা জড়িয়ে, তাও তো নয়!