শংকর ভট্টাচার্য: ১৯৯৭ সালে মণিরত্নমের ছবি ‘ইরুভার’ হিটের তকমা পেয়েছিল। সমালোচনাও হয়েছিল বিস্তর। করুণানিধি আর এম জি রামচন্দ্রনের বন্ধুত্ব আর বৈরিতা তুলে ধরা হয়েছিল। তামিলসেলভন আর আনন্দনের সম্পর্ক নিয়ে গল্প। প্রকাশ রাজ তামিলসেলভনের ভূমিকায় তুলে ধরেছিলেন করুণানিধির চরিত্র। আর মোহনলাল বা আনন্দন এমজিআরের ভূমিকায়। আসলে করুণানিধির রাজনৈতিক জীবনে সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছেন এম জি রামচন্দ্রণ আর জয়ললিতা। মেগা স্টার এমজিআর প্রথম থেকেই ছিলেন তাঁর বন্ধু। বস্তুত করুণার স্ক্রিপ্ট আর এমজিআরের অভিনয়ের মেলবন্ধনই ছিল বহু হিট ছবির সাকসেস ফর্মু্লা। এই সমীকরণ সব থেকে বেশি কাজে লেগেছিল ডিএমকের উত্থানের পিছনেও। এমজিআরের জনপ্রিয়তা মানুষ টেনে আনত সভায়। আর করুণানিধির বক্তব্যে জনতাকে দলের চিরস্থায়ী সমর্থকে রূপান্তরিত করত। আন্নাদুরাইয়ের নেতৃত্ব আর করুণা-এমজিআরের বন্ধুত্বই ১৯৬৭-তে ক্ষমতায় আনে ডিএমকে-কে। সেই হারের পর আর কোনও দিনই তামিলনাড়ুর ক্ষমতায় আসতে পারেনি কংগ্রেস বা কোনও জাতীয় দল। কিন্তু সেই বন্ধুত্বও ভেঙেছিল। অনেকে বলেন জয়ললিতার জন্যই।
[মেরিনা বিচেই সমাহিত করুণানিধি, ঠাঁই পেলেন আন্নাদুরাইয়ের পাশে]
মাদুরাইয়ের এক সভায় জয়াকে মঞ্চে বক্তা হিসাবে রাখার কথা বলেছিলেন এমজিআর। জয়ললিতার সঙ্গে তখন তাঁর দারুণ ‘বন্ধুত্ব’। আপত্তি করেন করুণা। বলেন, জয়া দ্রাবিড় আন্দোলনের কেউ নন। তাঁকে সামনে নিলে দলের ক্ষতি হবে। গোঁসা হয় রামচন্দ্রণের। সেই নাকি শুরু। এর পর মুখ্যমন্ত্রী করুণার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন সরাসরি। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গঠিত হয় সারকারিয়া কমিশন। তদন্তের রিপোর্টে ফ্লাইওভার দুর্নীতি সামনে আসে। উঠে আসে আরও বহু ‘স্ক্যাম’। এমজিআর-কে ডিএমকে থেকে বরখাস্ত করা হয়। জয়াকে সঙ্গে নিয়ে এমজিআর তৈরি করেন এডিএমকে। তা আজ ইতিহাস। কিন্তু এমজিআরের সঙ্গে অম্ল-মধুর সম্পর্ক থাকলেও জয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চিরকালই ছিল অহি-নকুল।
তামিল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলেন, জয়ার বুদ্ধি আর বিচক্ষণতাকে বুঝতে ভুল করেছিলেন করুণানিধি। একে অন্যকে ছেড়ে কথা বলেননি জীবদ্দশায়। প্রতিশোধই ছিল তাঁদের দু’জনের সম্পর্কের মূল সুর। প্রথম বড় ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ এর ২৫ মার্চ। তখন বিধানসভার অধিবেশন চলছে। মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধি হাতেই অর্থ দপ্তর। বাজেট ভাষণ দিচ্ছেন। হইচই জুড়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেত্রী জয়ললিতা। ডিএমকে বিধায়ক দুরাইমুগুরগন-সহ অন্যরা তাঁকে কার্যত তুলে নিয়ে ফেলে দেন সভার বাইরে। জয়ার অভিযোগ, তাঁর শাড়ি ছিঁড়ে দিয়ে শ্লীলতাহানি করেছেন ডিএমকে বিধায়করা। এই ঘটনাকে এআইএডিএমকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সঙ্গে তুলনা করে তামিলনাড়ু জুড়ে প্রচার শুরু করে দেয়। সহানুভুতির স্রোতে ভেসে যান আম্মা জয়া। টিভিতে বারবার দেখানো হয় সেই শাড়ি ছেঁড়ার ছবি। যদিও পরে বহুবার দুরাইমুরুগন এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির বিরুদ্ধে এলটিটিইকে সমর্থনের অভিযোগ ওঠে। ’৯১ সালের ৩০ জানুয়ারি সরকার ফেলে দেয় কেন্দ্র। তখন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর। কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার চলছে। এর পরেই মে মাসে সেই জাতীয় বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। ভোট প্রচারে গিয়ে শ্রীপেরামপুদুরে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান রাজীব গান্ধী। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে এআইএডিএমকে সরকার গঠন করে তামিলনাড়ুতে। প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হন জয়া। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬, এই পাঁচ বছরে করুণানিধির রাজনৈতিক জীবন কার্যত ওষ্ঠাগত করে তোলেন আম্মা। জয়ললিতার একটাই লক্ষ্য ছিল, বৃদ্ধ করুণাকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করে দেওয়া। ওঠে বহু দুর্নীতির অভিযোগ। ১৯৯৬-এ ক্ষমতায় ফিরেই ‘বদলা’ নেন করুণা। ১৯৯৮ এর ৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় জয়ললিতা আর তাঁর বান্ধবী শশীকলাকে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলা। সেই মামলাতেই অবশ্য এখন চার বছরের জন্য জেলে শশীকলা। আর মৃত্যুর পর দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন জয়া।
২০০১-এ ফের ক্ষমতায় এসে করুণার সেই বদলা নেন জয়া। ২৯ জুন মাঝরাতে চেন্নাইয়ের ময়লাপুরের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। উড়ালপুল তৈরিতে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে। সান টিভিতে লাইভ ছবি দেখে সহানুভুতির জোয়ার শুরু হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে লুঙ্গি পরে মাটিতে বসে আছেন বৃদ্ধ করুণানিধি। সেই ছবি আজও চোখে ভাসে।
জয়া আম্মা প্রয়াত হয়েছেন। এমজিআর বহু আগেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন। এবার চলে গেলেন করুণানিধি। একটা গোটা অধ্যায় শেষ হল।
[ধোনির খেলা দেখার জন্য এই কাজটিও করতেন করুণানিধি!]
The post সিনেমাতেও উঠে এসেছিল জয়া, করুণা ও এমজিআর-এর ত্রিকোণ সম্পর্ক appeared first on Sangbad Pratidin.