আজ কর্ণাটকে ভোট। এটাই একমাত্র রাজ্য, যেখানে কংগ্রেসের ধার ও ভার ঈর্ষণীয়। জনমতে কংগ্রেস এগিয়ে। বিজেপিও অন্যদিকে মরিয়া। মেরুকরণের চেষ্টা মুসলমান সমাজকে যেমন দ্বিধাহীনভাবে কংগ্রেসের পাশে দাঁড় করিয়েছে, অ-মুসলমান সমাজ জাতপাত ভুলে ‘হিন্দু’ হিসাবে এককাট্টা হলে আবার বিজেপির পোয়াবারো! লিখলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ কর্ণাটকে ভোট (Karnataka Elections 2023)। এ নিয়ে এত চর্চা, এত উৎসাহ, এত জল্পনার কারণ অনেক। এই ভোটের ফল বুঝিয়ে দেবে, বছরশেষে আরও চার বড় রাজ্য– তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে বিজেপিকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে কি না। চর্চা পরের বছরের মহারণ নিয়েও। ইতিমধ্যেই যা চিহ্নিত নরেন্দ্র মোদির (PM Modi) প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাব্য হ্যাটট্রিকের বছর হিসাবে।
বিরোধীদের কাছে কর্ণাটকের ভোট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। কংগ্রেসের (Congress) কাছে তো বটেই। বিজেপির মোকাবিলায় দলটা এখনও কত দড়, শুধু সেই প্রমাণই নয়, কর্ণাটক জিততে পারলে তাদের মরা গাঙে হড়পা বান আসবে। কংগ্রেসিদের মনে ক্রমেই যে বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে, ভুলতে বসেছে একটা সময় তারাই ছিল একমাত্র সর্বভারতীয় দল, কর্ণাটক জয় সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে। বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনের সলতে পাকানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের জয় তাতে নিশ্চিতভাবেই গতি আনবে। বিহার-নরেশ নীতীশ কুমার এমনি এমনি কর্ণাটক ভোটের পর তাঁর খাসতালুকে সমভাবাপন্ন দলনেতাদের বৈঠকের কথা জানিয়ে রাখেননি।
অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এবারের কর্ণাটকি ভোট-চিত্র অনেক দিক থেকে পৃথক। এটাই একমাত্র রাজ্য, যেখানে কংগ্রেসের ধার ও ভার ঈর্ষণীয়। রাজ্যস্তরের নেতারা নিজের ক্ষমতায় নির্বাচন বৈতরণি পেরনোর যোগ্য। স্বর্ণযুগে দলটা যেমন সমাজের সর্বস্তরীয় প্রতিনিধির সমাহার ছিল, এখনকার কর্ণাটক তারই মিনি সংস্করণ। অনগ্রসর মহলের নেতৃত্বে রয়েছেন সিদ্দারামাইয়ার মতো জননেতা, মুখ্যমন্ত্রী থেকেও যিনি দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি হননি। ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন সম্পদশালী প্রদেশ সভাপতি ডি. কে. শিবকুমার, বিপদে-আপদে, সংকটে বারবার যিনি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মুশকিল আসান হয়েছেন। আর রয়েছেন দলিত সমাজের অবিসংবাদিত নেতা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। বছর কয়েক যাবৎ রাজ্যের কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ মদতে হিজাব, আজান, হালালের ধুয়ো তুলে এই লড়াইকে ‘টিপু সুলতান বনাম সাভারকরের উত্তরাধিকারীদের’ দ্বৈরথে পরিণত করতে চাইছে। অথচ রাজ্যের ভোট-ইতিহাস বলছে, কয়েকটি অঞ্চল ছাড়া সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ কখনও প্রাধান্য পায়নি। উত্তর ভারতে ভোট-সাফল্যের ফর্মুলার প্রয়োগ বিজেপি এবার কর্ণাটকে করছে। সেই কারণে আদিত্যনাথ ও হিমন্ত বিশ্বশর্মাদের বারবার প্রচারে পাঠিয়েছে। অমিত শাহ-র ভবিষ্যদ্বাণী, কংগ্রেসকে আবাহন করলে রাজ্যবাসীকে দাঙ্গা সইতে হবে। এই মেরুকরণের চেষ্টা মুসলমান সমাজকে দ্বিধাহীনভাবে কংগ্রেসের পাশে দাঁড় করিয়েছে। অ-মুসলমান সমাজ জাতপাত ভুলে ‘হিন্দু’ হিসাবে এককাট্টা হলে বিজেপির পোয়াবারো।
রাজ্যের শহরাঞ্চল ও প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত সমাজ ছিল বিজেপির নির্ভয় বিচরণভূমি। কর্নাটকে যাঁর হাত ধরে বিজেপি লালিত ও পালিত, সেই বি এস ইয়েদুরাপ্পার দৌলতে লিঙ্গায়েত সমাজ বিজেপিকে যেমন বুকে জড়িয়েছে, তেমনই কোল থেকে নামিয়েও দিয়েছে। কিন্তু তবুও এ-যাবৎ কোনও নির্বাচনই বিজেপিকে প্রশ্নাতীত গরিষ্ঠতা দেয়নি। অশীতিপর, কিন্তু সক্রিয় ও উচ্চাশী ইয়েদুরাপ্পার অবস্থান আদবানি-যোশীর মতো ‘মার্গদর্শক’ করে নরেন্দ্র মোদি রাজনীতির যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা হারাকিরি হবে কি না– ১৩ মে বোঝা যাবে। আপাতত দেখা যাচ্ছে, ইয়েদুরাপ্পা প্রায় ‘বসে গিয়েছেন’। লিঙ্গায়েত সমাজও বিভ্রান্ত। এই সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতাদের অনেকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। ভোটের চারদিন আগে লিঙ্গায়েত সমাজের এক প্রভাবশালী অংশ চিঠি লিখে কংগ্রেসকে সমর্থনের ডাক দিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত ও ন্যুব্জ বিজেপি থেকে লিঙ্গায়েত সমাজ মুখ ফেরালে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে আশাবাদী হওয়া কিন্তু কঠিনস্য কঠিন।
রাজ্যে যতগুলি জনমত সমীক্ষা হয়েছে, প্রতিটিতেই কংগ্রেস এগিয়ে। অনেকে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাও দিয়েছে। ১৯৮৫ সালের পর এই রাজ্যে কোনও দল পরপর দু’বার জেতেনি। সেই নিরিখেও এবার ‘অ্যাডভান্টেজ কংগ্রেস’। কিন্তু কংগ্রেস তো সেই দল, যে নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে হার ছিনিয়ে নিতে ওস্তাদ। অসম, কেরল, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। শেষবেলায় বজরঙ্গ দল ও পিএফআই-কে একাসনে বসিয়ে তারা যে-নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, মেরুকরণের তীব্র তাগিদে মরিয়া বিজেপির কাছে সেটাই হয়ে উঠেছে শেষ পারানির কড়ি। প্রধানমন্ত্রী বজরঙ্গ দল ও বজরঙ্গবলীকে সমার্থক করে ফেলেছেন। শেষবেলার ভাষণগুলো শেষ করেছেন ‘জয় হিন্দ’ বা ‘ভারতমাতা কি জয়’-এর বদলে ‘জয় বজরঙ্গবলী’ স্লোগান দিয়ে। যে-খেলায় নরেন্দ্র মোদি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই খেলায় তঁাকে আবাহন করা কংগ্রেসের বোকামি।
বিজেপির ‘কংগ্রেসায়ন’ এখন চূড়ান্ত। ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে কংগ্রেসে ‘হাই কমান্ড কালচার’ শুরু। কালে কালে ‘হাই কমান্ড’ হীনবল হয়েছে। কিন্তু প্রথাটা টিকে আছে। মোদি জমানা শুরুর পর ধীরে ধীরে বিজেপিতেও শুরু হয়েছে সেই সংস্কৃতি। মোদি-শাহ জুটিই সব। বাকি সব অনিত্য। নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রবল বিশ্বাসী এই জুটি গুজরাট, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের পর এবার কর্ণাটককেও পরীক্ষাগার করে তুলেছে। ইয়েদুরাপ্পা, জগদীশ শেট্টার, লক্ষ্মণ সাভাডি, ইউ. বি. বানাকর, এস. এ. রামদাস, রঘুপতি ভাটদের মতো প্রবীণ, পরীক্ষিত ও প্রভাবশালী– যাঁরা কখনও কেন্দ্রীয় নেতাদের ইশারায় পরিচালিত হননি, বরং স্বকীয়তা বজায় রেখে রাজ্যে রাজনীতি করেছেন, তাঁদের বদলে প্রার্থী করা হয়েছে নবীন ও কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের, দিল্লি দ্বারা যাঁরা ‘পরিচালিত’ হতে ইচ্ছুক।
কেন্দ্রীয় এই নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আরও একটি বিষয় এই রাজ্যে বিজেপির চিরায়ত সমর্থক শিবিরে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে রাজ্যের যাঁরা কলকে পেয়েছেন (প্রয়াত অনন্ত কুমার) ও এখন পাচ্ছেন (বি এল সন্তোষ এবং প্রহ্লাদ যোশী) তাঁরা সবাই ব্রাহ্মণ। প্রচার, সাত কোটি জনতার বড়জোর তিন শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও সন্তোষ-যোশী জুটি চার দশক পর রাজ্যকে ব্রাহ্মণ মুখ্যমন্ত্রী (১৯৮০ সালে গুন্ডু রাও ও ১৯৮৩ সালে রামকৃষ্ণ হেগড়ে) উপহার দিতে উৎসুক। এত কলকাঠি নাড়ার উদ্দেশ্য নাকি সেটাই।
বিজেপির কংগ্রেসায়নের দরুন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই দলের প্রথম ও শেষ কথা। অথচ কর্নাটকের ইতিহাস দেখাচ্ছে, বিধানসভা নির্বাচনে সেই ১৯৮৫ সাল থেকে রাজ্য নেতৃত্বই প্রাসঙ্গিক। এই প্রথম রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন বিজেপি ‘মোদিময়’ করে তুলল। সফল হলে দাক্ষিণাত্যের ভোট আখ্যানেও উত্তরের ধারা বইবে।
তুলনায় কংগ্রেসের প্রচার প্রচণ্ডভাবে ‘হাইপার লোকাল’। সিএসডিএস-লোকনীতির সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধিতে শহর-গ্রামের মধ্যবিত্ত ও গরিব জেরবার। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ অগ্রাহ্য করে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা প্রতিদিন নিয়ম করে এদের সঙ্গে মিশছেন। জনতায় অবগাহন করছেন। কংগ্রেসি প্রচারে আদানি-আম্বানি-ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বদলে উঠে এসেছে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের ছোবল এবং অবশ্যই ৪০% কমিশনের সরকারের ঔদাসীন্য। ২ লাখ ৫৮ হাজার সরকারি শূন্যপদে নিয়োগের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি মমতা-কেজরিওয়ালের দেখানো রাস্তায় হেঁটে আর্থিক অনুদানের মনকাড়া ফিরিস্তি কংগ্রেস মেলে ধরেছে ইস্তাহারে। নরেন্দ্র মোদির বলা ‘ভোকাল ফর লোকাল’-কে ছাপিয়ে ‘হাইপার লোকাল’ কংগ্রেস এভাবে ধর্মীয় মেরুকরণ ঠেকিয়ে দিলে হিন্দুত্ববাদ-সর্বস্ব চেতনা কিছুটা ধাক্কা খাবে। কর্নাটকবাসী আজ সেই পরীক্ষাতেও বসছে।
কর্ণাটক নরেন্দ্র মোদিরও পরীক্ষা। কিস্তিমাতে মরিয়া তিনিও। কীভাবে, এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ নিজেই তা জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “সাড়ে ন’বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী ধারাবাহিকভাবে জনমুখী প্রকল্প চালু রেখেছেন। দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন পরিষেবা। জাতপাত ও ধর্ম নির্বিশেষে তা জন্ম দিয়েছে সুবিধাভোগী এক বিপুল জনগোষ্ঠীর। এই জনগোষ্ঠী শুধু তঁাকেই জানে। তাঁকেই চেনে। তাঁকেই বিশ্বাস ও ভরসা করে। এরাই তাঁর বর্ম, শক্তি ও সমর্থনের আধার। মোদির ললাটে বিজয় তিলক এরাই এঁকে দেয়।”
কর্ণাটকেও কি আঁকবে? জনতার রায় ইভিএম-বন্দি হওয়ার দিন আজ।