শীতকাল মানেই চামড়ায় টান, ত্বক থেকে চুলের জেল্লা ম্লান। এই সময় তেলের দরকার। কিছু ভেষজ তেলের সহায়তায় রুক্ষতা কাটিয়ে চকচকে থাকা যায়। সেগুলি কী কী? কোনটায় কী উপকার মিলবে সে ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনায় আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা। লিখলেন গৌতম ব্রহ্ম।
শুষ্কতা শীতের দোসর। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ, সর্বত্র তার উচ্চকিত উপস্থিতি। গোড়ালি, চুল, ঠোঁট ফেটে চৌচির। বাড়ে খুশকির প্রকোপও। এই কথা সবাই জানি। শুধু জানি না মোকাবিলায় উপায়। অনেকেই ঘরোয়া টোটকায় বিশ্বাসী। কেউ আবার বিজ্ঞাপনী চটকে বিভ্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সাধারণভাবে তিল, নারকেল, অলিভ তেল উপকারী হলেও সকলের ত্বকের পরিস্থিতি এক রকম নয়। তাই ত্বকের ধরন এবং সমস্যা অনুযায়ী তেল বেছে নেওয়া উচিত। আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানে তেলের ব্যবহার ও গুরুত্ব অপরিসীম। হাতের নাগালে থাকা কয়েকটি তেল নিয়ে আলোচনা করা যাক।
তিল তেল
এটি গুণে বর্ণপ্রসাদক, পুষ্টিকারক। শরীরের বিভিন্ন প্রকার শূল ব্যথায় (কর্ণশূল, শিরশূল ইত্যাদি) নিবারক। তিল তেল নিয়মিত মাখার অভ্যাস চর্ম, কেশ ও চোখের পক্ষে ভালো। বাতব্যাধি চিকিৎসায় ও পঞ্চকর্ম থেরাপিতে তিল তেলের বিকল্প নেই। তিলে রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসিড, ওমেগা৩, ওমেগা৯-এর মতো কিছু যৌগ যা নতুন চুল গজাতে, চুলের প্রাকৃতিক রং ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। স্নানের আধ ঘণ্টা আগে তিলের তেল মেখে রাখতে পারেন। চুল যদি খুব রুক্ষ হয় এবং ঠান্ডা লাগার ধাত না থাকে তা হলে এই তেল রাতেও মাথায় মেখে রাখতে পারেন।
নারকেল তেল
নারকেল তেলে থাকা অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ফাংগাল ত্বকের বিভিন্ন রোগ নিরাময় করতে পারে। শুধু তাই নয়, স্কিন টোন ফিরিয়ে আনতেও সহায়তা করে। নারকেল তেল দিয়ে মাসাজ করলে ত্বকের উপর একটি আবরণ বা আস্তরণ তৈরি হয়। যা প্রোটেক্টিভ লেয়ার হিসাবে ত্বককে রক্ষা করে ধুলোবালি, নোংরা, ময়লা থেকে। বলিরেখার সমস্যা দূর করার পাশাপাশি নারকেল তেল ত্বকের একদম গভীর স্তর পর্যন্ত প্রবেশ করে ময়শ্চার লক করে। ফলে শীতের রুক্ষ, শুষ্ক আবহাওয়াতেও ত্বক থাকে উজ্জ্বল এবং মোলায়েম।
অলিভ অয়েল
অলিভ অয়েলে আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি এজিং যা ত্বকের খেয়াল রাখতে অত্যন্ত কার্যকর। কিউটিকল দূর করে নখের যত্ন নেওয়া যায়। তাই হোম ম্যানিকিওরে রাখা যেতে পারে অলিভ অয়েল। এই ময়েশ্চারাইজিং তেল নখের কোণে বা আশেপাশে লেগে থাকা খারাপ চামড়া অর্থাৎ পিলিং স্কিনগুলি দূর করতে পারে।
করঞ্জ তেল
এই তেল কৃমি, নেত্ররোগ, বাতব্যাধি ও ক্ষত নাশে প্রয়োগ হয়ে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগে বাহ্যিক প্রয়োগে আশাতীত ফল পাওয়া যায়। এই তেল প্রধানত ত্বকে ফোড়া এবং একজিমা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ক্ষত নিরাময়ে প্রয়োগ করা হয়। এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণ আছে। প্রদাহ বিরোধী কার্যকলাপের কারণে আর্থ্রাইটিসে উপকারী।
নিমতেল
দৈনন্দিন জীবনে বহুমুখী স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা প্রধানত ব্রণ, ক্ষত, দাঁতের রোগে, চুলের খুশকি ও উকুনের সমস্যায় নিম তেল উপকারী। ব্রণ ও ক্ষতের সমস্যায় সরাসরি এক থেকে দুই ফোঁটা নিম তেল আঙুলে করে ব্রণর উপর দিনে দুই থেকে তিনবার লাগিয়ে রাখুন। তবে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসাও জরুরি। চুলের খুশকি ও উকুনের সমস্যায় শ্যাম্পুর সঙ্গে কয়েক ফোঁটা নিমতেল মিশিয়ে নিয়মিত মাথায় ব্যবহার করলে ভালো। ত্বকের কালচে ভাব কাটাতেও নিমতেল উপযোগী।
[আরও পড়ুন: একাধিক নারী বা পুরুষে আকৃষ্ট! হরমোন দোষেই কি চরিত্রহীন?]
এরণ্ড তেল বা ক্যাস্টর অয়েল
ছোট বাচ্চা, প্রসূতি,বয়স্ক ব্যক্তিদের কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় বিরেচন করাতে এরণ্ড তেলের জুড়ি মেলা ভার। কারণ দ্রব্যগুণে এটি মধুর, উষ্ণ, পিচ্ছিল গুণযুক্ত অগ্নি দীপনকারী তেল। পাশাপাশি এটি মলবদ্ধতা, বাতরক্ত, বিষমজ্বর নাশক। এক থেকে দুই চামচ ঈষৎ গরম জল বা দুধের সঙ্গে রাতে সেবনীয়।
বাদাম তেল
বাদাম তেলে আছে ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই যা ত্বক ভালো রাখতে সহায়তা করে। বাদাম তেল শুধু শুষ্ক ত্বক থেকেই মুক্তি দেয় না, ত্বকে পুষ্টি জোগাতেও সহায়তা করে।
মহামাশ তেল
বয়সজনিত কারণে যাঁদের হাড়ের সন্ধি দুর্বল হয়ে পড়েছে বা বিভিন্ন প্রকার বাতব্যাধি সমস্যায় (যেমন হাঁটু, কোমর, ঘাড়ে ব্যথা, বাহুশোষ ইত্যাদি) যাঁরা দীর্ঘদিন ভুক্তভোগী তাঁরা প্রাথমিক স্তরে মহামাশ তেল ঈষৎ উষ্ণ অবস্থায় ব্যবহারিক প্রয়োগে সুফল পাবেন। সাধারণ ব্যথাতেও কার্যকর এই তেল।
কুমকুমাদি তৈল
মুখে অবাঞ্ছিত দাগ ছোপ, মেচেতা থেকে রেহাই পেতে নিয়মিত কুমকুমাদি তেলের ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসূ। তবে যকৃতের সমস্যা বা পেটের গোলযোগ থাকলে তার চিকিৎসাও জরুরি।
প্রসারণী তেল
যাঁদের হাত-পায়ে প্রায়ই খিল ধরছে বা যাঁরা পেশীর সংকোচন জনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাঁরা চিকিৎসার পাশাপাশি আয়ুর্বেদের প্রসারণী তেলের প্রয়োগে যথেষ্ট লাভবান হবেন। এই তেল ঈষৎ উষ্ণ অবস্থায় মালিশ করে হালকা সেঁক নেওয়াই় নিয়ম।
ষড়বিন্দু তেল
কফ বৃদ্ধিজনিত কারণে নাক বন্ধ বা সাইনাস ঘটিত সমস্যায় ভুগলে, মাইগ্রেনের ব্যথায় কষ্ট পেলে সকাল-সন্ধে দুই নাকে তিন ফোঁটা করে ষড়বিন্দু তেলের নস্য নিন।
জাত্যাদি তৈল
নিম, হরিদ্রা, মঞ্জিষ্ঠা, যষ্টিমধু, জাতিপত্র ও অন্যান্য ভেষজ সমৃদ্ধ এই তেল বিভিন্নপ্রকার ক্ষত, দুষ্ট ব্রণ, পুঁজ যুক্ত ঘায়ের নিরাময় ভালো ফল দেয়। বর্তমানে চুলের সমস্যায় অধিকাংশ মানুষই নাজেহাল। মুক্তি পেতে অনেকেই নিয়মিত চুলে তেল দেন, কিন্তু বাজারচলতি অধিকাংশ তেল বিভিন্ন কেমিক্যাল যুক্ত থাকায় আখেরে অজান্তেই চুলের যত্নের নামে ক্ষতিসাধন হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আয়ুর্বেদে উল্লেখ ভৃঙ্গরাজ তৈল, ব্রাহ্মী তেল, যষ্টিমধু তৈল, মাল্যতাদ্য তেল চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে যথেষ্ট ফলপ্রসূ।
তবে শুধু তেল ব্যবহার করলেই হবে না। আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে ও পথ্য আহার করতে হবে।