স্টাফ রিপোর্টার: চার বছর আগে দূষিততম শহরের তকমা পাওয়া কলকাতা বাতাসের বিশুদ্ধতার মানে বিশ্বের ১১টি মহানগরের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও-র মতো প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোয় উন্নততম মহানগরীকে পিছনে ফেলে বাতাসে দূষণের মাত্রা কমানোয় তিলোত্তমা একধাক্কায় অনেকেই এগিয়ে গিয়েছে। শহরে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে ভাসমান অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির নিরিখে বিশ্বের ১১টি মহানগরের মধ্যে সর্বাধিক কম হল চেন্নাইতে। আর চেন্নাইয়ের পরেই বাতাসের বিশুদ্ধতার মানে দ্বিতীয় কলকাতা, তৃতীয় নিউ ইয়র্ক।
আইআইটি দিল্লির তরফে বাতাসের মান ও দূষণের মাত্রা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক সমীক্ষা রিপোর্টে তিলোত্তমার কার্যত দূষণমুক্তি ও পরিবেশের মান-উন্নয়ন নিয়ে এমন সুসংবাদে উল্লসিত কলকাতা পুরসভা ও নবান্ন। বাতাসে দূষণমুক্তির জেরে কলকাতায় ফুসফুস ও শ্বাসযন্ত্রের অসুখের হার কমবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
তিলোত্তমার মুকুটে এমন সাফল্য ও গর্বের পালক যুক্ত হওয়ায় তৃপ্ত এবং গর্বিত কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম নাম না করে সোমবার বিজেপির শীর্ষনেতাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন। মেয়রের কথায়, ‘‘দিল্লি থেকে কিছু পরিযায়ী নেতা এসে যাঁরা বাংলা তথা কলকাতার কুৎসা করেন, অপমান করেন রাজ্যের মানুষের সচেতনতা-সংস্কৃতি ও মেধাকে, তাঁদের এই সমীক্ষা রিপোর্ট দেখে নিতে বলব। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মেনে তিন বছরে ১৫ হাজার গাছ লাগানো, ৩০টি ‘ওয়াটার স্প্রিংলার, দু’টি ‘মিস্ট-ক্যানন’ দিয়ে জল ছড়িয়ে দূষণমুক্তির কাজ নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ায় এই সম্মান কলকাতার।’’
দিল্লির আইআইটির পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এবছরের মে মাসে বিশ্বের যে মহানগরগুলির বায়ুর মান নিয়ে গবেষণা করেন সেগুলি হল– নিউ ইয়র্ক, টোকিও, লন্ডন, সিওল, বেজিং, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কলকাতা, ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা মূলত বাতাসে পিএম ২.৫ ছাড়াও তাপমাত্রা, যানবাহনের কার্বন নিঃসরণের হার এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা নিয়েও তুলনামূলক আলোচনা করেন। একই সঙ্গে শহরের নিজস্ব অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতাও খতিয়ে দেখেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। সেখানেই চাঞ্চল্যকরভাবে একসময় কলকাতার বাতাসে যেখানে প্রতি ঘনমিটারে ভাসমান অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণ এক ধাক্কায় ২০০ পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে গত মে মাসে তা নেমে মাত্র ১৮তে নেমে এসেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, চেন্নাইয়ে প্রতি ঘনমিটারে ভাসমান ধূলিকণার পিএম ২.৫-এর হার যেখানে ১৬, সেখানে কলকাতা ১৮, নিউ ইয়র্ক ১৯, লন্ডন ২০ এবং মুম্বই ২১ হয়েছে।
[আরও পড়ুন: গিরি টপকে শিবের হাতে ১০০ দিনের বকেয়া, এবার ‘মামাজি’র দ্বারস্থ হতে হবে বাংলাকে ]
চার বছর আগে বাতাসের মানে বিশ্বের দূষিততম মহানগর ছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। কিন্তু এ বছরও ১১টি মহানগরের বাতাসের মান নিয়ে সমীক্ষায় সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কলকাতা থেকে মাত্র ৪৩৬ কিলোমিটার সড়কপথের দূরত্বের প্রতিবেশী দেশের রাজধানী। দিল্লির আইআইটির রিপোর্ট অনুযায়ী ১১টি মহানগরের মধ্যে দূষিততম শহর ঢাকা, তার অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণার পিএম ২.৫ মাত্রা হল ১৩৯। অবশ্য দূষণের হারে দশম স্থানে রয়েছে দিল্লি, নবম হয়েছে বেজিং।
চার বছর আগে বাতাসে দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক হওয়ায় উদ্বিগ্ন কলকাতা পুরসভা (KMC) পরিবেশ বাঁচাতে উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শদাতা কমিটি নিয়োগ করে। কমিটিতে আইআইটি খড়গপুর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বোস ইনস্টিটিউট ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। সেই কমিটির সুপারিশ মেনে দ্রুত শহর জুড়ে ব্যপক হারে গাছ লাগানো এবং বেশ কয়েকটি উন্নতমানের ‘ওয়াটার স্প্রিংলার’ গাড়ি ছড়িয়ে দেন মেয়র। বিশেষ করে বাড়ি ভাঙা বা নির্মাণের সময় বাতাসে যাতে ভাসমান ধূলিকণা না ছড়িয়ে পড়ে সেই লক্ষ্যে চট দিয়ে ঘেরা এবং রাবিশ পুরসভাকে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছেন ফিরহাদ।
একই সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘ আয়োজিত মিশর ও দুবাইয়ের পরিবেশ সম্মেলনে কলকাতা পুরসভার তরফে মেয়র পারিষদ ও বিধায়ক দেবাশিস কুমারকে প্রতিনিধি করে পাঠান মেয়র। দিল্লি আইআইটির ‘অরুণ দুগল সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ফর রিসার্চ ইন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এয়ার পলিউশন’-এর বিশেষজ্ঞরা রিপোর্টে কলকাতার বাতাসের দ্রুত দূষণমুক্তির নেপথ্যের পুরসভার একাধিক পদক্ষেপের জেরেই যে সাফল্য তা উল্লেখ করেছেন। শহর জুড়ে প্রচুর বড় বড় গাছ লাগানো ও গাছের চওড়া পাতায় জমা ধুলো ধূয়ে ফেলার পাশাপাশি নিয়মিত ৩০টি ‘ওয়াটার স্প্রিংলার’ দিয়ে জল ছড়িয়ে বাতাসে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুরসভা।
সাফল্যের নেপথ্যের কাহিনি বলতে গিয়ে এদিন মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার জানিয়েছেন, "শুধু গাছ লাগানো নয়, সেগুলিকে নজরদারি চালিয়ে যত্ন করে বড় করে তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুরসভা। সবুজায়নে জোর দেওয়ার পাশাপাশি পেট্রোল বা ডিজেলের পরিবর্তে অনেক ব্যাটারিচালিত গাড়ি শহরে বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরসভার উদ্যোগে ইলেকট্রিক ভেহিক্যালগুলির জন্য চার্জিং স্টেশন বসানো হয়েছে। বাতাসে ভাসমান গাড়ির ধোঁয়ার কার্বন কণা শুষে নেওয়ার জন্য ফোয়ারার সংখ্যাও অনেক বাড়ানো হচ্ছে।"