সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে কোনওক্রমে বেঁচে ফিরেছেন৷ ঘটনার আকস্মিকতা কাটালেও চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ৷ চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসছে মঙ্গলবার সেতু বিপর্যয়ের ভয়ংকর সেই ছবি৷ কপাল জোরে এ যাত্রায় বেঁচে ফিরে ইশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতেও ভোলেননি৷ ভয়ংকর দুর্ঘটনার হাত থেকে ফিরে আসার পর নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা সংবাদ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন সুবীর গুহ, হাসিবুল রহমান ও সুরেশ সিংরা৷
[রাতভর উদ্ধারকাজেও সরানো যায়নি কংক্রিটের স্তূপ, আশঙ্কা বাড়াচ্ছে আবহাওয়া]
এদিন সুবীর গুহ নিজের কলমে লেখেন, ‘বিকেল চারটে সতেরো। শিয়ালদহগামী ট্রেন ধরার জন্য মাঝেরহাট স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলাম। তখনই চোখের সামনে আস্ত একটি সেতু ভেঙে পড়ল! সঙ্গে বিকট শব্দ। প্রচুর ধোঁয়া। হুড়োহুড়ি, চিৎকার। যে যেদিকে পারছে দৌঁড়াচ্ছে। সঙ্গে চাপা আর্তনাদ। আতঙ্ক। হুগলি জেলার হুগলি শহরের চকবাজারে বাড়ি আমার। চাকরি করি সিইএসসিতে। রোজকার মতো মঙ্গলবারও কাজে আসি। কাজ শেষে ট্রেন ধরার জন্য মাঝেরহাট স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলম। তখনই ঘটে ওই দুর্ঘটনা। যেন একেবারে সিনেমার পর্দায় যেমন দেখা যায়। কিন্তু এরপর যা দেখলাম, ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়ার মতো। আমার হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। কয়েকজন বলতে শুরু করলেন, মনে হচ্ছে প্রচুর মানুষ মারা গিয়েছেন। মাঝেরহাট স্টেশন চত্বর ছেড়ে ভেঙেপড়া সেতুর খানিক কাছাকাছি গিয়ে দেখি, সেতুটির মাঝের অংশটি পুরোপুরি বসে গিয়েছে। সেতুর উপরে কতগুলি ক্যাব, একটি মিনিবাস, পাঁচটি মোটরবাইক, ট্যাক্সি রয়েছে। মাঝেরহাট সেতুটির পাশে থাকা একটি খালের মধ্যেও দেখলাম সেতুর ভাঙা একাংশ পড়েছে! কিন্তু সেতুর নিচের অংশে কতগুলো গাড়ি চাপা পড়ে রয়েছে বা কতজন চাপা পড়েছেন তা বুঝতে পারছিলাম না। সেতুর উপরে থাকা বাস, মিনিবাসের যাত্রীরা তখন এক প্রচণ্ড ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। সেতু ভেঙে পড়ার মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই তার নিচ দিয়ে দত্তপুকুরগামী একটি ট্রেন চলে যায়। পাঁচ মিনিট আগে এই দুর্ঘটনা ঘটলে হয়ত প্রচুর মানুষের প্রাণহানি ঘটত।’
[মাঝেরহাটে বিপর্যয়ের জের, যাতায়াতের বিকল্প ট্রাফিক রুট চালু পুলিশের]
সুরেশ সিং লেখেন, ‘আমার বাড়ি বজবজে। হেস্টিংসে গার্ডের কাজ করি। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ শিফট শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। সারাদিন কাজের মধ্যে ছিলাম। খাওয়া-দাওয়া হয়নি। খুব ক্লান্ত ছিলাম। তার উপর বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। হেঁটেই ব্রিজের উপর দিয়ে ফেরার চেষ্টা করছিলাম। এভাবেই প্রতিদিন ফিরি। কিন্তু এত বড় বিপর্যয় যে অপেক্ষা করছে বুঝতে পারিনি। ব্রিজের নিচে পড়ে যাওয়ার পর ফের পৃথিবীর আলো দেখতে পাব এটাও ভাবিনি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। হাফ হাতা ছাই রংয়ের শার্ট এবং খয়েরি রংয়ের প্যান্ট। এটাই আমার ইউনিফর্ম। সবে তখন ব্রিজে উঠেছি। গরমে নাভিশ্বাস উঠছিল। তার মধ্যেও কষ্ট করে পায়ে হেঁটে ব্রিজে উঠলাম। কিন্তু পেরতে পারলাম না। মাঝ বরাবর যেতেই ব্রিজটা ভেঙে পড়ল। ব্যস ওইটুকুই মনে আছে। চোখের সামনে হঠাৎ গাঢ় অন্ধকার নেমে এল। কানে লাগল বিকট শব্দ। কে আমার মুখে জল দিলেন, কে আমায় হাসপাতালে নিয়ে এলেন কিছুই মনে নেই। এমার্জেন্সিতে জ্ঞান ফেরার পর নজরে পড়ল হাত-পা দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে। জামা-কাপড় ছিঁড়ে শরীর কাদা মাখামাখি। একজন ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন, অন্যজন প্রেশার মাপছেন। কেউ আবার স্যালাইনের নল হাতে লাগিয়ে দিচ্ছেন। পা ওঠাতে পারছি না। অসহ্য যন্ত্রণা। স্ট্রেচারের সঙ্গে পা-টা বাঁধা আছে। মনে হয় ভেঙেছে। জানি না কবে সুস্থ হয়ে কাজে ফিরব। কাজে তো যেতেই হবে। কিন্তু মাঝেরহাট ব্রিজটা আর কোনওদিন টপকাব না।’
[ছেলেকে এভাবে শনাক্ত করতে হবে স্বপ্নেও ভাবেননি, কান্নায় ভেঙে পড়লেন মৃতের বাবা]
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন হাসিবুল রহমান৷ লেখেন, ‘চোখ বন্ধ করলেই ছবিটা ভেসে উঠছে। শ্বশুরমশাই নজরুল মোল্লাকে স্কুটিতে চাপিয়ে সন্তোষপুরের হাজিপাড়ার বাড়ি থেকে এসএসকেএম (পিজি) যাচ্ছিলাম। শ্বশুরমশাইয়ের দাদা পিজিতে ভর্তি। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার আশঙ্কায় একটু গতি বাড়িয়েই স্কুটি চালাচ্ছিলাম। মাঝেরহাট ব্রিজের উপরে উঠতেই প্রবল শব্দ কানে এল। আমাদের স্কুটি তখন ব্রিজের ভেঙে পড়া অংশের ঠিক মাঝখানে। বুঝলাম, বাস-মিনিবাস-মোটরবাইক-স্কুটি নিয়ে ভেঙে পড়েছে ব্রিজ। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন পিজির এমার্জেন্সির বেডে শুয়ে। শুনলাম, আমার স্কুটি নাকি ব্রিজের তলায় চ্যাপ্টা হয়ে পঞ্চত্ব পেয়েছে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। দু’জনেরই আঘাত লেগেছে। তবে, শ্বশুরমশাইয়ের আঘাত বেশি। বুকে-হাতে-পায়ে একাধিক জায়গায় চোট লেগেছে। ৬৫ বছরের শরীর এই আঘাত কতটা সইতে পারবে কে জানে। আমার পা ভেঙেছে। ফেটে গিয়েছে মুখের কয়েকটি অংশ। মাঝেমধ্যেই ‘ব্ল্যাক আউট’ হচ্ছে। চোখের সামনে নেমে আসছে অন্ধকার। জানি না কে বা কারা আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ। পোস্তার ঘটনা আমি শুনেছিলাম। সেদিন ঘটনার ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছিলাম। কিন্তু এমন ব্রিজ বিপর্যয়ের মধ্যে যে আমাকেও পড়তে হবে ভাবিনি। ঘটনাচক্রে শ্বশুরমশাইয়ের পাশের বেডেই জায়গা হয়েছে আমার। আমরা দু’জনেই পেশায় দর্জি। এখন পুজোর সময়। কাজের প্রবল চাপ। জানি না কবে সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিতে পারব। আত্মীয়-পরিজনরা হাসপাতালে এসেছেন। প্রার্থনা করি বাকি আহতরাও যেন প্রাণে বেঁচে যান। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।’
The post ‘এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বেঁচে আছি’ appeared first on Sangbad Pratidin.