বিশ্বদীপ দে: দুঃস্মৃতির পাষাণভার সহ্য করাই সময়ের সবচেয়ে কঠিন কাজ। মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু সময় নিরবধি বেয়ে চলে স্মৃতির পানসি। সমসময়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে হলে একটি ইশারাই হয়তো যথেষ্ট। ২০২৫ সালের দোলপূর্ণিমা যেমন মনে করাচ্ছে ১৯৮৪ সালকে। সম্প্রতি একটি ওয়েব সিরিজের ট্রেলার ফিরিয়ে দিয়েছে আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা পুলিশের ডিসি (বন্দর) বিনোদকুমার মেহতার ভয়ংকর হত্যার স্মৃতিকে। বাকি পৃথিবীর মতো কলকাতা শহরটাও এই চল্লিশ বছরে আমূল বদলেছে। কিন্তু বদলানো শহরে কোথাও রয়ে গিয়েছে এক সৎ পুলিশ অফিসারের মর্মান্তিক, করুণ পরিণতির জলছাপ। তিনি একাই নন, তাঁর গাড়ির চালক মোক্তার আলিকেও হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। সেই জোড়া হত্যার ভয়াবহতা আজও ফিরে ফিরে আসে এভাবেই।
১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ। দিনটা ছিল দোলপূর্ণিমার ঠিক পরের দিন। সেদিনই হত্যা করা হয় ৩৫ বছরের বিনোদকে। খুন করা হল মোক্তার আলিকেও। দুজনের মৃতদেহ দেখে শিউরে উঠল জনতা। দিনে দুপুরে এমন হত্যাকাণ্ড কলকাতার মেরুদণ্ডে হিম শিরশিরানি বইয়ে দিল। পাশাপাশি এই ঘটনায় মিশে গেল মহাভারতও। চক্রব্যুহে প্রবেশ করার মতো দুষ্কৃতীদের পিছু নিয়ে গার্ডেনরিচের দুর্ভেদ্য গলিতে ঢুকে পড়াই কাল হয়েছিল বিনোদের। আর বেরতে পারেননি। এও জানা যায়, এই 'ট্র্যাপ' তৈরি করা হয়েছিল সুচিন্তিত ভাবেই!
অপরাধ জগৎ ও তাদের মদত দেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের আঁতাঁত বিনোদকে বাঁচতে দেয়নি। কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল? কেন বিনোদকে এভাবে খুন করা হয়েছিল? আসলে সৎ পুলিশ আধিকারিক বিনোদ বন্দর এলাকার অপরাধীদের 'যম' হয়ে উঠেছিলেন। কোটি কোটি টাকার চোরাচালান রুখে বহু মাল বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করেছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ওই এলাকাতেই একটি দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে বিনোদ গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। গুলিতে নিহত এক যুবকের বাবা নাকি খোলাখুলি বলেছিলেন, ''আমি অবশ্যই আমার ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব। এবং এও দেখব যেন মেহতা বেশিদিন না বাঁচে।'' প্রভাবশালী ওই ব্যক্তির সঙ্গে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের শাসক বাম জোটের মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রীর 'সদ্ভাবে'ই নাকি প্রকাশ্যে এমন কথা বলতে পেরেছিলেন তিনি। কেবল গার্ডেনরিচ নয়, পার্শ্ববর্তী ওয়াটগঞ্জ ও মেটিবুরুজে দেখা গিয়েছিল পোস্টার। সেখানে বিনোদ মেহতাকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল একেবারে নাম করে। অকুতোভয় বিনোদকে টলানো যায়নি তবুও।
এর মধ্যেই এসে পড়ে ১৯৮৪ সালের দোল। সেই সময় ডাব পাড়াকে কেন্দ্র করে গার্ডেনরিচের ফতেপুর ভিলেজ রোডে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা গোলমালের সৃষ্টি হয়। পরদিন সকালে সেই গোলমাল নতুন মাত্রা নিচ্ছিল। বড়সড় গণ্ডগোলের আঁচ ছড়াতেই খবর পান বিনোদ। ঘটনাস্থলে পৌঁছেও যান। সঙ্গে গাড়ির চালক বঙ্গতনয় মোক্তার আলি। আর জনাকয়েক পুলিশ কর্মী। তারপর আরও বাহিনী এসে পৌঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ঢুকে পড়েন হিংসা ছড়িয়ে পড়া এলাকাতেই। ক্রমেই যেন এক চক্রব্যূহের মতো হয়ে উঠল পুরো এলাকাটা। অবাঙালি বিনোদ তো বটেই, মোক্তার আলিও বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সেই অন্ধগলিতে ঘুরপাক খেতে খেতে শেষপর্যন্ত সকলে আশ্রয় নেন স্থানীয় মসজিদে। শেষপর্যন্ত কনস্টেবলরা পালিয়ে যেতে পারলেও বিনোদ-মোক্তার পারেননি। তাঁরা ছুটতে লাগলেন এলোমেলো। একটা সময় পর হিংস্র ও সশস্ত্র বাহিনীর থেকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় তাঁরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন! শেষপর্যন্ত পুলিশ কনস্টেবল আবদুল লতিফ খানের বাড়িতে আশ্রয় চাইলেন তিনি। পেলেনও। বাড়ির স্নানাগারে লুকিয়ে পড়লেন। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছে যায় দুষ্কৃতীরা। এক-দুজন নয়, প্রায় জনা কুড়ির বাহিনীর নৃশংসতায় প্রাণ হারান বিনোদ। তাঁর মাথা থেকে বুক পর্যন্ত ২৭টি কোপের চিহ্ন ছিল। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রথম কোপেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। এরপরও মৃত মানুষটিকে ছিন্নভিন্ন করতে থাকে অসংখ্য চপার! তারপর সেই দেহটি উলঙ্গ করে ছুড়ে দেওয়া হয় নর্দমায়। অন্যদিকে মোক্তারও নিজেকে বাঁচাকে পারেননি। তাঁকে তলোয়ার-চপার দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়। উপড়ে নেওয়া হয় চোখ।
ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে এই জোড়া খুনের খবর। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান শহরের মানুষ। বলা যায়, গোটা বাংলাই সেদিন শিউরে উঠেছিল। শুধু রাজ্য নয়, গোটা দেশেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। এমনভাবে এক পুলিশ অফিসারের ভয়ংকর মৃত্যু সকলকেই স্তব্ধবাক করে দিয়েছিল। এও জানা যায়, বিরাট পুলিশবাহিনী এসেও তারা পাহাড়পুর রোডে এসে আর এগোতে পারেনি। ততক্ষণে কোন চোরাগলির ভিতরে অসহায়, নিরস্ত্র বিনোদ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন!
পুলিশ পদক্ষেপ করেছিল দ্রুতই। ৪৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১৪ জনই নাবালক। যদিও বেশ কয়েকজন মুক্তিও পেয়ে যায়। শেষপর্যন্ত শাস্তি হয় আটজনের। যদিও মূল অভিযুক্ত ইদ্রিশ আলির মৃত্যু হয় পুলিশ হেফাজতে। যে মন্ত্রীর নাম জড়িয়েছিল, তাঁর দিকে কিন্তু অভিযোগের তির ছুটে আসেনি। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীই ছিলেন। এদিকে বহু নথি অমিল থাকায় মামলাটির সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি হয়নি বলেই শোনা যায়।
সময় যায়। পুলিশের বন্দর বিভাগের উপ কমিশনারের কার্যালয়ে বিনোদ কুমার মেহতা ও মোক্তার আলীর মূর্তি আজ শোভা পায়। মৃত্যুদিনে স্মরণ করা হয় তাঁদের। কিন্তু তবু সেই করুণ মৃত্যুর ছায়া শহরে আজও রয়েছে। বিনোদ মেহতার বিধবা স্ত্রী বীনা মেহতা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় জানান, ''এই দগদগে ক্ষতিকে কি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি? এ এমন এক ক্ষত যা অসাড় করে দেয় চিরকালের মতো।আসলে আমি কেবল আমার প্রিয় মানুষটিকেই তো হারাইনি। বলতে গেলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।আমার জীবনটা যে ওকে ঘিরেই ছিল। তাই সেই দিনই আমার একটা অংশ বরাবরের মতো মারা গিয়েছিল।''
এই শোকের সামনে কোনও সান্ত্বনা চলে না। এক সৎ পুলিশ আধিকারিক চেয়েছিলেন তাঁর এলাকার 'কাদা' পরিষ্কার করতে। তারই 'পুরস্কার' দিতে এভাবে চলে যেতে হয়েছিল মানুষটিকে। তবে সততার জোর এখানেই, যে তাকে মুছে ফেলা যায় না। মৃত্যুর এতবছর পরও তাই তাঁর অসমসাহসী, নির্লোভ, দায়িত্বপরায়ণ মনোভঙ্গি মিথ হয়ে রয়ে গিয়েছে। বিনোদ আজ আছেন। অপরাধ দমনের স্বপ্ন দুচোখে, নির্ভীক এক মানুষের অপরাজেয় ছবি হয়ে।