কৃষ্ণকুমার দাস: কলম্বোয় ৬২ তলার দুই যমজ সহোদরের 'ক্ষতি' সামাল দিতে গিয়ে রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শপিং মল সাউথ সিটি। বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থা ব্ল্যাকস্টোনের সঙ্গে বিক্রির সর্বোচ্চ দর ও নানা শর্ত নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে দফায় দফায় আলোচনা করছেন সাউথ সিটির ছয় মালিকের কনসর্টিয়াম। সূত্রের খবর, ব্ল্যাকস্টোন ৩, ৫০০ কোটির কিছু বেশি টাকা দর দিয়েছে। শপিং মল ছাড়াও এই লেনদেনের তালিকায় রয়েছে পিছনের সাউথ সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কলম্বোর সর্বোচ্চ যমজ ৬২ তলা টাওয়ারও। মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থার মূল টার্গেট, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাড়ে বারো লক্ষ বর্গ ফুট আয়তনের এই জনপ্রিয় ও লাভজনক শপিং মলটি। তবে চেষ্টা হচ্ছে স্কুলটি বাঁচিয়ে রাখার।

সাউথ সিটির এক শীর্ষ আধিকারিক রবিবার সন্ধ্যায় জানান, "দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চূড়ান্ত স্তরে রয়েছে। মার্কিন সংস্থার শীর্ষ কর্তারাও সরেজমিনে এসে কলম্বোর প্রায়চিত্ত করতে বাধ্য হচ্ছে কলকাতা! শপিং মল ও কলম্বোর দুই টাওয়ার দেখেছেন। এখন সম্পত্তিগুলির নথি পরীক্ষার পাশাপাশি আইনি দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বড়মাপের অঘটন না ঘটলে পরবর্তী ২/৩ সপ্তাহের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। নতুন আর্থিক বছরের শুরুতে ১ এপ্রিল থেকেই দায়িত্ব নিতে পারে ব্ল্যাকস্টোন।" উল্লেখ্য, সাউথ সিটি মল তৈরি হয় প্রখ্যাত ইমামি গ্রুপ, মার্লিন গ্রুপ, প্রদীপ সুরেখা গ্রুপ, শ্রাচি গ্রুপ, যুগলকিশোর খেতাওয়াদ ও রাজেন্দ্র কুমার বাচাওয়াতের মতো কলকাতার প্রথম সারির ছয়টি রিয়েল এস্টেট সংস্থার কনসর্টিয়ামের মাধ্যমে। ছয় ডিরেক্টরের তরফে যুগল খেতাওয়াদ শপিং মলটি দেখাশোনা করেন।
কিন্তু দেশের অন্যতম এই লাভজনক শপিং মল কেন বিক্রি করে দিচ্ছে? সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে উষা কোম্পানির জমিতে কলকাতায় শপিং মল চালুর পরে কলম্বোতে সমুদ্রতীরে দুটি ৬২ তলা টাওয়ার তৈরিতে হাত দেয় সাউথ সিটির কনসর্টিয়াম। শ্রীলঙ্কার অংশে অংশীদার ছিলেন ওই দেশের এক শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, বর্তমানে তিনি দেশছাড়া। দ্বীপরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুই বহুতলের সমস্ত ফ্ল্যাটই ছিল আধুনিক জীবনের বিলাসিতায় মোড়া স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু কোভিডের সময় টানা দু'বছর বন্ধ থাকা ও সমুদ্রের লবণাক্ত জলের হাওয়ায় প্রতিটি ফ্ল্যাটের আসবাব ও পরিকাঠামো নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কান অংশীদার রাষ্ট্রে অভ্যুত্থানের কারণে দেশছাড়া হওয়ায় প্রায় ৮০০ কোটির প্রকল্পে ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হয় কনসর্টিয়াম। বস্তুত সেই ভয়ানক ক্ষতি সামাল দিতেই মার্কিন সংস্থাকে 'সোনার রাজহাঁস' মল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। প্রশ্ন উঠেছে, মার্কিন সংস্থার হাতে গেলে বর্তমানে মলের বিভিন্ন শোরুম ও সংস্থায় কর্মরত প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মীর উপর কোনও প্রভাব পড়বে না তো? দৈনন্দিন কেনাকাটা করতে আসা সাধারণ ক্রেতারা কি আদৌ উপকৃত হবেন?
মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থা ব্ল্যাকস্টোন গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে ২৯ টি নামী শপিং মল কিনেছে। কিছুদিন আগেই ভুবনেশ্বরের ফোরাম কিনেছে এই বহুজাতিক সংস্থা। ভারতে অফিস স্পেস-মল ও হোটেল শিল্পে ব্ল্যাকস্টোন ইতিমধ্যেই ১.৭ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে বাণিজিক দিক থেকে সাউথ সিটি দেশের অন্যতম লাভজনক শপিং মলগুলির মধ্যে অন্যতম। বার্ষিক ১৮০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয় প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের এই মলে। এখানে নয়টি দেশবিখ্যাত নামী রেস্তোরা যেমন রয়েছে, তেমনই ১৪০০ আসনের পূর্ব ভারতের বৃহৎ ফুডকোর্টেও প্রতিদিন খাদ্যরসিকদের ভিড় উপচে পড়ে। পার্কিং স্পেসে একসঙ্গে প্রায় ১২৫টি গাড়ি থাকে। ১২.৫ লক্ষ বর্গফুটের শপিং মলে ব্যবসার জন্য প্রায় ৬.৫ লাখ বর্গফুট জায়গা রয়েছে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন প্রায় ৩০,০০০-৪০,০০০ মানুষ এবং শনি ও রবিবার এই মলে আসেন ৭৫,০০০ থেকে ১.৫ লাখ মানুষ। মাসে অন্তত ১৬ লাখ মানুষ আসেন এই শপিং মলে। দেশের সেই জনপ্রিয়তম শপিং মলই অধিগ্রহণ করতে চলেছে ব্ল্যাকস্টোন। এখন দেখার, বিশ্বখ্যাত ওই সংস্থা দায়িত্বে আসার পর ক্রেতা ও বিক্রেতাদের পাশাপাশি কর্মীদের জন্য কী পরিবর্তন করে।