ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: মডার্ন মেডিসিনের চিকিৎসকদের ‘ক্রেডিট আওয়ার পয়েন্ট’ পাওয়ার একমাত্র পথ হাতেগোনা কিছু সিএমই, সেমিনার, সিম্পোজি়য়াম, ওয়ার্কশপ। চিকিৎসকদের কাছে এই 'ক্রেডিট পয়েন্ট' রীতিমত মহার্ঘ। কারণ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি) গাইডলাইন অনুযায়ী, গবেষণা ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ডাক্তারদের বরাবর কাজেও লাগে এই ক্রেডিট পয়েন্ট। কিন্তু সেই ক্রেডিট পয়েন্টই রেজিস্ট্রেশন নবীকরণের বাধ্যতামূলক মাপকাঠি হিসেবে ঠিক করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তুমুল বিরোধিতার মুখে পড়েছে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল। তাদের নতুন শর্ত, ৩০ ঘণ্টার ক্রেডিট আওয়ার বাধ্যতামূলক।
এতেই ক্ষোভ দানা বেঁধেছে ডাক্তার মহলের একটা বড় অংশে। চিকিৎসক সংগঠনগুলির বক্তব্য, ডাক্তারি শাস্ত্রের অগ্রগতি বহমান প্রক্রিয়া। রোজ গবেষণা হচ্ছে। প্রায়শই নতুন ওষুধের গুণ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানা যাচ্ছে। কন্টিনিউয়িং মেডিক্যাল এডুকেশন বা সিএমই–তে অংশ নেওয়ার বিষয়টিকে তাঁরাও সমর্থন করেন। কিন্তু ন্যূনতম ৩০ ঘণ্টার 'ক্রেডিট পয়েন্ট' এই নয়া নিয়ম বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি নিয়ে তাঁদের আপত্তি আছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষকে পরিষেবা দেওয়া সরকারি ও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা চিকিৎসকরা। কারণ, তাঁদের পক্ষে সিএমই–সিম্পোজ়িয়ামের মতো শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে লাগাতার অংশ নিতে হরদম কলকাতায় আসা সম্ভব নয়। রোগীরা যেমন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আবার সমস্যায় পড়বেন জেলা ও ব্লক হাসপতালের ডাক্তারবাবুরা। চিকিৎসকদের একাংশ আবার এ প্রশ্নও তুলছেন— যেনতেন প্রকারে আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই মেডিক্যাল কাউন্সিল এই পদক্ষেপ করল না তো?
কেননা, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করলে উদ্যোক্তাদের প্রতি অংশগ্রহণকারী পিছু ১০০ টাকা করে জমা দিতে হয় কাউন্সিলে। চিকিৎসক সংগঠনগুলির তরফে দাবি করা হচ্ছে, পাঁচবছর অন্তর যেহেতু রেজিস্ট্রেশন আপডেট করতে হয় কাউন্সিলে, তাই একজন চিকিৎসককে পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৩০ ঘণ্টার ‘ক্রেডিট পয়েন্ট’ আয় করতে হবে। অর্থাৎ বছরে অন্তত ৬ ঘণ্টার ক্রেডিট তুলতে হবে তাঁকে। তার জন্য গড়ে মোটামুটি প্রতি বছরে দু’টি সিএমই–সিম্পোজ়িয়াম–সেমিনার–ওয়ার্কশপে তাঁকে অংশগ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ উদ্যোক্তা মারফত একজন চিকিৎসককে কাউন্সিলের কাছে ২০০ টাকা জমা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু প্রায় ৬০ হাজার চিকিৎসক রয়েছেন, তাই প্রতি বছরে এই বাবদ কাউন্সিলের অন্তত ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা আয় হবেই।
দক্ষিণবঙ্গের একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কথায়, "নিয়ম দেখে বিস্মিত হয়েছি! অন্য কেউ সিএমই আয়োজন করবে, সার্টিফিকেট ছাপিয়ে দেবে। মেডিক্যাল কাউন্সিলের কোনও দায়িত্ব নেই। শুধু শিক্ষামূলক ওই অনুষ্ঠানের অনুমতিটুকু দিয়ে প্রতি বছরে কোটি টাকার বেশি আয় করবে তারা!" তাঁর আরও প্রশ্ন, এই যদি নতুন নিয়ম হয়, তা হলে সিএমই–তে যাঁরা ফ্যাকাল্টি হিসেবে শিক্ষাদান করেন, তাঁদের কেন ক্রেডিট আওয়ার দেয় না কাউন্সিল? তাঁর সঙ্গে একমত সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স। সংগঠনের তরফে উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "নিজেকে পেশাদার হিসেবে তুলে ধরতে সিএমই–সিম্পোজ়িয়ামে অংশ নেওয়া প্রতিটি চিকিৎসকেরই দরকার। কিন্তু যেভাবে একটা মাপকাঠি বেঁধে দিয়ে বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে তুলে ধরা হল, আমরা তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"
চিকিৎসকদের সাফ বক্তব্য, কলকাতা থেকে দূরবর্তী এলাকায় ডাক্তারি করেন যাঁরা নতুন নিয়মে তাঁরা সমস্যায় পড়বেন। সরকারি চিকিৎসকদের আর এক সংগঠন সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম ও নয়া গাইডলাইনের বিরোধিতা করেছে। প্রত্যেক চিকিৎসক যাতে নিয়মিত সিএমই–সিম্পোজ়িয়াম–সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে পারে, মেডিক্যাল কাউন্সিল সেই দায়িত্বও নিক। যোগাযোগ করা হলেও মেডিক্যাল কাউন্সিলের তরফে যদিও কোনও অভিমত পাওয়া যায়নি।