তিনি ধারাবাহিক নির্মাতা। তাঁর অন্য পরিচয় রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন। বিনোদন জগৎ এবং নারী সুরক্ষা নিয়ে কথোপকথনে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। শুনলেন শম্পালী মৌলিক
আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ দেখা গিয়েছে। ছোটপর্দার কিছু ধারাবাহিকে এই ঘটনা ছাপ ফেলেছে। কাহিনিতে নারী নির্যাতন ও প্রতিবাদের প্রতিফলন। একজন ধারাবাহিক নির্মাতা, চিত্রপরিচালক ও রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন হিসেবে কী বলবেন?
- হ্যাঁ, জনজাগরণ দেখা গিয়েছে। সিরিয়ালেও যদি এমন হয়, তাহলে বলব সমসময়ের ছাপ তো লেখায় পড়েই। সেরকম ভাবেই যাঁরা এনেছেন, সেই ভাবনা থেকেই হয়তো। এর মধ্যে টেলিভিশন দেখা হয়নি।
শহরজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল, সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিচ্ছেন, ছোটপর্দার শিল্পীরাও ন্যায়বিচারের দাবিতে সরব হয়েছেন, আপনার ব্যক্তিগত স্তরে বা মহিলা কমিশনের তরফে কোনও পদক্ষেপের ভাবনা?
- প্রথম দিনই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেদিন খবর পেয়েছি সেদিনই গিয়েছি। বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে ফলো আপ করে রিপোর্ট এবং রেকমেন্ডেশন পাঠানো হয়েছে সোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টকে। পরে মেয়েটির বাড়িতে যাওয়া হয়। মৃতার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়, ফলো আপ করা হয়েছে।
প্রতিবাদ মিছিলের প্রসঙ্গে বলছি।
- হ্যাঁ, বলছি। যাঁরা এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা নির্যাতিতার উপরে যে অন্যায় হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আর না হয়, সেই জায়গা থেকেই করছেন। এই ঘটনাটা অসম্ভব ন্যক্কারজনক। এবং সারা দেশ জুড়ে কখনও না কখনও এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। কমিশন প্রায় প্রতিটি ঘটনা অ্যাড্রেস করে, তার পদ্ধতি অনুযায়ী। প্রতিবাদ মিছিলে কেউ যেতেও পারেন, নাও যেতে পারেন, তার মানে এই নয় তাঁর প্রতিবাদটা নেই।
২০১৮ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘# মিটু’ মুভমেন্ট দেখেছি আমরা। কিছুদিন আগে টলিউের এক পরিচালকের বিরুদ্ধে অশালীন আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া রয়েছে একাধিক হেনস্তার খবর। যাঁদের দিকে অভিযোগের তির, তাঁরা বহাল তবিয়তে কাজ করছেন। এমন অবস্থায় ভিক্টিমের মনোবল কমে যেতে পারে। কী বলবেন?
- একটা কথা পরিষ্কার বলব, সোশাল মিডিয়ায় অভিযোগ জানালে, কতটা কাজ হয় আমার জানা নেই। নির্দিষ্ট ফোরামে যদি জানানো হয়, তার জন্য নির্দিষ্ট উইং আছে। এবং এরকম একটি ঘটনা আমাদের কাছেও এসেছে। সে বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ করেছি। অনেক ক্ষেত্রেই হয় মেয়েরা পরবর্তীকালে এটা নিয়ে এগোতে চান না। সেখানে কমিশন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যাঁরা মুভ করতে চান, সেরকম প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে কমিশন পদক্ষেপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি ঘটনা এসেছে, আমরা কেসটা নিয়েছি, যেটা আগেই বললাম। কেসটা এখনও চলছে।
অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা মুখ খুলতে ভয় পান, পুরুষটি যদি পাওয়ার পজিশনে ওপরে থাকেন, কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে, অথবা ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের প্রভাবশালীদের চাপে ভয় পান মেয়েরা। এ বিষয়ে আপনার কী মতামত?
- যখন আমরা প্রথম কাজ করতে এসেছিলাম, আমরাও শুনতাম, যে ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক কিছু হয়, এই অনেক কিছু ছাড়া কাজ পাওয়া যায় না, খুব অসাধুভাবেই বলা হত কথাগুলো। মহিলা কমিশনের পদ বাদ দিয়ে বলছি, ইন্ডাস্ট্রিতেই কিন্তু কুড়ি বছর কাজ করছি, খুব বেশি এমন ঘটনা যে শুনেছি তা কিন্তু নয়। যদিও বলব, একটা ঘটনাও শোনার কথা নয়। অনেক সময় দেখা গেছে, মেয়েটি বলতে চাইছেন না, বা বলে উঠতে পারছেন না। এক্ষেত্রে শুধু প্রভাবশালী ফ্যাক্টর নয়, আরও দুটো ফ্যাক্টর কাজ করে এখনও। সোশাল ট্যাবু, যে লোকে আমাকে কীভাবে নেবে। আমাদের সমাজে তো মেয়েটিকেই আগে চিহ্নিত করা হয়, তার পোশাক-আশাক, তার ভাবভঙ্গি, এসব দিয়ে জাজ করা হয়। সেই কারণেও একটা ট্যাবু কাজ করে যে, আমি বললে, লোকে তো আমার দিকেই আঙুল তুলবে। আরেকটা পয়েন্ট হচ্ছে, অভিযোগ করে তারপরে উইথড্র করে নিয়েছে, পরিবারে জানাজানি হবে ভেবে। আর ওয়ার্ক প্লেসে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে, যে যখন পাওয়ারে থাকে, তার দিক থেকে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় ওয়ার্ক প্লেস হ্যারাসমেন্টে নারীরাও থাকেন। যঁারা বস, তঁারাও কি জুনিয়রদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করেন সবসময়? তেমনই অনেক পুরুষও পাওয়ার পজিশনে থাকলে এটাই করেন। যিনি যখন পাওয়ার পজিশনে থাকেন তিনি মনে করেন, তিনি কোথাও আনসারেবল নন। এক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা বেশি।
সম্প্রতি ঋতাভরী চক্রবর্তী ‘হেমা কমিটি’-র রিপোর্টে মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রির যৌন নিগ্রহের ঘটনা সামনে আসা এবং পদক্ষেপ নেওয়া প্রসঙ্গে টলিউড ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের অভব্যতার কথা তুলেছেন। এর বিহিত চান তিনি, মহিলা সহকর্মীদের সরব হওয়ার ডাক দিয়েছেন। অর্থাৎ অশালীন আচরণের পরম্পরা রয়েছে। শ্রীলেখা মিত্রও সোচ্চার হয়েছেন। ইতিমধ্যে টলিউডে কাজের পরিবেশ ঠিক রাখার দাবিতে “উইমেন’স ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স” সরব হয়েছে।
- আমার মনে হয়, মেয়েরা আগে এতটা ভোকাল ছিলেন না। এখন বেশি ভোকাল। পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সবার আগে মেয়েদের মুখ খুলতে হবে। অপরাধীকে চিহ্নিত করতে হবে।
ইন্ডাস্ট্রি থেকে কেমন অভিযোগ পান?
- আমি এতদিন রয়েছি কমিশনে, তিন-চারটে অভিযোগ এসেছে। সবকটাই আমরা অ্যাড্রেস করেছি। তার মানে বলছি না কেস নেই। আসলে মেয়েদের এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট ফোরামে মুখ খোলা দরকার। কোনও ক্ষেত্রে দেখেছি তাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল, সম্পর্ক ছিল। পরে সম্পর্কে বিশ্বস্ততার অভাবে একজন কমপ্লেন করেছেন। আরেক পক্ষকে ডাকার পর বোঝা গিয়েছে। সবকটাই এরকম নয়। কোথাও কোথাও সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়েটেশন আছে। কেউ আবার অভিযোগ করার পরে বলেছেন, এখন এটা নিয়ে মুভ করতে চান না। যখন এগতে চাইবেন, তখন বলবেন। তখন সেটা কমপ্লেন হিসেবে রেজিস্টার করাও যায় না। সব সময়ই বলছি, এমন ঘটনা ঘটে থাকলে, সঙ্গে সঙ্গে জানাতে, প্রতিবাদটা করতে হবে। নয়তো অপরাধীকে চিহ্নিত করা যাবে না।
আর. জি. কর-এর ঘটনার পর ১৭ দফা পদক্ষেপের ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে একটি পয়েন্টে মহিলা চিকিৎসকদের রাতের ডিউটি যথাসম্ভব কমানোর পরামর্শ রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে যদি বিনোদন জগতের দিকে তাকাই রাতে শুটিং থাকেই, অনেক সময় সিনেমায় গভীর রাতেরও শুটিং থাকে। সিরিয়ালের কাজ শেষ হলে, তারপরে রাতেও অনেকে শোয়ে যোগ দেন। রোজগার জরুরি। এমনিতেই পে স্ট্রাকচারে মেয়েরা পিছিয়ে। তাহলে রাতের কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ কমবে কেন!
- ব্যক্তিগতভাবে এই বৈষম্য আমি পছন্দ করছি না। হয়তো এই রকম পরিস্থিতিতে ১৭ দফার মধ্যে এইরকম একটা বিষয়ের কথা ভাবা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এতে মেয়েদের পিছিয়ে পড়াই হয়, যে পৃথিবীতে মেয়েরা মহকাশে যাচ্ছে, এরোপ্লেন চালাচ্ছে, আরও অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ করছে, সেখানে দঁাড়িয়ে মেয়েরা নাইট শিফট করবে না, এমনটা কাম্য নয়। নাইট শিফট করবে এবং চ্যালেঞ্জিং কাজেও যাবে, কিন্তু তাদের সুরক্ষা প্রয়োজন। নিরাপত্তা যেন আরও জোরদার হয়। বিনোদন জগতের কথা যদি বলো, সাড়ে নটার মধ্যে টিভির শুটিং শেষ করতে হয়, সাড়ে নটা বেজে গেলে প্রোডাকশন হাউস থেকে তাকে গাড়ি দেওয়া হয়। আর নাইট শিফট-এর শুটিং থাকলে অনেক আগে থেকে গিল্ডকে জানাতে হয়। একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে সকলকে যেতে হয়। কখনও কি আমরা শুনেছি রাত জেগে শুটিং হচ্ছে বলে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে? এত বছর তো আমিও ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছি। কাজেই সেটা নয়। কিন্তু ঘটেনি বলে, কালকে ঘটবে না তাও নয়। সেই কারণেই সুরক্ষার দিক নিশ্চিত করা জরুরি। সে বিনোদন জগৎ, আইটি সেক্টর, চিকিৎসাক্ষেত্র বা যে কোনও কর্মক্ষেত্র হোক। আরও যোগ করব, নারী-পুরুষ সকলের জন্যই যেন নিরাপত্তা থাকে ওয়ার্ক প্লেসে।