একবার একমাসব্যাপী নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছিল সুব্রতরা। আমাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিল। খামের উপর লেখা ছিল: বিমান বসু, সাধারণ সম্পাদক, এসএফআই। অবাক হয়েছিলাম, ভালও লেগেছিল। স্মৃতিচারণায় বিমান বসু
অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষযাত্রায় সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের (Subrata Mukherjee) সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। একগাল হেসে চিরতরুণ সুব্রত জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বিমানদা, বয়স তো আপনার কম হল না। কিন্তু এখনও সমানভাবে ব্যাট করছেন। রহস্যটা কী? আমরা তো ভাঙছি, কিন্তু আপনার তো কোনও লক্ষণই দেখছি না!’
সুব্রত ছিল অন্য ধারার রাজনীতিবিদ। রাজনীতি থেকে একটি সম্পর্ককে কীভাবে আলাদা করতে হয়- এই কৌশল ও ছাত্রাবস্থা থেকেই রপ্ত করেছিল। রসবোধ ছিল অসীম। মাঝেমধ্যে আড্ডার তালে অনেক কথা হত। সেখানে রাজনীতি থাকত না। যেহেতু অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা ছিল, তাই আলোচনার বিষয়বস্তু থাকত ভিন্ন ভিন্ন।
[আরও পড়ুন: জ্বালানির দাম কমিয়েছে সরকার, এতদিন পর এই সামান্য তৎপরতা কি কাজে দেবে?]
সাতের দশকের প্রথম দিক। আমি তখন ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। আর, সুব্রত কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি। আমাদের বিচরণক্ষেত্র ছিল কলেজ স্ট্রিট। প্রেসিডেন্সি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু ও হেয়ার স্কুল, হিন্দু হস্টেল, মহাবোধি সোসাইটি-তে ছিল আমাদের দু’পক্ষেরই অবাধ যাতায়াত। সুব্রতর নেতা ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও আইন ছাড়াও অন্যান্য বিষয় নিয়েও পড়াশোনা করত। রাজনৈতিক মতাদর্শগভাবে আমরা প্রতিপক্ষ হলেও মাঝেমধ্যেই রাজ্য, দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হত। ওরা ছিল তিন ছাত্রনেতা। একসঙ্গে তিনজনের নাম উচ্চারণ হত। প্রিয়, সুব্রত, সোমেন। আমরা ছিলাম বিমান, শ্যামল, সুভাষ। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে কলেজ স্ট্রিট চত্বরে বহুবার মুখোমুখি সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হত। রক্তপাতও হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনও দিনও এর প্রভাব পড়তে দেয়নি সুব্রত।
ছাত্রাবস্থায় একবার একমাসব্যাপী নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছিল সুব্রতরা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও আমাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিল। আমন্ত্রণপত্রের খামের উপর লেখা ছিল: বিমান বসু, সাধারণ সম্পাদক, এসএফআই। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। সেই নাট্যোৎসবে আমার ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয়নি। কিন্তু একমাসব্যাপী অনুষ্ঠিত নাট্যোৎসবের প্রতিটি নাটকের টিকিট খামের ভিতর
পাঠিয়েছিল সুব্রত। ছাত্রাবস্থায় এমন সৌজন্যবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
ইদানীং এই সৌজন্যবোধের অভাব বোধ করছি। রাজনৈতিক সৌজন্যে ভোট কী হতে পারে বা রাজনীতির বাইরে কীভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট রাখা যায়, আগামী প্রজন্মের উচিত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো নেতৃত্বের পথ অনুসরণ করা। পরে ও কখনও কংগ্রেস আবার কখনও তৃণমূলে গিয়েছে। মেয়র হয়েছিল। মন্ত্রীও। কিন্তু সৌজন্যবোধ হারায়নি।
সুব্রতর রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ নিয়েই অনেক কিছুই বলা যায়। আজ, সেসব বলব না। আমার পক্ষে বলা মুশকিল। এটুকু বলতে পারি, ও বালিগঞ্জের সুরেন ঠাকুর রোডে থাকত। বালিগঞ্জ ছিল ওর বিধানসভা। আমারও বাড়ি ছিল বালিগঞ্জ। তাই বহুবার বহু জায়গায়, এমনকী, রাস্তাঘাটেও ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। বহু বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। অনেক কথাই আছে যা প্রকাশ্যে বলা যায় না। কিন্তু এটুকু বলা যায়, একজন রাজনীতিবিদ হয়ে আর-একজন রাজনৈতিক নেতাকে কীভাবে সম্মান জানাতে হয় ও তা জানত। তাই আজীবন বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সুমধুর।