সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রাজ্যে সেনার রুটিন মহড়া নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ রাজ্যে সেনা অভ্যুত্থানের অভিযোগে প্রায় ১৯ ঘন্টা নবান্নেই রইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনও নবান্নেই রয়েছেন তিনি৷ আজই সংসদে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে সরব হবে তৃণমূল, জানিয়েছেন ডেরেক ও’ব্রায়েন৷ অন্যদিকে, সেনাবাহিনীও পিছু না হঠে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় আজও অভিযান চলবে বলে জানিয়ে দিয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, টোল প্লাজায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে টাকা তুলছেন সেনাবাহিনীর জওয়ানরা৷ যার প্রতিবাদ করে বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ভারতীয় সেনা ঘুষখোর? গাড়ি দাঁড় করিয়ে টাকা তুলছে? ভারতীয় সেনাকে বিশ্বাস করেন না মুখ্যমন্ত্রী? এত বড় অপমান! বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে জঙ্গিরা এ রাজ্যে ঢুকলে কেন এরকম লাফালাফি করেন না মুখ্যমন্ত্রী? কেন সারারাত নবান্নে বসে থাকেন না? এত ভয় কেন?” বিজেপির জাতীয় সচিব সিদ্ধার্থনাথ সিংও মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে৷ শুক্রবার তিনি বলেন, “কালো টাকা হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ তাই রুটিন সেনা মহড়াকেও তিনি অভ্যুত্থান বলছেন৷”
রাজ্যকে না জানিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতু-সহ বিভিন্ন টোল প্লাজায় সেনা মোতায়েনে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে রাতভর নবান্নেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ টোল প্লাজায় সেনা জওয়ানরা দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ির নম্বর, চালকের নম্বর-সহ বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছিলেন৷ রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের পদস্থ আধিকারিকদের কাছে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নিয়েই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নবান্নে আচমকা সাংবাদিক সম্মেলন করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি মুখ্যসচিবকে দ্রুত কেন্দ্রের কাছে লিখিতভাবে বিষয়টি জানাতে নির্দেশ দেন৷ সব রাজ্যকেই সম্মিলিতভাবে এই বিষয়ে প্রতিবাদের রাস্তায় নামার আবেদন করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর কড়া মন্তব্য, “এতে মনে হয় দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি৷ জরুরি অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ৷ গণতন্ত্রের কালো দিন৷ এমন কী ঘটনা ঘটল যে, কেন্দ্র সরকার রাজ্যকে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না৷ নবান্নে নাকের ডগায় সেনা কেন? রাজ্যে কি জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সেনাকে কাজে লাগাচ্ছে কেন্দ্র৷” নবান্নে শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী রাত ১০টা নাগাদ ফের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়ে দেন, সচিবালয়ের বাইরে থেকে যতক্ষণ না সেনা প্রত্যাহার হবে, ততক্ষণ তিনি নিজে নবান্নে থাকবেন৷ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্রের সরকার অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক৷ রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে আমরা সেনার হাতে তুলে দিয়ে যাব না৷ কোনও রাজ্যে এই ঘটনা ঘটেনি৷ জনগণের জন্য আমি লড়াই চালিয়ে যাবই৷”
সংসদীয় দলের সদস্যরাও দিল্লিতে রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি জানান৷ মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে বলেন, “যতক্ষণ না সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে ততক্ষণ আমি নবান্নে থাকব৷ গণতন্ত্রকে পাহারা দেব৷” তিনি টুইট করে এটাও বলেন, “সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা থাকলেও ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে৷” রাত ১২টা নাগাদ দ্বিতীয় হুগলি সেতু তথা নবান্নের সামনে থেকে সেনা সরে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে বলেন, “জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, বারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে৷” রাত ১.৩০টা নাগাদ নিজে পরিস্থিতি দেখতে ঘর থেকে বেরিয়ে নবান্নের নিচে আসেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তখন তিনি বলেন, “আপাতত সেনা এখান থেকে সরে গেলেও ফের আসতে পারে৷ তাছাড়া রাজ্যের ৮০ শতাংশ এলাকায় এই মুহূর্তে সেনা তাণ্ডব চালাচ্ছে৷ রাজ্যের মানুষের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তা সুনিশ্চিত করতে চাই৷ তাই সারারাত নবান্নেই থাকব৷ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আমাকে হেনস্তা করার জন্য জঘন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ আমি অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে কথা বলেছি, কোথাও এ জিনিস হচ্ছে না৷” মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সন্ধ্যে থেকেই নবান্নে ছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস৷ রাতে একে একে আসেন কলকাতার মেয়র ও মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী জাভেদ খান, অরূপ রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ৷ নবান্নে ছিলেন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে, রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিত্ কর পুরকায়স্থ, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার প্রমুখ৷
রাত ১১টা নাগাদ সেনার তরফ থেকে জানানো হয়, আপৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বছরে একবার দেশজুড়েই পণ্যবাহী গাড়ি নিয়ে তথ্য নেওয়া হয়৷ পণ্য ধারণের ক্ষমতা-সহ কিছু মৌলিক তথ্য নেওয়া হয়ে থাকে৷ যানে কিছু চিহ্নও দেওয়া হয়ে থাকে যাতে পরবর্তী চেক পয়েন্টে কোনও চেকিং না হয়৷ সরকারি নির্দেশ মেনেই এটা হয়ে থাকে৷ কোনও উদ্বেগ বা সতর্কতার বিষয় নেই৷ ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে টুইট করে বলা হয়, “পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করেই রুটিন অভিযান হচ্ছে৷ সেনার টোল প্লাজা দখল নিয়ে জল্পনা সম্পূর্ণ ভুল৷” সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে এটাও টুইট করে জানানো হয়, “উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন্ রাজ্যে রুটিন অভিযান চলছে৷ অসমের ১৮টি জায়গায়, অরুণাচলের ১৩টি জায়গায়, পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জায়গায়, মণিপুরের ছটি জায়গায়, নাগাল্যান্ডের ৫টি জায়গায়, মেঘালয়ের ৫টি জায়গায়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের একটি করে জায়গায় অভিযান হচ্ছে৷”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই নবান্নের সামনে টোল প্লাজার কাছে সার দিয়ে প্রচুর সেনা গাড়ি রাখা ছিল৷ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ল্যন্সনায়েক বলেন, “এটা সিক্রেট৷” প্রতিটি গাড়িতে ইসি-১ স্টিকার সেঁটে দিচ্ছিলেন জওয়ানরা৷ সন্ধ্যাতেই পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে এবং মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও ডিজির সঙ্গে বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জাতীয় সড়কের অধীন টোল প্লাজাগুলিতে সেনা নামিয়েছে৷ রাজ্যকে ঘুণাক্ষরেও জানানো হয়নি৷ আমরা জানি না৷ জরুরি অবস্হায় এমন পরিস্থিতি হয়৷ রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করা যায়৷ সেনাবাহিনী দেশের সম্পদ৷ তাঁরা দেশকে রক্ষা করেন৷ বড় বিপর্যয় বা দাঙ্গা বড় আকারে হলে রাজ্যও সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়৷ কিন্তু রাজ্যকে না জানিয়ে অসামরিক এলাকায় এভাবে সেনা মোতায়েন অসাংবিধানিক৷ মানুষও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন৷” কেন্দ্রের কাছে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত চেয়ে তাঁর বক্তব্য, “জিআরপি বা আরপিএফ রাজ্যের অধীনেই এফআইআর করে৷ সেনাবাহিনী মহড়া করলেও আমাদের প্রশাসনকে জানায়৷ এটা নিয়ম৷ টোল প্লাজায় যেটা ঘটেছে, তার কোনও তথ্য আমাদের কাছে ছিল না৷” সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে এই বিষয়ে ক্ষোভ জানালেও সেনা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলতেই থাকে৷ রাত ১০টা নাগাদ ফের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, যতক্ষণ না সেনা প্রত্যাহার করা হবে ততক্ষণ তিনি নবান্ন থেকে যাবেন না৷ এই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন বিবৃতি দিয়ে বলেন, “সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এতকথা বলার পরেও এই কাজ করল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কাছে জানতে চেয়েছেন, রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে এইভাবে টোল প্লাজায় সেনা নামিয়ে কী কেন্দ্র অর্থনৈতিক জরুরি অবস্হার পাশাপাশি দেশে সাধারণ জরুরি অবস্থা জারি করতে চাইছে? নবান্নের মতো উচ্চ নিরাপত্তা বলয়ে থাকা এলাকায় সেনা কীভাবে ঢুকে গাড়ি থামিয়ে ‘টোল’ সংগ্রহ করতে পারে? এটা কি সেনা বাহিনীর কাজ? এটা কি রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়? কেন্দ্র কী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ চাইছে?” রাজ্যের তরফে প্রতিবাদ জানানো সত্ত্বেও জেলাগুলিতে সেনা নামানো বন্ধ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডেরেক৷ মুখ্যমন্ত্রী চাপ তৈরি করাতেই রাত ১২টা নাগাদ নবান্ন ও দ্বিতীয় হুগলি সেতু থেকে সেনা সরে যায়৷ তবে এ ব্যাপারে ফোর্ট উইলিয়ামে সেনাবাহিনীর সূত্র থেকে বলা হয়, নবান্নের সামনের টোল প্লাজা থেকে তারা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শেষ করেছে৷ সেই কারণে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে৷ শুক্রবার আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু হবে৷ তবে মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে সারারাত নবান্নে থেকে গেলেন তাতে স্পষ্ট, বিষয়টি নিয়ে শুক্রবারও সারাদিন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন চলবে৷
The post জঙ্গি অনুপ্রবেশে কেন রাতভর নবান্নে থাকেন না মমতা, কটাক্ষ লকেটের! appeared first on Sangbad Pratidin.