দুলাল দে: ছিল বেড়াল। হয়ে গেল রুমাল! সংস্থার কেউ কিছু জানেন না। অথচ লেটারহেডে বদলে গেল শতাব্দীপ্রাচীন আইএফএর (IFA) ‘লোগো।’ যা নিয়ে রীতিমতো বিস্মিত গভর্নিং বডির সদস্যরা। গভর্নিং বডির কোনও সদস্যকে কিছু না জানিয়ে এভাবে ইতিহাস সমৃদ্ধ শতাব্দীপ্রাচীন আইএফএর লোগো বদলে ফেলায় ক্ষুব্ধ ক্ষুব্ধ ময়দানের ফুটবল কর্তারা। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে আইএফএর এই চিরন্তন লোগোর সঙ্গে অনেকের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। সবাই জানেন, কি হয়েছে। কীভাবে এর প্রতিবাদ করা যায়, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছে।
১৭ এপ্রিল সব অনুমোদিত সংস্থাগুলিকে আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায় (Jaydeep Mukherjee) যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে ব্যবহৃত হয়েছে আইএফএর চিরন্তন লোগো। সঙ্গে পুরনো লেটারহেড। যেখানে রয়েছে, সব পদাধিকারীর নাম। আর ২৭ এপ্রিল প্রিমিয়ার ডিভিশনের যে ক্লাবগুলিকে চিঠি দিচ্ছেন সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের একটি লেটারহেডে। যেখানে আইএফএর আসল লোগো সরে গিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে শতবর্ষের লোগো। অথচ এই ১০ দিনের ব্যবধানে সংস্থার লোগো পরিবর্তনের জন্য কারও থেকে কোনও অনুমতি নেননি তিনি।
আইএফএর সভাপতি অজিত বন্দ্যোপাধায় (Ajit Banerjee) বললেন, “কাউকে কিছু না বলে এভাবে আইএফএর লোগো বদলে দিয়ে রীতিমতো অন্যায় করেছেন সচিব।”
[আরও পড়ুন: IPL 2022: আজ সামনে রোহিতের মুম্বই, সম্মানরক্ষার লড়াইয়ে নাইটদের চিন্তা ওপেনিং]
নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী, এআর ব্রাউন, বিসি লিন্ডসে এবং ওয়াটসন মিলে ১৮৯৩’সালে আইএফএ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১১’তে সেই আইএফএ শিল্ড জিতেই ভারতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে আলোড়ন ফেলে দেয় মোহনবাগান ক্লাব। শুরুর সেই সময় থেকেই আইএফএর লোগো ‘তারা চিহ্ন।’ আইএফএর লেটারহেড সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলার সময়েও যে জার্সি পরে বাংলার ফুটবলাররা খেলেন, সেখানেও এই তারা চিহ্নর লোগো থাকে। বিভিন্ন রাজ্য সংস্থাকে আইএফএর তরফে যে চিঠি পাঠানো হয়, সেখানে লেটারেহেডে থাকে আইএফএর চিরন্তন ‘তারা চিহ্ন’। অথচ, সাম্প্রতিক কালে আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায় প্রিমিয়ার ডিভিশনের ক্লাবগুলিকে আইএফএর যে লেটারহেডে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে আইএফএর চিরন্তন, তারা চিহ্ন লোগোর পরিবর্তে একজন ফুটবলার বলে শট নিচ্ছেন, যা আইএফএর শতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল, সেই লোগো বসানো হয়েছে। অথচ এই লোগো পরিবর্তন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আইএফএর গভর্নিং বডির কোনও সদস্যই জানেন না। যে কারণে, সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের একার সিদ্ধান্তে শতাব্দীপ্রাচীন সংস্থার চিরকালীন লোগো বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে ময়দানে।
মোহনবাগান হোক কিংবা ইস্টবেঙ্গল ক্লাব, যখনই কোনও ইনভেস্টরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে চেয়েছে, সমর্থকরা সবার আগে জানতে চেয়েছেন, ক্লাবের লোগো পরিবর্তন হচ্ছে না তো? মোহনবাগানে যেরকম পালতোলা নৌকো, ইস্টবেঙ্গলে সেরকম মশাল। যার সঙ্গে যেভাবেই চুক্তি হোক, এই দুটি লেগো কিছুতেই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেন না সমর্থকরা। চুক্তির সময় সবার আগে সমর্থকদের তরফে দাবি থাকে, যাই হোক, ক্লাবের লোগো কিছুতেই পরিবর্তন করা যাবে না। সেরকম দুই ক্লাবের কর্তারাও চুক্তির আগে বারবার করে মনে করিয়ে দেন, কিছুতেই ক্লাবের লোগো বদল করা যাবে না। কারণ, একটি সংস্থার লোগো সংস্থার পরিচয় বহন করে। সেখানে কাউকে কিছু না জানিয়েই সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায় যে লেটারহেডে চিঠি দিচ্ছেন, সেখানে আইএফএর আসল লোগোটাকেই উধাও করে দিয়েছেন!
ক্লাবের লোগো ‘মশাল’ হলেও শতবর্ষের সময় ‘শতবর্ষের লোগো’ হিসেবে ১০০ লেখা একটা নতুন লোগো প্রকাশ করেছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। শতবর্ষের লোগো হলেও, তার মধ্যে ক্লাবের আসল লোগো ‘মশাল’ ছিল। ক্লাব যখন সরকারি ভাবে কাউকে চিঠি দেয়, তখন কিন্তু ক্লাবের আসল লোগো মশাল থাকা লেটারহেডেই চিঠি দেয়।
একই ভাবে আইএফএর শতবর্ষে নতুন করে একটি লোগো প্রকাশ করেন সেই সময় আইএফএর সচিব প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্ত। যেটাকে শতবর্ষর লোগো বলা হত।। সেখানে ছিল, একজন ফুটবলার, বলে শট মারছেন। শতবর্ষে এরকম একটা লোগো প্রকাশের কারণ হিসেবে সেই সময় প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্তর ব্যাখ্যা ছিল, আইএফএর আসল লোগো ‘তারা চিহ্ন’ দেখে অনেক সময় বোঝা যায় না, অ্যাসোসিয়েশন কিসের সঙ্গে জড়িত। তাই শতবর্ষের লোগোতে বলে শট নেওয়া একজন ফুটবলারকে রাখা হয়েছে। সেই সময় আইএফএর শতবর্ষের লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন, ‘ভিকট্রি পাবলিসিটি এজেন্সি’র সুভাষ সাহা।
সেই বছর দলবদলের সময় ফুটবলাররা সই করতে এলে প্রত্যেক ডিভিশনের ফুটবলারকে একটি করে চাবির রিং দেওয়া হয়েছিল। যে চাবির রিঙয়ের একদিকে ছিল, আইএফএর আসল লোগো ‘তারা চিহ্ন।’ অপরদিকে ছিল ‘শতবর্ষের লোগো’। শতবর্ষ কেটে গেলে পরবর্তী ক্ষেত্রে আইফএর লেটারহেডে মাথার উপরে আইএফএর তারা চিহ্নর লোগোটি থাকলেও, লেটারহেডের নিচের দিকে শতবর্ষর লোগোটি থাকত। আর লেটার হেডে একেবারে নীচের দিকে, আইএফএর পদাধিকারীদের নাম। কিন্তু প্রিমিয়ার ডিভিশনের ক্লাবগুলিকে আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ২৭ এপ্রিল যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ নতুন একটি লেটারহেড। সেই লেটারহেডের মাথার উপরে আইএফএর আসল লোগোই ব্যবহৃত হয়নি। সেই জায়গায় শতবর্ষের লোগো ব্যবহৃত হয়েছে। লেটারহেডের নীচে সভাপতি, চেয়ারম্যান, কোষাধ্যক্ষ, সহ সভাপতি কারও নাম নেই!
এসব দেখে আইএফএর দীর্ঘদিনের কার্যকরী সম্পাদক, তথা অভিজ্ঞ গভর্নিং বডির সদস্য প্রদীপ বসু বললেন, “এভাবে নিজেদের লোগো কিছুতেই বদলে দিতে পারে না আইএফএ। কারণ, তারা চিহ্ন লোগোটই সরকারি ভাবে নথিভুক্ত করা আছে। সংস্থার লোগো বদলাতে গেলে অনেক অনুমতির প্রয়োজন হয়। সচিব যে লোগোটি ব্যবহার করে চিঠি দিয়েছেন, তা আইএফএর শতবর্ষের লোগো।”
এর আগে আইএফএ যে পর পর বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করেছে, সেখানেও প্রথম পাতাতেই আইএফএর চিরন্তন ‘তারা চিহ্নর’ লোগো। ময়দানের প্রশ্ন, কোন সভায় পাশ করে লোগো বদলালেন সচিব? সভাপতি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “সচিবের হাতে কিছু ক্ষমতা দেওয়া থাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তার মানে এই নয় যে, আইএফএর লোগোই বদলে দেবেন। এটি ভীষণই স্পর্শকাতর ব্যাপার। বহু মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে আইএফের চিরন্তন লোগোর সঙ্গে। এরকম স্পর্শকাতর কিছু বিষয় বদলাতে হলে, গভর্নিং বডির সদস্যদের অনুমতি নিতে হয়। অথচ জয়দীপ কিছুই করেননি। নতুন লোগো দিয়ে নতুন লেটারহেড ব্যবহার করে অত্যন্ত অন্যায় করেছেন সচিব।” এই প্রসঙ্গে বক্তব্য নেওয়ার জন্য সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায়কে দু’বার ফোন করলেও ফোন ধরেননি তিনি।
সব মিলিয়ে রাতের অন্ধকারে লোগো পরিবর্তন নিয়ে আইএফএর নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে কিন্তু বিশাল ঢেউ উঠেছে।