শুভজিৎ মণ্ডল: বঙ্গের ভোট রঙ্গে রঙ্গমঞ্চের কলাকুশলীদের আগমন ইদানিং বেশ লক্ষণীয়। এ ধারা বিশেষ পুরাতন নয় বটে কিন্তু বেশ ট্রেন্ডিং। শাসক থেকে বিরোধী সব শিবিরই স্থানীয়, পরীক্ষিত বা পোড়খাওয়া নেতাদের উপেক্ষা করে ‘পপুলার’ মুখের দিকে ঝুঁকছে। কিন্ত প্রশ্ন হল কেন এই প্রবণতা? সতিই কি কোনও পোড়খাওয়া নেতার চেয়ে জনপ্রিয় মুখের জেতার সম্ভাবনা বেশি থাকে? নাকি ফিল্মি সেলেব, বা কোনও ক্রীড়াক্ষেত্রের তারকাকে ভোট ময়দানে নামিয়ে দেওয়াটা স্রেফ চমক।
এমনিতে বঙ্গ রাজনীতিতে তারাদের আগমনের এই প্রবণতা বিশেষ পুরনো নয়। পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকার শিল্পসংস্কৃতিকে মূলধারার রাজনীতির বাইরে রাখাটাকেই শ্রেয় মনে করত। বাম আমলে সেলিব্রিটিদের রাজনীতিটা শিল্পী সংসদের নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাতে নাকি একটি কংগ্রেসি গোষ্ঠী, একটি বামপন্থী গোষ্ঠী ছিল। কিন্তু ওই রাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল শিল্পী সংসদের মধ্যেই। টলিউড বা টেলিদুনিয়ার তারকাদের, বা ক্রীড়াজগতের রথী-মহারথীদের রাজনীতির ময়দানে আগমনের প্রবণতা শুরু হয় ২০০৪ বা পাঁচ সালের শেষের দিক থেকে। এমন নয় যে বাম আমলে চলচ্চিত্র বা শিল্প সংস্কৃতি জগতের কেউ রাজনীতি করতেন না। আবার এমনও নয় যে বামপন্থীরা কোনও সেলিব্রিটিকে কোনও দিন প্রার্থী করেনি। সিপিএমের টিকিটে অনিল চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায় বা দেবদূত ঘোষদের ভোটে লড়তে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ঘোষিত বামপন্থী এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার আগে প্রত্যেকেরই দীর্ঘদিন রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা ছিল।
[আরও পড়ুন: ‘সিরিয়াল ছেড়েছি তৃণমূলের জন্য’, ভোটের মুখে বড় কথা লাভলির!]
সত্যি বলতে সরাসরি সেলিব্রিটিদের আগমন বা রাজনীতির সঙ্গে কোনওরূপ যোগাযোগ না থাকা জনপ্রিয় মুখকে সরাসরি ভোট ময়দানে নামিয়ে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয় মূলত তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী বাংলায় যখন বাম বিরোধী হাওয়া তুঙ্গে, সেসময় অনেক সেলিব্রিটিই ঝুঁকেছিলেন তৃণমূলের দিকে। কবীর সুমন, তাপস পাল, শতাব্দী রায়ের মতো একগুচ্ছ মুখকে ২০০৯ লোকসভার প্রার্থী করেন মমতা। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনেও একাধিক সেলিব্রিটি প্রার্থী হন তৃণমূলের টিকিটে। ২০১৪ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে(Lok Sabha 2024) তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। একে একে মুনমুন সেন, দেব, নুসরত, মিমি, প্রসুন বন্দ্যোপাধ্যায়রা নেমে পড়েন ভোটের ময়দানে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে এই সেলেব সংখ্যাটা অনেকটাই বেড়ে যায়। সায়নী ঘোষ, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, জুন মালিয়া, রাজ চক্রবর্তী, সোহমের মতো বহু তারকাকে প্রার্থী করেন মমতা। সেই ধারা অব্যাহত ২৪-এর লোকসভাতেও (Lok Sabha 2024)। এবারে তারকা প্রার্থীদের তালিকায় নতুন সংযোজন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইউসুফ পাঠান, কীর্তি আজাদ, শত্রুঘ্ন সিনহা (শত্রুঘ্ন অবশ্য আগেই তৃণমূলের টিকিটে উপনির্বাচন জিতে আসেন)।
সেলেব বা তারকাদের সরাসরি ভোটের ময়াদানে নামিয়ে দেওয়া যদি ‘দোষ’ হয়, তাহলে সেই ‘দোষে’ বিজেপিও দোষী। বাংলায় ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে বিজেপিও একগুচ্ছ সেলিব্রিটিকে ভোটের ময়দানে ব্যবহার করেছে। এই বাংলাতেই বিজেপির হয়ে ভোটে লড়েছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাপ্পী লাহিড়ী, বাবুল সুপ্রিয় (বর্তমানে তৃণমূলের সদস্য), যশ দাশগুপ্তরা। তনুশ্রী, পায়েল, শ্রাবন্তী, পার্নো মিত্র, অঞ্জনা বসুদেরও রাজনীতির ময়দানে ব্যবহার করেছে বিজেপি। পরের দিকে সিপিএমের টিকিটেও দেবদূত ঘোষের মতো সেলেবকে লড়তে দেখা গিয়েছে। মোট কথা সব শিবিরের প্রার্থী তালিকাতেই বাড়ছে সেলিব্রিটিদের উপস্থিতি। যা কিনা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দক্ষিণী রাজনীতির বিশেষত্ব ছিল। বাংলাও চমক-জাঁক জমকের রাজনীতির ধরনকে একাত্ম করা শুরু করেছে।
প্রশ্ন হল, সেলেব বা তারকাদের দাঁড় করানোটাই কি ভোটে জয়ের গ্যারান্টি? ইতিহাস ও পরিসংখ্যান দুটোই বলছে একেবারেই তেমনটা নয়। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে সেলেবদের দাঁড় করালেও ভোটে হারের মুখ দেখতে হচ্ছে। যেমন হেরেছেন মুনমুন সেন, সায়নী ঘোষ, জুন মালিয়া, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাপ্পী লাহিড়ী, শ্রাবন্তী, যশ-সহ একগুচ্ছ সেলেব নেতা। এঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রে কমবেশি সফল এবং জনপ্রিয়। এঁরা ভোটপ্রচারে গেলে প্রচুর ভিড় টানার ক্ষমতা রয়েছে। ভোটের প্রচারের সময় এদের নানান কার্যকলাপ সংবাদমাধ্যমের শিরোনামেও থাকে। কিন্তু কোনওভাবেই এঁদের প্রার্থী হওয়াটা জয়ের নিশ্চয়তা দেয় না। সম্ভবত সেকারণেই আজও প্রার্থী ঘোষণার পর তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে হয়, “সব আসনে আমিই প্রার্থী।” আবার বিজেপিকে বারবার বলতে হয় ‘মোদি গ্যারান্টি’র কথা।
আসলে এই সেলিব্রিটিদের প্রার্থী করে জয় তুলে আনার ফর্মুলা ইদানিং সেভাবে কাজ করছে না। আপনি যতই সেলিব্রিটি হন, নিজেদের ‘নেতা’ হিসাবে বা ‘ঘরের ছেলে বা মেয়ে’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে আমজনতার মন পাওয়াটা সহজ নয়। তাছাড়া যে কোনও নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রয়োজন পড়ে সাংগঠনিক শক্তি। সেলেবরা যে দলের হয়ে প্রার্থী হচ্ছেন, সেই দলের যদি সাংগঠনিক শক্তি না থাকে, তাহলে স্রেফ জনপ্রিয়তায় ভর করে জিতে আসার নজির বড় বিরল। ধরা যাক, কোনও এক সেলিব্রিটি অভিনেতা, বা কোনও এক তারকা ক্রিকেটার হঠাৎ অজানা-অচেনা কোনও কেন্দ্রে গিয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কোনও সাংগঠনিক শক্তি ছাড়া, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছাড়া, ড্যাং ড্যাং করে তিনি ভোটে জিতে যাবেন, অন্তত আজকের বাংলায় তেমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। কারণ মানুষ বুঝে গিয়েছেন, এই সেলিব্রিটিরা ভোটের আগে প্রচারে যতই একাত্মতা দেখান, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভোটের পর তাঁর টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় সমস্যা নিয়ে তিনি সরব হচ্ছেন বা বিপদে পাশে থাকেন, এমনটাও দেখা যায় না। অবশ্যই কতিপয় এর ব্যতিক্রম আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষয়টা এরকমই। এই ধরনের সেলিব্রিটি জনপ্রতিনিধির থেকে ‘ঘরের ছেলে’রা অনেক শ্রেয়, সেটা ইদানিং বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
[আরও পড়ুন: ‘সিরিয়াল ছেড়েছি তৃণমূলের জন্য’, ভোটের মুখে বড় কথা লাভলির!]
প্রশ্ন হল, জয়ের নিশ্চয়তা যখন নেই, তখন এত এত সেলিব্রিটিকে প্রার্থী করা কেন? আসলে সেলেবদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির মূলত তিনটি তত্ত্ব কাজ করে। এক, সম্ভাবনাময় অথচ কঠিন আসনে জয় নিশ্চিত করা। ধরা যাক, কোনও আসনে জয়ের সম্ভাবনা ধরা যাক ৫০-৫০ বা ৪৫-৫৫, সেই আসনে সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে জিতে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। দুই, গোষ্ঠী কোন্দল এড়ানো। কোনও এক কেন্দ্রে হয়তো দলের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিস্তর গোষ্ঠীকোন্দল, সেই কেন্দ্রে স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করা হল তাঁর বিরোধী শিবির বেঁকে বসতে পারে। সেই ধরনের কেন্দ্রে সেলিব্রিটিকে প্রার্থী করার প্রবণতা দেখা যায়। তিন, কোনও কেন্দ্রে যদি সেভাবে স্থানীয়, গ্রহণযোগ্য মুখ না থাকে তাহলেও সেলিব্রিটি প্রার্থী দাঁড় করানোর প্রবণতা থাকে। এর বাইরে অনেক সময় স্রেফ চমক দেওয়া এবং প্রচারে থাকার জন্যও তারকাদের প্রার্থী করা হয়। কিন্তু এই সেলেব বা তারকাদের প্রার্থী করাটা কোনওভাবেই জয়ের নিশ্চয়তা দেয় না। দলের সাংগঠনিক শক্তি, এবং জনমুখী ইস্যু নিয়ে ভোটে না লড়লে যে কোনও প্রার্থীর পক্ষেই জেতা কঠিন, সে যিনি যত জনপ্রিয়ই হোন না কেন।