অরিজিৎ গুপ্ত, হাওড়া: বঙ্গ রাজনীতির ছত্রে ছত্রে যেন কাহিনি! সময়ের স্রোতে কখন কীভাবে রাজনৈতিক অঙ্কের হিসেবনিকেশ বদলে যায়, তা আগাম আঁচ করা তীক্ষ্ণ মেধাবী রাজনীতিকের পক্ষেও সম্ভব নয়। আর প্রতিটি নির্বাচন যেন ফিরিয়ে আনে সেই স্মৃতি। চব্বিশের লোকসভা ভোটের (Lok Sabha Election 2024) আগে বিভিন্ন কেন্দ্র নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে করতে উঠে আসে সেসব গল্প। একদা যা ছিল কংগ্রেস গড়, ক্ষমতা বদলে তাই-ই সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি হয়ে ওঠা, তার পর তৃণমূলের দখলদারি। এই ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে হাওড়া (Howrah) লোকসভা কেন্দ্রটিও। আবারও সামনে দিল্লির লড়াই। এবার কেমন হতে চলেছে হাওড়া কেন্দ্রের নির্বাচনী চিত্র, আগাম আঁচ পাওয়ার সামান্য প্রচেষ্টা এই প্রতিবেদনে।
রাজনৈতিক ইতিহাস
১৯৫১ সালে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রটি তৈরি হয়। বামফ্রন্ট সরকারে থাকার সময়ও হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রটি কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) দখলে গিয়েছে বেশ কয়েকবার। পরের বছর, ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন কংগ্রেসের সন্তোষ কুমার দত্ত। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬২ ও ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত সিপিএমের (CPM) দখলে ছিল কেন্দ্র। সাংসদ ছিলেন মহম্মদ ইলিয়াস। উনি পর পর দুবার জিতে সাংসদ হয়েছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ আবার কংগ্রেসের প্রার্থী কে কে চট্টোপাধ্যায় জিতে সাংসদ হয়েছিলেন। এর পর ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পর পর তিনবার জিতে সাংসদ হন সিপিএমের সমর মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে ফের বামেদের হাত থেকে হাওড়া কেন্দ্রটি ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস। সেবার এখান থেকে জিতে সাংসদ হন প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। আবার ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬ ফের হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রে ফিরে আসে বামেরা। সাংসদ হন সুশান্ত চক্রবর্তী। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮, দুবছরের জন্য সাংসদ ছিলেন কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি।
জনবিন্যাস
হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের বিরাট অংশে অবাঙালি ও সংখ্যালঘু মুসলিমদের বসবাস। সাঁকরাইল ও পাঁচলা এলাকা মোটের উপর সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। শিবপুরে প্রচুর অবাঙালির বসবাস। তবে সবমিলিয়ে জনবিন্যাসের নিরিখে এই কেন্দ্র মিশ্র পরিচয়ই রেখেছে।
বিধানসভা কেন্দ্র
এই লোকসভা কেন্দ্রে ৭ টি বিধানসভা কেন্দ্র –
১) বালি
২) হাওড়া উত্তর
৩) হাওড়া মধ্য
৪) শিবপুর
৫) হাওড়া দক্ষিণ
৬) সাঁকরাইল
৭) পাঁচলা
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
১৯৯৮ সালে তৃণমূলের জন্ম হওয়ার পর ১৯৯৮ – ১৯৯৯ পর্যন্ত মাত্র এক বছরের জন্য ভোটে জিতে সাংসদ হন তৃণমূলের বিক্রম সরকার। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৯ – পর পর দুবার ফের হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রটি বামেদের দখলে যায়। সাংসদ সিপিএমের স্বদেশ চক্রবর্তী। এর পর ২০০৯ সালের পর থেকেই হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয়ে যায় সিপিএমের। ২০০৯ সালের পর থেকে টানা ১৫ বছর এই লোকসভা কেন্দ্রটি তৃণমূলের দখলে রয়েছে। সেবার জিতে তৃণমূলের সাংসদ হন অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের পর থেকে এখনও পর্যন্ত টানা এই কেন্দ্রের সাংসদ প্রাক্তন ফুটবলার, তৃণমূলের প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।
[আরও পড়ুন: দোলে রঙিন সৌমিত্র, বাইকে সঙ্গী নববিবাহিত স্ত্রী, পরনে হলুদ-লাল রংমিলান্তি পোশাক]
গত এক দশক ধরে এখানে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি থাকলেও ২০১৯ সালের পর থেকে বেশকিছু জায়গায় বিজেপি মাথাচাড়া দিয়েছে। সিপিএম বা বামপন্থীরা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। সারা রাজ্যের মতো হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রেও বেশ কিছু এলাকায় বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি তাদের সংগঠন মজবুত করেছে।
২০১৯ লোকসভা ভোটের ফলাফল
এই বছর হাওড়া কেন্দ্রে লড়াই হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি। এমনকী ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, হাওড়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন বিজেপি (BJP) প্রার্থী রন্তিদেব সেনগুপ্ত। রন্তিদেব পেয়েছিলেন ৬৭০১৭টি ভোট। সেখানে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝুলিতে আসে ৬৪০৫৬টি ভোট। ২,৯৬১টি ভোটে পিছিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন। তবে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে এই ব্যবধান ঘুচিয়ে উত্তর হাওড়া থেকে ভোটে জিতে তৃণমূল প্রার্থী গৌতম চৌধুরীই বিধায়ক হয়েছেন। অন্যদিকে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি প্রার্থী রন্তিদেব সেনগুপ্তর থেকে ১,০৪,০৪৩ ভোট বেশি পেয়ে জিতেছিলেন।
[আরও পড়ুন: আইএসআইয়ের কার্যকলাপ রুখতে কড়া কেন্দ্র, কলকাতায় কমেছে পাক বধূদের আত্মীয়দের যাতায়াত]
চব্বিশের লড়াই
এবার হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রে লড়াই মূলত ত্রিমুখী। তৃণমূলের প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপির রথীন চক্রবর্তী ও সিপিএমের সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। এই লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেও তার জয়ের ব্যবধান খুব বেশী হবে না এমনকী গতবারের থেকেও তা কমতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। এবারও বিজেপি প্রার্থী রথীন চক্রবর্তীর সঙ্গে লড়াই হবে জোরদার এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এই লড়াইয়ে প্রসূন এগিয়ে থাকলেও তাঁর জয়ের ব্যবধান কমবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।