সুমন করাতি, হুগলি: তপ্ত চৈত্রের দুপুর, সূর্য মাঝ আকাশে। কাঠফাটা গরমে বিশাল বটগাছের নিচে জিরোচ্ছিলেন সিঙ্গুরের (Singur) সানাপাড়ার কয়েকজন কৃষক। এরই মধ্যে টোটো করে কয়েকজন বিজেপি কর্মী মাইকে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিলেন। আসন্ন চব্বিশের ভোটে (Lok Sabha Election 2024) তাঁরা লকেট চট্টোপাধ্যায়কে ভোট দেওয়ার জন্য বলছিলেন। সেই আওয়াজে ঝিমুনি কেটে গেল তাঁদের। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে টের পেলেন, ভোট আসছে। ফের প্রচারের 'উৎপাত' শুরু হল। ঘটনাস্থল হুগলি। আর হুগলি মানেই সিঙ্গুর আবেগ। যে সিঙ্গুর রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের উত্থানের এক বড় কারণ। সেই জায়গার প্রকৃতি বদলেছে। বদলেছে রাজনৈতিক হাওয়াও। তৃণমূলের সেই উত্থানভূমি এখন গেরুয়া শিবিরের দখলে। অন্তত ২০১৯ সালের নির্বাচনী ফলাফল তাই বলছে। সময়ের চাকায় ঘুরে ফের এসেছে আরেক লোকসভা ভোট। এবার হুগলির হাওয়া বদল হবে? নির্বাচনের প্রাক্কালে সেই প্রশ্নই ঘুরছে জমি আন্দোলনের স্থানে।
ইতিহাস
১৯৫২ সাল থেকে হুগলি (Hooghly) লোকসভা কেন্দ্রের আত্মপ্রকাশ। প্রথম সাংসদ হন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার এন সি চট্টোপাধ্যায়। অর্থাৎ এই এলাকায় গেরুয়া হাওয়া ছিলই। ১৯৫৭ সাল থেকে সেই হাওয়া ঘুরতে শুরু করে। তার পর দীর্ঘ সময় জুড়ে বামেদের দখলে ছিল হুগলি লোকসভা কেন্দ্র। সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনই ছিল সিপিএমের (CPM) আধিপত্য শেষের ইঙ্গিত। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে এখানকার রাজনৈতিক ছবিটা বদলে যায়। আর তার ঠিক এক দশকের মধ্যে ফের পরিবর্তন।
ঐতিহাসিক সিঙ্গুর। নিজস্ব চিত্র।
বিধানসভা কেন্দ্র
হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র -
- সিঙ্গুর
- চুঁচুড়া
- চন্দননগর
- বলাগড়
- পান্ডুয়া
- সপ্তগ্রাম
- ধনিয়াখালি
জনবিন্যাস
এই কেন্দ্রে হিন্দুদের সংখ্যা ৭০ শতাংশ, সংখ্যালঘু ৩০ শতাংশ। মোট ভোটার ১৬ লক্ষ ৩০ হাজার ৪২ জন।
অতীতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
১৯৫৭ থেকে ১৯৮৪ সাল - পরপর ৬ বার হুগলির গড় দখলে ছিল সিপিআই ও সিপিএমের। ১৯৮৪-তে একবারই কংগ্রেস (Congress) জিতেছিল। সাংসদ হন ইন্দুমতী ভট্টাচার্য। ফের ৬ বার হুগলি থেকে সিপিএমের জনপ্রতিনিধি যান দিল্লিতে। ২০০৯ সাল অর্থাৎ সিঙ্গুর আন্দোলনের অনতিবিলম্বেই লাল গড়ে ধস নামিয়ে হুগলিতে জোড়াফুল ফোটাতে সক্ষম হন রত্না দে নাগ। পরপর দুবার তিনিই ছিলেন সাংসদ। তার পর ২০১৯ সালে হুগলি দখল করে বিজেপি। তবে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে এক অবিশ্বাস্য ফল হয়েছিল এই কেন্দ্রে। সেই সময় গত দু'বারের জয়ী প্রার্থী তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) ডাক্তার রত্না দে নাগকে প্রথম আবির্ভাবই বিজেপির তারকা প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় প্রায় ৭৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পিছনে ফেলে লোকসভায় গিয়েছিলেন। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৬ শতাংশের একটু বেশি। ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন রত্না দে নাগ। তৃতীয় স্থানে থাকা সিপিএমের প্রদীপ সাহা পেয়েছিলেন মাত্র ৮.৩৪ শতাংশ ভোট।
[আরও পড়ুন: প্রচারে বেরিয়ে মহিলাদের চুমু, পিঠে হাত খগেনের! বিজেপি প্রার্থীর কাণ্ডে বিতর্ক তুঙ্গে]
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে (WB Assembly Polls 2021) রাজনৈতিক চিত্রটা পুরোপুরি পালটে গিয়েছে। এখানকার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের সবকটিতেই ফুটেছে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীরা। ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটেও একই বদল। বাম, বিজেপিকে বহু পিছনে ফেলে হুগলি জেলা পরিষদ দখল করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ঘাসফুলের দখলে।
কী বলছে হাওয়া?
এই কেন্দ্রের বিশেষ নজরে অবশ্যই বঙ্গ রাজনীতির মোড় ঘোরানো সিঙ্গুর। শিল্প এলে সিঙ্গুরের চেহারাটাই বদলে যেত নাকি এইই ভালো? এই তর্ক সেই ২০০৬ সাল থেকে চলছে। কিন্তু তার মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়ায় বদলে গেছে সিঙ্গুরের বিভিন্ন অঞ্চল। সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বেচারাম মান্না। সিঙ্গুরের প্রতিটি মানুষ বলছেন, যে কোনও প্রয়োজনে বেচারামকে পাওয়া যায়। সে পুজোর সময় হোক অথবা ইদ, দোল যে কোনও উৎসবে, যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিপদে আপদে বেচারাম মান্না কে কাছে পায় এখানকার মানুষ। কিন্তু এবারের ভোটে হুগলি লোকসভা ভোটে কী ফলাফল হবে? তাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একদল বলছে, গত পাঁচ বছরে সাংসদকে তাঁরা সেভাবে দেখতে পাননি। করোনা, লকডাউনের মত মহামারীর সময়েও পাশে পাওয়া যায়নি বিজেপিকে (BJP)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাশে ছিলেন তৃণমূলের নেতা, কর্মীরা।
সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক বেচারাম মান্না। নিজস্ব ছবি।
ভোটের হাওয়া এবার কীরকম? পাল্লা ভারী কার দিকে? এসব প্রশ্ন শুনে কৃষিজীবী মানুষজন বলছেন, ভোট যেমন প্রতিবার আসে, তেমনি এবারও এসেছে। কিন্তু তিমির কাটেনি। তবে সিঙ্গুরের কৃষকদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক কিছুই করেছেন, তা মেনে নিলেন তাঁরা। বিশেষ করে 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার', 'কন্যাশ্রী', 'রূপশ্রী'-সহ অন্যান্য প্রকল্পের সুবিধা কথাগুলি একনাগাড়ে বলে গেলেন কৃষক পঞ্চানন মণ্ডল। তাঁর কথা শেষ না হতে হতেই আর একজন ফুঁসে উঠে তুললেন টাটার গাড়ি কারখানা প্রসঙ্গ। তাঁর দাবি, গাড়ি কারখানা হলে ছেলেমেয়েরা কিছু করেকম্মে খেতে পারত। 'চাষার ব্যাটা চাষাই হবে', এই বদনামটুকু ঘুচত। অর্থাৎ শিল্প না হওয়ার জন্য তিনি দায়ী করছেন বর্তমান শাসকদলকে।
[আরও পড়ুন: ‘মমতা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছেন, আপনাকে ভোট দেব কেন?’, মহিলার প্রশ্নে তর্কে জড়ালেন সজল]
প্রার্থী পরিচয়
এবারের নির্বাচনে হুগলি কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় (Locket Chatterjee)। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁর বিরুদ্ধে নামিয়েছে 'দিদি নং ওয়ান' রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রথম রাউন্ডেই ছক্কা মেরে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। দুই দলের দুজন অভিনেত্রী শহর এবং গ্রামীণ কেন্দ্রে হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে।
সম্ভাবনা
একদিকে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Rachana Banerjee) পাণ্ডুয়ার বিভিন্ন ব্লক গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনা করছেন, তখন দেখা গিয়েছে লকেট চট্টোপাধ্যায় ধনেখালির প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দ্বিতীয়বারের জন্য মানুষের মন জয় করতে। কিন্তু বিজেপিকে পদে পদে প্রশ্নে বিদ্ধ হতে হচ্ছে। এছাড়াও এই কেন্দ্রের বিজেপি কর্মীদের মধ্যে বেশ কিছু গোষ্ঠী কোন্দলও রয়েছে। লকেটের বিরুদ্ধে পোসটারও পড়েছে। তবে বিজেপি নেতৃত্ব পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, এই বিষয়টা সম্পূর্ণ মনগড়া, তৃণমূলের রটনা। তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্ব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে কোনও মূল্যে এবারে হুগলি লোকসভা আসনটি পুনরুদ্ধার করতেই হবে। এবং সেই পথেই ছুটে বেড়াচ্ছেন এখানকার প্রার্থী-সহ তৃণমূলের বিশাল বাহিনী। এঁদের মাঝে সিপিএমের মনোদীপ ঘোষ নিজস্ব কায়দায় প্রচার করছেন। জনতার কাছে গিয়ে ভোটপ্রার্থনা করছেন।
হুগলির সিপিএম প্রার্থী মনোদীপ ঘোষ। নিজস্ব চিত্র।