সোমনাথ রায়: I.N.D.I.A বনাম A-B-C-D। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Election 2024) জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচন মোটামুটি ঘোরাফেরা করছে এই দুই তত্ত্ব। প্রথমটি নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আসুন দেখে নেওয়া যাক ঠিক কী এই A-B-C-D?
অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে সেখান থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন প্রাক্তন কংগ্রেস ও বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টি নেতা গুলাম নবি আজাদ। যদিও উপত্যকার তিন আসনেই প্রার্থী দিচ্ছে ডিপিএপি। সঙ্গে কাশ্মীরে (Kashmir) লড়াই করছে আলতাফ বুখারির জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টি, সাজাদ লোনের জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্স। এই তিন দলকে বিজেপির (BJP) বি, সি ও ডি টিম হিসাবে কটাক্ষ করে আসছিল আবদুল্লাদের ন্যাশনাল কনফারেন্স, মুফতিদের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও কংগ্রেস। আক্রমণ আরও তীব্র হয়েছে উপত্যকায় বিজেপি প্রার্থী না দেওয়ায়। যদিও কাশ্মীরের প্রধান তিন হেভিওয়েট দলের বক্তব্য, ৩৭০ পরবর্তী পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের আমজনতা যে মোদি-শাহের উপর চুড়ান্ত ক্ষুব্ধ, তিন কেন্দ্রেই তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, তা বুঝতে পেরেই উপত্যকায় প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। পালটা পদ্ম শিবিরের বক্তব্য, কাশ্মীরের তিন আসন নিয়ে অত ভাবছে না তারা। তাদের নজরে গোটা দেশ। যদিও বিজেপির দাবি, উপত্যকায় কিংমেকার হবে তারাই।
[আরও পড়ুন: বুলেটে ব্যালট রোখার ছক জেহাদিদের! ভোটের কাশ্মীরে খতম লস্কর জঙ্গি]
নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই কাশ্মীরে বিজেপি বিরোধী দলগুলির মধ্যে ঘুরছিল এ-বি-সি-ডি তত্ত্ব। বিজেপি-কে ‘ইন্ডিয়া’র (INDIA alliance) প্রধান প্রতিপক্ষ (এ) হিসাবে উল্লেখ করে তাদের ‘বি-সি-ডি’ দল বলা হচ্ছিল ডিপিএপি, আপনি পার্টি ও পিপলস কনফারেন্সকে। কাশ্মীরে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ এনসি-কংগ্রেস। জম্মুতে হলেও কাশ্মীরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আসন সমঝোতা হয়নি। শ্রীনগর, বারামুল্লা ও অনন্তনাগ-রাজৌরি – তিন কেন্দ্রেই প্রার্থী দিয়েছে এনসি, পিডিপি দুই দল। মুফতির এই অনড় মনোভাবকে এনসি প্রকাশ্যে ও কংগ্রেস আড়ালে ‘একগুঁয়েমি’ হিসাবেই উল্লেখ করছে। এছাড়া জম্মুতে কংগ্রেসের দুই প্রার্থীকে সমর্থন করছে এনসি। একইভাবে কাশ্মীরের তিন এনসি প্রার্থীকে সমর্থন করছে কংগ্রেস। যদিও পিডিপির সঙ্গে যাতে সংঘাত তৈরি না হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে না।
গত লোকসভা নির্বাচনে কাশ্মীরের তিন কেন্দ্রেই জিতেছিল এনসি। পিডিপি শ্রীনগরে চতুর্থ, বারামুল্লায় দ্বিতীয় এবং তৎকালীন অনন্তনাগ কেন্দ্রে তৃতীয় হয়। পিডিপি এবার বাকি আসনগুলি নিয়ে কিছু না বললেও বরাবর অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রে প্রার্থী দেওয়ার দাবি করে আসে। এই কেন্দ্রে ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের হয়ে জেতেন মুফতি মহম্মদ সইদ। ২০০৪ ও ২০১৪ সালে জেতেন তাঁর কন্যা মেহবুবা মুফতি। এছাড়া বারবার মুফতিরা এই কেন্দ্রের ওয়াচি, অনন্তনাগ, বিজবেহারা, পহলগাম বিধানসভা থেকে জিতেছেন মুফতি পিতা-কন্যা। এই কারণ দেখিয়েই ‘পারিবারিক’ কেন্দ্র থেকে লড়তে চেয়ে জোরালো সওয়াল করেন মেহবুবা। ওমর আবদুল্লার পালটা বক্তব্য ছিল, গতবার যারা কংগ্রেসেরও পিছনে থেকে তৃতীয় হয়েছিল, তারা কোন যুক্তিতে এই কেন্দ্র থেকে লড়ার দাবি করতে পারে?
অভ্যন্তরীণ এই লড়াইয়ের পাশাপাশি ‘ইন্ডিয়া’-র নজর ছিল বিজেপি কোন আসনে কাকে প্রার্থী করে সেদিকে। শেষপর্যন্ত বিজেপি প্রার্থী না দেওয়ায় হঠাৎ করেই অবাক হয়ে যায় রাজনৈতিক মহল। এনসি-র প্রধান মুখপাত্র তানভির সাদিক বলছিলেন, “কাশ্মীরের মানুষের রোষ বুঝতে পেরেছে বিজেপি। তাই প্রার্থী দেওয়ার সাহস দেখায়নি।” পিডিপি নেতা সুহেল বুখারি এক কদম এগিয়ে জানিয়েছেন, “বিজেপি জানে এখানে প্রার্থী দিলে ওদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।” যদিও বিজেপি মুখপাত্র আলতাফ ঠাকুর জানিয়েছেন, “সব দল প্রচারে আক্রমণ করছে শুধু আমাদের। তাহলেই বুঝুন কাশ্মীরে আমাদের উপস্থিতি কতখানি। মিলিয়ে নেবেন, প্রার্থী না দিলেও ওখানে কিংমেকার হব আমরাই।”
[আরও পড়ুন: প্রিয়াঙ্কার বিরুদ্ধে লড়তে নারাজ! রায়বরেলি থেকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব ফেরালেন বরুণ গান্ধী]
কাশ্মীরের জনগণের কাছে লোকসভা নির্বাচন নিয়ে পরম্পরাগত ভাবেই উৎসাহ কম। তাঁদের বক্তব্য, এই ভোট দিল্লির ভোট। এখানে যে বা যাঁরা জিতবেন, তাঁরা গিয়ে বসবেন দিল্লিতে। স্থানীয় সমস্যায় তাঁরা খুব একটা কাজে আসবেন না। কাশ্মীরিদের আগ্রহ বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। এনসি ও পিডিপির সামনে বিজেপির সঙ্গে ডিপিএপি, আপনি পার্টি ও পিপলস কনফারেন্স প্রার্থী দেওয়াকে দিল্লির চাল হিসাবে উল্লেখ করছে স্থানীয় দুই হেভিওয়েট দল। তিন দলের তিন সুপ্রিমোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির সম্পর্ক সামনে এনে তিন দলকে ভোট কাটুয়া হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। পালটা সেই ‘ভোটকাটুয়া’-দের বক্তব্য, বাজপেয়ী ক্যাবিনেটে মন্ত্রী ছিলেন ওমর আবদুল্লা। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মেহবুবা মুফতি। কে বা কারা বিজেপির বেশি ঘনিষ্ঠ, একে অন্যের দিকে সেই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি নিয়েই পারদ চড়ছে কাশ্মীরের রাজনৈতিক আবহাওয়ায়। বিজেপি প্রার্থী না দেওয়ায় কাশ্মীরে তাদের হারানো হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু দিল্লির বিজেপির কাছে যাতে ৩৭০ পরবর্তী উপত্যকার ক্ষোভের বার্তা পৌঁছনো যায়, তার জন্য কাশ্মীরি ভোটারদের পাখি পড়ানোর মতো ভোটের হার বাড়ানোর মন্ত্র দিচ্ছে এনসি, পিডিপি, কংগ্রেস, সিপিআই(এম)। স্থানীয় প্রশাসনও চাইছে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করুন। এই লক্ষ্যে জম্মু-কাশ্মীরে যেদিন যে এলাকায় নির্বাচন, সেদিন সেই এলাকায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল, প্রশাসনের পাশাপাশি কাশ্মীরের বিভিন্ন মহলের স্থানীয় মানুষও জানাচ্ছেন, এবার তাঁরা বেশি করে প্রয়োগ করবেন নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
দেখার শুধু নেতাদের পরিকল্পনামাফিক বেশি করে ভোট দিয়ে দিল্লিতে ক্ষোভের বার্তা পাঠায় কাশ্মীর? নাকি বিজেপি প্রার্থী না দেওয়ায় এই জেদে ভাটা পড়ে?