বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত, চম্বল: সরকারি খাতায় নামের পাশে ১৭টা খুন, ১৮টা ডাকাতি, ২৮টা অপহরণ আর ১৯টা হত্যার চেষ্টা খতিয়ান। সে অবশ্য আজকের কথা নয়। আটের দশকের পুলিশের রেকর্ডের তথ্য। সে সময় তিনি ছিলেন মধ্যপ্রদেশ (Madhya Pradesh), উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থান–দেশের তিন রাজ্যের ত্রাস। রুখু, ঊষর বেহড়ের অসংখ্য টিলা ও গিরিখাত ছিল তাঁর বিচরণক্ষেত্র। তাঁর খাসমহল।
মালখান সিং। বাগী-বেহড়-বন্দুকময় চম্বল উপত্যকায় একদা শেষ কথার মালিক। তাঁর নামে কাঁপত গোটা চম্বল ও গোয়ালিয়র জেলা। লোকে বলে, তাঁর সময়ে বেহড়ের কোথাও কোনও মহিলার দিকে কুনজরে তাকানোর সাহস দেখায়নি কেউ। ধর্ষণ তো দূরের কথা! গরিবের মসিহা, ধনীদের ত্রাস মালখান এখন ৭৫ পেরনো বৃদ্ধ। চম্বলের একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তি।
এবারের বিধানসভা ভোটে সেই বৃদ্ধ মালখান সিং-ই এখন রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের চম্বল ও গোয়ালিয়র প্রশাসনিক বিভাগের আট জেলার ৩৪টি আসনে কংগ্রেসের (Congress) অন্যতম তুরুপের তাস। গতবার এই ৩৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ২৬টি আসন। সৌজন্যে তৎকালীন কংগ্রেস সেনাপতি জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। রাজনৈতিকভাবে এই এলাকার গোয়ালিয়র বিভাগের অন্তর্গত পাঁচ জেলার ২১টি কেন্দ্র ছাড়াও চম্বল বিভাগের তিন জেলার রাজস্থান সীমান্তবর্তী সেওপুর জেলার দুই বিধানসভা কেন্দ্রে সিন্ধিয়া রাজপরিবারের প্রভাব অনস্বীকার্য। সেই জ্যোতিরাদিত্য হাত ছেড়ে পদ্ম শিবিরে চলে যাওয়ার পরই তাই এই এলাকায় হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছে কংগ্রেস। সেই ধাক্কা সামলাতে প্রচারে নামানো হয়েছে পদ্ম শিবির থেকে কংগ্রেসের হাত ধরা মালখান সিংকে। লক্ষ্য ক্ষত্রিয় ভোটও।
কাঁধ থেকে বন্দুক নামানোর পর মালখান সিং এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিক। দু বার ভোটেও লড়া হয়ে গিয়েছে। জেতেননি অবশ্য কোনওবারই। গোয়ালিয়র জেলার করেরা বিধানসভার কেন্দ্রের অন্তর্গত খেরিয়ার গ্রামে দুকামরার ঘরে তাঁর বাস। তবে সেখানে তিনি নেই। তিনি আছেন বেশ কিছু দূরের বিহর গ্রামে। তবে টেলিফোনে দেওয়া ওয়াদা মেনে দুপুর গড়াতেই বাড়ির সামনে সশব্দে দাঁড়াল মিশকালো বোলেরো। দশাসই চেহারার পঁাচ সঙ্গীর ঘোরাটোপে বাড়ি ঢুকলেন মালখান। পরিচয় দিতেই একগাল হাসি। ‘‘বাংলার লোকেও আমার নাম জানে? ডাকাইত? আমি ডাকাইত নই। গরিবের অধিকার রক্ষায় লড়েছি। লড়ব। লড়াই জারি থাকবে।’’
অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য এতটুকু অনুশোচনা নেই মালখান সিংয়ের। তাঁর দাবি, তিনি জমির অধিকার, এলাকার উন্নয়ন, গরিব মানুষের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমৃত্যু লড়াই করে যাবেন। সেই লড়াই জারি রাখতেই বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান। তাঁর কথায়, ‘‘ভাজপা ধনীদের দল। সেই দলে থেকে গরিবের জন্য লড়াই করা যায় না।’’
[আরও পড়ুন: মিলেছে কত অনুদান? বুধবারের মধ্যে জানাবে সব রাজনৈতিক দল, নির্দেশ কমিশনের]
প্রয়োজন হলে আবার বাগী হতে পারবেন? প্রশ্ন শেষ হওয়া মাত্র সপাট উত্তর, “বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক্তের জোর কমেছে। কিন্তু মনের জোর আগের মতোই। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে দৌড়ে বেড়াই আজও। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করি। পরিস্থিতি যদি আবার বাধ্য করে তা হলে কাঁধে বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য হব।’’ প্রাক্তন বাগীর কথায়, ‘‘কেউ ইচ্ছে করে ডাকাত হয় না। পরিস্থিতি বাধ্য করে। আমি কোনওদিন ডাকাতি করিনি। লড়াই করেছি গরিবের জমির অধিকারের জন্য। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নারীদের ইজ্জত রক্ষার জন্য যদি কেউ বন্দুক তুলে নেয়, তা কখনই অন্যায় নয়। চম্বলের লোক নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াই করছিল। আমি নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। আমি যে ১৫ বছর চম্বলে লড়াই করেছিলাম, সে সময় চম্বলে একটাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। এটা সমাজসেবা নয়?’’
[আরও পড়ুন: রাহুল ‘মূর্খের সর্দার’! ভোটপ্রচারে কংগ্রেস নেতাকে তীব্র কটাক্ষ মোদির]
একটানা বলে থামলেন মানুষটা। পিছনের প্রাইমারি স্কুলকে দেখিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, “এই স্কুলের জন্য গ্রামের লোককে কম লড়াই করতে হয়েছে? প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেও স্কুল না পেয়ে জেলাশাসকের দফতর ঘেরাও করে রাখে গ্রামের মানুষ। বাধ্য হয়ে প্রশাসন স্কুল তৈরি করে দেয়। তখন আমিও গ্রামের মানুষের সঙ্গে ছিলাম। এই কাজকে আপনারা কী বলবেন?”
ইন্টারভিউ শেষ। গাড়ির দিকে পা বাড়ালেন একদা চম্বলের ত্রাস মালখান সিং। আবার যেতে হবে প্রচারে। দল যে গুরুদায়িত্ব চাপিয়েছে তাঁর কাঁধে।